আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) কথাটা আজকাল খুব শোনা যায়— একে আমরা বাংলায় বলতে পারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিষয়টি নিয়ে অনেকেরই ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। প্রায়শই শোনা যায় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমস্ত মনুষ্যসভ্যতাকে পাল্টে ফেলবে— মানুষের সব কাজকর্মই যন্ত্র করবে। যন্ত্রই মানুষকে চালাবে। মানুষ যন্ত্রে পরিণত হতে পারে, এ কথা গল্পে শোনা গিয়েছে— আধুনিক শিল্পসমৃদ্ধ সমাজে লোকে কী ভাবে যান্ত্রিক জীবনযাত্রায় গা ভাসিয়ে তথাকথিত যন্ত্রে পরিণত হতে পারে, সেই কল্পনা আমাদের চেতনার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু যন্ত্র মানুষে পরিণত হবে কী করে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে হলে এবং কী ভাবে তা মানুষের কাজে লাগতে পারে— বিশেষত চিকিৎসাশাস্ত্রে এবং ডায়াগনোসিস বা রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে— সেই বিষয়ে ভাবতে গেলে মনে পড়ে যে, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্ট্যানলি ম্যাকার্থি ১৯৫৫ সালে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল ‘দ্য সায়েন্স অ্যান্ড এঞ্জিনিয়ারিং অব মেকিং ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস’— বুদ্ধিমান যন্ত্র নির্মাণের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। সেই যন্ত্র নিজের শেখা ‘বুদ্ধি’-র গুণে মানুষের মতো চিন্তা করতে ও নানান সমস্যার যুক্তিসঙ্গত নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবে।
গোড়ার প্রশ্ন হল, ‘ইন্টেলিজেন্স’ বা বুদ্ধিমত্তা বলতে আমরা কী বুঝি? খুব সহজ কথায় বলতে গেলে, যে সব কাজ কয়েকটা সাধারণ নিয়ম মেনে সম্পন্ন করা যায়— যেমন, দুটো বড় সংখ্যাকে গুণ করা, বা কোনও সংস্থার টাকাপয়সার হিসাব রাখা— সেই কাজ করতে ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধি লাগে না। চেষ্টা করলে যে কোনও কম্পিউটারকে ধাপে ধাপে সেই কাজগুলো শেখানো (অর্থাৎ, প্রোগ্রাম করা) সম্ভব। কিন্তু এমন কিছু কাজ আছে যা আমরা, মানুষরা, অনায়াসেই করতে পারি— অথচ কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন যে, কী ভাবে করলাম, তার উত্তর আমরা দিতে পারব না। যেমন, অনেক জন্তুর মধ্যে একটা জন্তুকে ‘বেড়াল’ বলে চিহ্নিত করা, বা হাতের লেখা পড়তে শেখা। এই ধরনের কাজ, যাকে আমরা সচেতন ভাবে ছোট ছোট ভাগে ভেঙে ফেলতে পারি না, সেগুলো করার ক্ষমতাকেই ‘ইন্টেলিজেন্স’ বলা হয়। একটা কম্পিউটার যন্ত্রকে সেই কাজগুলো আয়ত্ত করানোর প্রযুক্তির নামই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে আধুনিক গবেষণা মূলত দুটো প্রধান ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী আমাদের মস্তিষ্কের একটা সরলীকৃত মডেল ব্যবহার করেন, যার নাম নিউরাল নেটওয়ার্ক। এই মডেলে লক্ষ লক্ষ উদাহরণের সাহায্যে কম্পিউটারকে যে কোনও একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে শেখানো হয়— যেমন জন্তুর ছবি চেনা, বা হাতের লেখা পড়তে শেখা। ঠিকমতো শেখানো হলে এই মডেলের সাহায্যে কম্পিউটার কিন্তু সেই নির্দিষ্ট কাজটা মানুষের মতোই করতে পারে। এর উদাহরণ হতে পারে কোনও রোগীর অসুস্থতা নির্ণয়, বা দোভাষীর কাজ করা বা দাবা খেলা। এই পদ্ধতিটা পুরনো হলেও, গত দশ বছরে কম্পিউটারের ক্ষমতা বাড়ার ফলে, এবং প্রশিক্ষণের জন্য প্রচুর ট্রেনিং ডেটা বা তথ্য থাকার দরুন এই বিষয় গবেষণার বিপুল ও অবিশ্বাস্য অগ্রগতি হয়েছে; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত বেশির ভাগ বাণিজ্যিক প্রগতিও নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলের উপর ভিত্তি করেই হয়েছে। তবে এই ধরনের মডেলগুলো যে কোনও একটা কাজই নিখুঁত ভাবে করতে পারে— অন্য কোনও সহজ কাজ করতেও সেই মডেল ব্যর্থ হবে। যে কম্পিউটার দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারাতে পারে, বাচ্চাদের কাটাকুটি খেলতে বললে তা সম্পূর্ণ অপদস্থ হয়ে যাবে!
