বাজারের শাক-আনাজ, মাছ-মাংস’সহ খাবারদাবারে যথেচ্ছ কৃত্রিম রঙের রমরমা দেখলে আমার রবি ঠাকুরের বিখ্যাত গানের কলি ‘আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে’ মনে পড়ে যায়। বহুদর্শী কবি এ গান রচনা করার সময় হয়তো স্বপ্নেও কল্পনা করেননি, তাঁর গানের অন্তর্নিহিত ভাব বর্জন করে শুধুমাত্র এই কথা ক’টিকে বিক্রেতারা এমন নিবিড় ভাবে আত্মস্থ করে নেবেন।
২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আলুতে এলামাটি বা ইটের গুঁড়ো মাখানো নিষেধ করে এক নির্দেশিকা জারি করেছিল। কিন্তু তার পর এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও আলুতে এলামাটি বা ইটের গুঁড়ো মাখানো বন্ধ হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অবশ্য এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ, কৃষি বিপণন দফতর এবং রাজ্য সরকার গঠিত টাস্ক ফোর্স বিচ্ছিন্ন ভাবে দু’-একটা বাজারে হানা দিয়ে কিছু ধরপাকড় কিংবা খুচরো বিক্রেতাদের আটক করেছে। কিন্তু সরকারি নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাঁরা আলুতে এলামাটি মাখানো থেকে শুরু করে বাজারে আলুর সরবরাহ এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই সব মজুতদার এবং হিমঘর মালিকরা বরাবরই অন্তরালে থেকে গেছেন। এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ, টাস্ক ফোর্স অথবা ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট, ২০০৬’-এর আওতায় দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় প্রশাসন তাঁদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। ফলে, এ রাজ্যে আলুর গায়ে এলামাটি বা ইটের গুঁড়ো মাখানোর ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’।
অথচ বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন, এলামাটি আদতে এমন এক মিশ্র খনিজ পদার্থ, যার অন্যতম উপাদান হাইড্রেটেড ফেরিক অক্সাইড। এ ছাড়া অনেক সময় আলু রং করতে এলামাটির সঙ্গে লেড ক্রোমেটও ব্যবহার করা হচ্ছে। দুটোই শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। উপরন্তু এলামাটি বা ইটের গুঁড়োর কারণে কৃত্রিম ভাবে আলুর ওজন বাড়ানো এবং খুঁত ঢেকে দেওয়ার ফলে উপভোক্তারা প্রতিনিয়ত ওজনে এবং আলুর গুণগত মানেও ঠকছেন।
একই ভাবে মাছ-মাংস এবং আনাজপাতি আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং পচন ঠেকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা কৃত্রিম রঞ্জক এবং নিষিদ্ধ রাসায়নিক। মাছের কানকোয় এবং মিষ্টি আলুতে লাল রং (রেড অক্সাইড বা আলতা) অথবা পটল, ঝিঙে, উচ্ছে-সহ সবুজ আনাজে ব্যাপক ভাবে তুঁতের ব্যবহার যেন বাজারি দস্তুর হয়ে গেছে। অথচ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উল্লিখিত প্রতিটি কৃত্রিম রঞ্জকই শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। তবুও এই অন্যায্য ব্যবসা বন্ধ করার ব্যাপারে কোনও স্তরেই উদ্যোগ প্রায় চোখে পড়ে না।
একই সঙ্গে তেলেভাজা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিষ্টিতেও রং হিসেবে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে মেটানিল ইয়েলো বা লেড ক্রোমেট। সব ঋতুতেই বাজার আলো করে থাকছে অ্যাসিটিলিন (কার্বাইড) দিয়ে পাকানো ফল। সংরক্ষণের জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম মোম থেকে শুরু করে ফর্মালিনের মতো মারাত্মক রাসায়নিক। এগুলি শুধু নিষিদ্ধই নয়, প্রত্যেকটি রাসায়নিকই যে শরীরের পক্ষে প্রচণ্ড ভাবে ক্ষতিকর এবং নানা জটিল রোগের স্রষ্টা, বৈজ্ঞানিক ভাবে তা প্রমাণিত।
আশ্চর্য ব্যাপার হল, এক দিকে যেমন ক্রেতাদের সিংহভাগ এই সব কৃত্রিম রঞ্জক বা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত নন, অপর দিকে তেমনই বহু ছোট ব্যবসায়ী, তেলেভাজার দোকানি কিংবা ক্ষুদ্র মিষ্টি প্রস্তুতকারকরা সহজলভ্য এবং দামে সস্তা কৃত্রিম রঞ্জক খাদ্যসামগ্রীতে ব্যবহার যে বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ, সে কথা জানেনই না। সুতরাং, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এ বিষয়ে সর্বস্তরে ব্যাপক ভাবে সচেতনতা গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন। বিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
২০২০ সালের ২০ মার্চ ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ‘ভেজাল রোধ’ শীর্ষক এক প্রেস বিবৃতিতে জানাচ্ছে, ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস (প্রহিবিশন অ্যান্ড রেস্ট্রিকশন অন সেলস) রেগুলেশনস, ২০১১-র ২.৩.৬ ধারা অনুযায়ী তাজা ফল, আনাজপাতি হবে পচনমুক্ত ও মোম, খনিজ তেল এবং রঞ্জকমুক্ত। এ ছাড়া, ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্ট, ২০০৬’ এবং এই আইনের অধীনে জারি হওয়া যাবতীয় নিয়মকানুনকে কার্যকর করার দায়িত্ব প্রাথমিক ভাবে রাজ্য/ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিরই। ওই একই প্রেস বিবৃতিতে আরও দাবি করা হয়েছে, রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির পক্ষ থেকে নিয়মিত নজরদারি চালিয়ে আনাজপাতি ও ফল-সহ নানা খাদ্যসামগ্রীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে আইনভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই বিবৃতির সঙ্গে ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি কর্তৃক নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের যে তিনটি তালিকা সংযোজিত হয়েছে, আশ্চর্য রকম ভাবে তার মধ্যে প্রথম দু’টি অর্থবর্ষের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম নেই। শুধুমাত্র ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের তালিকায় এ রাজ্যের নাম রয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে, এ রাজ্যে ওই আর্থিক বছরে মোট পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ৫টি, তার মধ্যে ভেজাল বা নকল ধরা পড়েছে ২টিতে এবং আদায়কৃত জরিমানা ২৫,০০০ টাকা।
২০২০ সালের ২০ জুলাই দেশ জুড়ে কার্যকর হওয়া ক্রেতা সুরক্ষা আইন, ২০১৯-এ ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্ট, ২০০৬’ অনুযায়ী স্বীকৃত খাদ্যকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, ক্রেতাসুরক্ষা আইন, ২০১৯-এর আওতায় ইতিমধ্যেই বিশেষ ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘সেন্ট্রাল কনজ়িউমার প্রোটেকশন অথরিটি’ গঠিত হয়েছে। জেলাস্তরে এই অথরিটির হয়ে আইন প্রয়োগ করার বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলাশাসককে। এখন থেকে প্রত্যেক জেলাশাসক সংশ্লিষ্ট জেলার মধ্যে খাদ্যে দূষণ ও ভেজাল প্রতিরোধ-সহ অন্যায্য ব্যবসার ফলে সমষ্টিগত ভাবে উপভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।
তবে আইন-প্রয়োগকারীদের দীর্ঘ শীতঘুম দেখতে অভ্যস্ত উপভোক্তাদের আশঙ্কা, অন্যান্য আইন এবং নির্দেশিকার মতো এইটিও শুধুমাত্র কাগজবন্দি হয়ে থাকবে না তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy