Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Monsoon

শ্রাবণে শরতের মেঘ, বৃষ্টির দেখা নেই, কী এমন ঘটছে যে এমন অদ্ভুত আবহাওয়া!

বর্ষাকালের আকাশের এই চেহারাটার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি আমরা। শহরের মানুষের কাছে বেশি বর্ষা আবার বিরক্তি তৈরি করে।

আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে যেন শরৎ। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ

আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে যেন শরৎ। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ

দেবদূত ঘোষঠাকুর
দেবদূত ঘোষঠাকুর
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২২ ০৭:৫৮
Share: Save:

বর্ষায় প্রকৃতির চেহারাটা ঠিক কেমন হয়?

রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন ধার করে বলি, ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর, আউশের খেত জলে ভর ভর, কালীমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ চাহিরে’।

বর্ষাকালের আকাশের এই চেহারাটার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি আমরা। শহরের মানুষের কাছে বেশি বর্ষা আবার বিরক্তি তৈরি করে। গ্রামের মানুষের আবার সেটা ‘লাইফলাইন’। দেশের অর্থনীতির মূল রসদ।

রবি ঠাকুরের কবিতাটা আষাঢ় মাস নিয়ে লেখা। বছর ২০-২৫ হল আষাঢ় মাসে এই দৃশ্য আর দেখা যায় না। শ্রাবণ মাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রথমে ছিল শ্রাবণের একেবারে গোড়ায়। এখন তা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। এ বছর পরিস্থিতিটা দেখুন। আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে যেন শরৎ। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ‌। প্যাচপেচে গরমে শহরের মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা।

এ বার চলুন এক বার‌ গ্রাম প্রদক্ষিণ করে আসি। আমরা শহরের মানুষ যখন ভুগছি, তখন কী করছেন গ্রামের চাষিরা?

হাউ হাউ করে কেঁদে পড়লেন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। এত দিন জেনে এসেছি তিনি সম্পন্ন চাষি। কিন্তু তাঁর এই কান্না কেন? ‘‘কৃষি দফতরের সুপারিশে বীজতলায় গোবিন্দ ভোগ চালের বীজ ফেলেছিলাম। শতকরা ৯০ ভাগ বীজ থেকে বেরিয়েছে চারা কিন্তু বীজতলাতেই শুকিয়ে যাচ্ছে ধানের চারা,’’— কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আকাশকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন বীরভূমের কোপাইয়ের ওই চাষি।

তাঁর বেশির ভাগ জমিই উঁচু। বেশি বৃষ্টি হলে ওই জমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কাও নেই। তাই স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে গোবিন্দভোগ ধানের চারাও ফনফন করে বাড়বে। গাছ ভর্তি পুরুষ্টু ধান হবে। ওই চাষির আশা ছিল, এ বার ভাল লাভ করবেন। লাভের আশা তো নেই, অনাবৃষ্টিতে সর্বস্ব হারাতে হতে পারে। সেই আশঙ্কাতেই কাঁদছিলেন প্রৌঢ়ে‌।

বর্ধমানের কাটোয়ার এক সম্পন্ন কৃষকের গলাতেও চরম হতাশা। বলছেন, ‘‘সকাল ১০টা থেকেই মাঠে থাকতে পারি না। রোদে গা জ্বলে। মাঠে তো এক ছটাক বৃষ্টি নাই। আমন বোনার কোনও জল নেই। আমনের চারাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবজি চাষ করছি। সেগুলিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হলে সেচ দিতে হবে। কিন্তু সেচের জল পাই কোথায়?’’

শুধু বীরভূম, বর্ধমান কেন, গোটা দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির প্রচণ্ড ঘাটতি চলেছে। সামগ্রিক ভাবে ঘাটতিটা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। কোথাও তার ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। প্রচণ্ড তাপদাহে মাটি ফুটিফাটা। শ্যালো পাম্প চালিয়েও মাটির নীচ থেকে জল তোলা যাচ্ছে‌ না। বৃষ্টির অভাবে মাটির নীচের জলও যে শুকিয়ে কাঠ।

কবে ফিরবে এই ছবি, কেউ জানে না।

কবে ফিরবে এই ছবি, কেউ জানে না।

কেউ জানেন না বৃষ্টি কবে নামবে। কেন এই অবস্থা? এক আবহবিদ বলেন, ‘‘জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি। আকাশ মেঘমুক্ত। পাশাপাশি প্রখর সূর্যকিরণ। সব মিলিয়ে অসহনীয় অবস্থা। ভারী বৃষ্টি ছাড়া গরম কমবে না। কবে ভারী বৃষ্টিপাত হবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘আসলে সমুদ্রে নিম্নচাপ না হওয়ায় বৃষ্টির মেঘ জমতে পারছে না। ফলে বৃষ্টি হচ্ছে না। নিম্নচাপ হলে সমুদ্রের জল জলীয়বাষ্পের আকারে উপরে উঠে ঘনীভূত হয় এবং মেঘ তৈরি করে। সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। যে হেতু নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে না, তাই মেঘ জমে বৃষ্টি নামছে না। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এখন শুধু গরম বাতাস উপরে উঠছে। আকাশে যে মেঘ আছে সেটা শরতের মেঘ। বৃষ্টির মেঘ নেই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য কম বৃষ্টি হওয়া, বাতাসের গতি কমে যাওয়া, জলীয়বাষ্পের আধিক্য, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কমে যাওয়াকেই খলনায়ক বানাচ্ছে হাওয়া অফিস। পাশাপাশি গত এক দশকে গ্রীষ্ম ক্রমে দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং শীতকালেও গড় তাপমাত্রা বেশি থাকছে। আবার বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গিয়েছে আশঙ্কাজনক হারে।

আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাটা এক বার‌ লক্ষ করুন। জুন মাসে উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গ বৃষ্টিতে ভেসে গেল। বন্যায় ডুবে গেল বহু এলাকা। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা আস্ত একটা ট্রেন জলের তোড়ে ভেসে গেল।

অথচ বৃষ্টিটা তখন সব থেকে বেশি দরকার, তখন তার দেখা নেই। কী পরিস্থিতি ভরা বর্ষায়! প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা অনেকে আবার বলছেন, অতিরিক্ত গরমে মেঘ পুঞ্জিভূত হতে পারছে না। গরম বাতাসের ধাক্কায় মেঘে যে জল থাকে তা বৃষ্টি হয়ে নামার আগেই বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। আবার তীব্র গরম বাতাসের স্বাভাবিক গতি প্রবাহেও পরিবর্তন এসেছে। তাই বৃষ্টি নিয়ে এত হা-হুতাশ।

বর্ষা কালেও তীব্র গরম শহর জুড়ে।

বর্ষা কালেও তীব্র গরম শহর জুড়ে।

এখন আসল কথা হল, আকাশ ভেঙে বৃষ্টিটা নামবে কবে? সেই প্রশ্নের নির্দিষ্ট জবাব কিন্তু মিলছে না। উপগ্রহ চিত্রও সুসংবাদ দিতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে একটা সুখবর দিয়ে রাখি। আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করার সময় ধারাবাহিক ভাবে আবহাওয়ার খবর লিখতাম। যখনই লিখতাম বৃষ্টির দেখা নেই, কবে বৃষ্টি হবে জানা নেই— সেই সেই দিনে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামত। আজও যদি সেটা হয় তা হলে আমার থেকে সুখী আর কেউ বোধহয় হবে না। ছুটে গিয়ে বীরভূমের কোপাইয়ের সম্পন্ন চাষির চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারব যে!

অন্য বিষয়গুলি:

Monsoon Monsoon Rain Climate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy