৬ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে যদি ইতিহাসের আন্দাজ দিতে হয় তবে সমগ্র আন্দাজ দেওয়াই ভাল। বিজেপি সে ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করছে না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সম্প্রতি বিজেপি যে একচেটিয়া ভাবে সিলেবাস পরিবর্তন করছে, তার মধ্যে এক ধরনের অথরেটেরিয়ান বা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব রয়েছে। আমি মনে করি না যে, স্বাধীনতার পর নতুন সরকার যে সিলেবাস বানিয়েছিল, বিশেষত ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে যা পড়ানো হয়েছে, তার মধ্যেও এক ধরনের একদেশদর্শিতা ছিল না। তা-ও ছিল। হয়তো একটা সোভিয়েট, স্তালিনিস্ট সমাজতান্ত্রিক প্রভাবও ছিল এই সিলেবাস তৈরি হওয়ার মূলে। যখন আমরা ছেলেবেলায় ইতিহাস পড়েছি, কিছু কিছু জিনিসের দিকে ঝোঁক বেশি ছিল। যেমন স্বাধীনতা আন্দোলন যে মূলত কংগ্রেসই করেছে সেই বিষয়টিকেই বেশি করে তুলে ধরা হয়েছিল। কাকোরি ট্রেন ষড়যন্ত্র, আলিপুর বোমা মামলা থেকে শুরু করে আরও অনেক চরমপন্থী বা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন আমাদের কম বয়সের ইতিহাস বইতে তেমন ভাবে ছিল না।
ইতিহাস পড়ালে পুরোটাই একটা ইঙ্গিত দিতে দিতে যাওয়া ভাল। কিন্তু তার পরিবর্তে বিজেপি এখন যেটা করছে তার মধ্যে আরও বেশি করে অথরেটেরিয়ান মনোভাব ফুটে উঠছে। তাঁরা মোগল সাম্রাজ্য বাদ দিতে চাইছেন, আমি বুঝতে পারছি না এর বিকল্পে তাঁরা কী পড়াবেন? অর্থাৎ ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭, এই প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর তা হলে ভারতবর্ষে কী ঘটেছিল? বাংলায় তা হলে শশাঙ্ক পড়ানো হবে, হোসেন শাহ পড়ানো হবে না? যদুর গল্প আমরা জানব, জালালুদ্দিনের গল্প জানব না? কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ক্ষেত্রে পরাগল খাঁ বা ছুটি খাঁ-র ভূমিকা ভুলে যাব? এর মধ্যে এক ধরনের সরলীকরণ আছে। হাস্যকর বিষয়ও রয়েছে। কারা বাদ দিচ্ছেন, কেন বাদ দিচ্ছেন, সেই যুক্তি বুঝতে পারছি। কিন্তু বিজেপি যদি পরিষ্কার করে বলে যে তাঁরা বিকল্প কী পড়াবেন, তা হলে বুঝতে সুবিধে হয়। এই কাকোরি ট্রেন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে, ওই রামপ্রসাদ বিসমিলের সঙ্গে আরও অনেক বাঙালি জড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের কথা আমরা স্বাধীনতা-উত্তর নতুন ভারতীয় সিলেবাসে তেমন ভাবে জানতে পারিনি।
সম্ভবত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনকে অহিংসাপন্থী ভারতীয় সিলেবাস আমাদের জানতে দেয়নি। কেরল থেকে শুরু করে সংযুক্ত প্রদেশ পর্যন্ত বহু উপজাতি আন্দোলন বা শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের উল্লেখও আমাদের ইতিহাসে তেমন ভাবে ছিল না। পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেগুলি হয়তো আলাদা করে পড়ানো হয়েছে। কিন্তু ৬ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে যদি ইতিহাসের আন্দাজ দিতে হয় তবে সমগ্র আন্দাজ দেওয়াই ভাল। বিজেপি সে ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করছে না। তারা আর্যভট্ট থেকে শুরু করে পাণিনি আমাদের জানাতে চায়। আমাদের সে ব্যাপারে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও আরব দুনিয়ায় বা মধ্য প্রাচ্যে ঘটেছে। তার প্রভাব তখন ভারতবর্ষেও পড়েছে। সেগুলো তবে জানব না?
আমরা দীন-ই-ইলাহি পড়ব না তার মানে? যা নিকট ইতিহাস, যার ঐতিহাসিক স্বাক্ষর বেশি, ঐতিহাসিক চিহ্ন বেশি, তা-ই তো ইতিহাসবিদদের কাছে আকর বেশি দেয়। যা অনেক দূরের ইতিহাস, যেমন গণিতে ‘শূন্য’ কী ভাবে তৈরি হল, তা আমাদের পক্ষে অনুমান করা চলে, হয়তো ঐতিহাসিক কিছু সাবুদও আছে, কিন্তু নিকট ইতিহাস আরও বেশি জ্যান্ত।
এটা হতে পারে না যে ইস্তানবুলের ইতিহাস লিখতে গিয়ে যদি কোনও চরমপন্থী-মৌলবাদী কনস্টান্টিনোপলকে বাদ দেন! কনস্টান্টিনোপল কী ভাবে ইস্তানবুলে পরিণত হল, এবং তার মধ্যে কী ভাবে নানা রকম ধর্ম ও নানা রকম যুদ্ধ লুকিয়ে রয়েছে তার ইতিহাস ঝরঝরে। স্বচ্ছন্দে পড়ানো উচিত। আবার কেউ যদি মনে করেন ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ ব্রিটিশ পিরিয়ড বাদ দেবেন, কারণ তা আসলে আমাদের পরাধীনতার দগদগে গ্লানি বহন করায়, এ কি কখনও হতে পারে?
বিজেপি যেটা করছে তার মধ্যে কোনও চিন্তা বা পরিকল্পনা নেই। এক ধরনের সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োনোর চেষ্টা আছে। যে জনপ্রিয়তা কুড়োনোর জন্যে দেশের একটি গরিষ্ঠ অংশ আরও অজ্ঞানতার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার।
(লেখক রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy