Advertisement
E-Paper

প্রশ্নহীন আধিপত্যের লক্ষ্যে

হাহাকারের এই শব্দক্ষেপণ আমাদের পরিচিত। কিন্তু এই ধরনের হাহাকারের মধ্যে আরও একটি ধারণা নিহিত থাকে।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৩ ০৮:০৫
Share
Save

অনুদানভিত্তিক রাজনীতির একটি অপ্রকাশ্য শর্ত থাকে। শাসক দল চায়, যে জনতাজনার্দনকে তারা এত কাল ‘দেখে’ এসেছে, সেই তারা ভোটের সময়ে নিঃশর্ত ও প্রশ্নাতীত ভাবে শাসককেও ‘দেখবে’। জনতা দেখে অবশ্যই, তবে গোল বাধে সংশয় ঢুকে পড়লে। অর্থাৎ, যাদেরকে মনে করা হচ্ছিল কট্টর সমর্থক, তারাই যদি অন্যত্র ছাপ দিয়ে দেয়? এই বাজারে ঝুঁকি কে নেবে?

অতএব, আমদানি হয় সন্ত্রাসের— পঞ্চায়েত নির্বাচনের সমগ্র পর্ব জুড়ে যার সাক্ষী রইল পশ্চিমবঙ্গ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানি হয়েছে ৫২ জনের। আহত বহু। ঘরছাড়া অনেকে। কিন্তু, শুধু আহত আর মৃতের সংখ্যাই কি সন্ত্রাসের মাপকাঠি? সন্ত্রাসের ফলে সমাজে ও মননে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়, পরিসংখ্যান তার সন্ধান দেয় না।

একটা রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে হিংসার এই আবহ তৈরি হয় কী ভাবে? কী ভাবে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় রড-বোমা-গুলি-বন্দুকের জোগান পৌঁছে যায় জায়গামতো? কোন পরিস্থিতি তৈরি হলে রাজনৈতিক দলগুলি ধরে নিতে পারে যে, ভোটের বাজারে নির্বিচার সন্ত্রাসের এই বিপণনকালে কোনও প্রশাসনই তাদের টিকি ছুঁতে পারবে না?

দিনের পর দিন কান্নার-হাহাকারের-অসহায়তার-বিহ্বলতার ছবি দেখে দেখে আমরা ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত। যেমন, দিন কয়েক আগে আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রথম পাতায় এক বৃদ্ধার ছবি ছাপা হয়েছিল। সঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুরের এক গ্রামের বাসিন্দা, বৃদ্ধা মিলনবালা রায়ের অসহায় উক্তি: “ভয়ে ভোট দিতে পারছি না। রাত থেকে গ্রামে বোমাবাজি চলছে।... আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। কোনও দল করি না।... আমরা শান্তি চাই। নাগরিক হিসাবে ভোটটা দিতে চাই।” যদিও পরে স্থানীয় সাংসদের ভরসায় তিনি ভোট দিতে পারেন।

হাহাকারের এই শব্দক্ষেপণ আমাদের পরিচিত। কিন্তু এই ধরনের হাহাকারের মধ্যে আরও একটি ধারণা নিহিত থাকে। সেটি সত্য না মিথ্যা, তা অন্য প্রশ্ন— ধারণাটা হল, খেটে খাওয়া মানুষ কোনও দল করেন না। অন্য ভাবে দেখলে মনে হয়, তাঁরা হয়তো বোঝাতে চান যে, রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে খেটে খাওয়া মানুষ এক পঙ্‌ক্তিতে পড়েন না!

এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনপর্বে যাঁরা অকালে প্রাণ হারালেন, একটু খতিয়ে দেখুন, তাঁরা কেউ সমাজের তথাকথিত উঁচুতলার বা উচ্চতর আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থাকা মানুষ নন। এই ‘খেটে খাওয়া’ শ্রেণিটাই রাজনীতিকদের বড় পছন্দের! তাঁরা ভিড় করবেন সভাসমাবেশে, দাঁড়াবেন ভোটের লাইনে, আর সেই তাঁদেরই মধ্যে শক্তপোক্ত, ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ কেউ কেউ ব্যবহৃত হবেন অন্য কাজে। তাঁদের হাতে হাতে ঘুরবে বোমা, ওয়ান শটার, রিভলভার। এবং ঢাল হিসাবে তাঁদের বেছে নিতেই হবে রাজনৈতিক দলগুলিকে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণে শাসক দলকে। শাসক দল ছাড়া যথাযথ আশ্রয় মিলবেই বা কোথায়? তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, কোনও রকম হিংসাকে তাঁরা প্রশ্রয় দেন না, ‘আইন আইনের পথে চলবে’-মার্কা বাণীর সঙ্গে বাস্তবের অমিলটা যে বড় বেশি চোখে পড়ার মতো।

আর এখান থেকেই সৃষ্টি হয় এক ধরনের ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদী বললে কি শুধু রাষ্ট্রকেই বোঝায়, মানসিকতাকে বোঝায় না? এই মানসিকতা বিরোধী চায় না, বিরোধিতা চায় না। প্রতিস্পর্ধাকে সে যে-কোনও পথে দমন করতে চায়। আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি করাকে সে উৎসাহ দেয়। ওই যে অনেকটা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রাত্যহিকতায় ফ্যাসিবাদের মতোই। যাকে বলা হয় ‘এভরিডে এনকাউন্টারস উইথ ফ্যাসিজ়ম’।

আতঙ্ক কত দূর শিকড় ছড়ায়? এক সরকারি আধিকারিকের কথা বলি। এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার এক অংশে আড়াইশোরও বেশি বুথের দায়িত্বে ছিলেন তিনি ও অন্য ভোটকর্মীরা। নির্বাচন-পূর্ব হিংসা দেখতে দেখতে আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, ভোটের দিন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তাঁর মাকে ওই অফিসার বলেছিলেন, “মা, কোনও কিছু ঘটলে তুমি খবর পাবে। আশীর্বাদ করো, যেন এই অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করতে পারি।” পাশ করেছেন বটে, কিন্তু সন্ত্রাসের নানা চেহারাও দেখা হয়ে গিয়েছে তাঁর। সে বর্ণনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। ওই অফিসার বাম জমানাতেও ভোট করিয়েছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, বাম জমানায় সন্ত্রাস ছিল সঙ্ঘবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু এই জমানার ভোটে তা কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি বলছিলেন, “ভোট শেষ হয়েছে বেশ কয়েক দিন, কিন্তু এখনও ঘুমের ঘোরে আতঙ্কে চমকে-চমকে উঠি। মনে হয়, কারা যেন বুথে ঢুকছে, ব্যালটের হিসাব মিলছে না!”

গণতন্ত্রের এই উৎসবে সব হিসাব কি মেলে? এই যে ঘুমের মধ্যে আতঙ্কে চমকে-চমকে ওঠা, এখানেই তো সন্ত্রাসের সাফল্য! অজস্র অনিয়ম ও সন্ত্রাসের অভিযোগ কোর্টের দরজায় আছড়ে পড়ছে। রক্তে ভেজা সন্ত্রাসের যে বাতাবরণ সুকৌশলে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে, তা আপাত-অদৃশ্য বটে, কিন্তু এখানকার ভোট-সন্ত্রাসের দীর্ঘকালীন ‘ঐতিহ্য’ সে বহন করে চলবে আরও বহু কাল!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Election Violence Panchayat Election 2023

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}