তবে দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে এই বিশেষ পথেই গবেষণা করেন। তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য এমন যন্ত্র তৈরি করা, যা মানুষের শিশুর মতো নানা কাজ একই সঙ্গে শিখবে। একে বলা হয় জেনারেল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ধারণাটি খুবই চিত্তাকর্ষক, কিন্তু এই বিষয়ে এখনও তেমন অগ্রগতি ঘটেনি। তবে, বিজ্ঞানীদের কাছে এ বিষয় উন্নতি ও ‘বুদ্ধিমান যন্ত্র’ নির্মাণ করা একটা চূড়ান্ত আহ্বান।
বর্তমানে জনচিকিৎসার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতে জনসংখ্যার তুলনায় প্রাথমিক আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। গ্রামগঞ্জে, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালের ঘোর অভাব, সেখানে ডাক্তার পাওয়া আরও কঠিন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই প্রাথমিক চিকিৎসকের পক্ষে কম্পিউটার ব্যবহার করে রোগ বিশ্লেষণ, নির্ধারণ ও চিকিৎসার নানা পথ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। সারা পৃথিবীর নানান রোগের কোটি কোটি ট্রেনিং ডেটা (বর্ণনা, নির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি) কম্পিউটারের ‘জানা’ থাকবে নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলের মাধ্যমে। তাই প্রাথমিক চিকিৎসক বা নার্সও যদি কোনও রোগীর সব শারীরিক সমস্যার তথ্য কম্পিউটারে তুলতে পারেন, তা হলে কম্পিউটার সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্রেনিং তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে রোগ বর্ণনা ও নির্ণয় দিতে পারবে। অর্থাৎ যন্ত্রকে ‘শিখিয়ে’ দেওয়া যায়, কোনও রোগের ডায়াগনোসিস কী ভাবে করতে হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত এই কম্পিউটার চিকিৎসকদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘সহায়ক’ হয়ে উঠবে। কোনও মানুষের পক্ষেই পৃথিবীর সব রোগের যাবতীয় তথ্য জানা সম্ভব নয়— অথচ কম্পিউটারের পক্ষে সেটা অনায়াসেই সম্ভব। বর্তমানের কোভিড অতিমারির ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন কোভিড সংক্রমণের মডেল তৈরি করা, এবং কোন ঢেউ কখন কোন দেশের কোন বিশেষ স্থানে দেখা দিতে পারে, তার পূর্বাভাস করা— এগুলোর ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপুল ব্যবহার হচ্ছে। ফলে, ঘটনা ঘটার আগেই সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমরা অবহিত থাকছি। তাই সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়। বর্তমানে ভারতে মূলত চারটি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে— ক্যানসার, ডায়াবিটিস ও তজ্জনিত চোখের অসুখ, হাঁপানি এবং টিবি। ভারতের অগ্রগণ্য কিছু হাসপাতালের সঙ্গে দুনিয়ার একাধিক প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে কাজ চলছে।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সমস্যাও আছে। যেমন ভারতে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য-তথ্যের যথেষ্ট অভাব। বেশির ভাগ তথ্যই হাতে লেখা— অনেক ক্ষেত্রেই অপাঠ্য— কাজেই যথাযথ ডেটাবেস তৈরি করা খুবই কঠিন। অথচ যথাযথ ট্রেনিং ডেটা যদি ডেটাবেসে না থাকে, তবে কম্পিউটার-এর পক্ষে ঠিক রোগ নির্ধারণ এবং চিকিৎসার উপায় নির্ণয় করা অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে পদে পদে ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক— কম্পিউটারকে ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিলে সে ভুল ফল দেবে। এই সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হল স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব রেকর্ড কেন্দ্রীভূত ভাবে ডিজিটালি নথিভুক্ত করা। তেমনটা হলে দেশের যে কোনও জায়গা থেকে যে কোনও স্বাস্থ্য রেকর্ড অনায়াসেই দেখে নেওয়া যাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে। পরবর্তী কালে এই রেকর্ড পর্যাপ্ত হলে ডেটাবেসে নথিভুক্ত করা হবে। ভারত ধীরে ধীরে হলেও কিন্তু নিশ্চিত ভাবে এই পথে এগোচ্ছে।
আর একটা লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমরা দেশে দক্ষতা বাড়াতে পারছি কি না। গত কয়েক বছরে, ভারতে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত সংস্থার শতকরা বৃদ্ধির হার আমেরিকা আর চিনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। উপরন্তু এই বিষয়ে দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী স্নাতকও হচ্ছেন ভারতেই। অথচ দুঃখের বিষয় হল, স্নাতকোত্তর স্তরে বা পিএইচ ডি করতে ভারত থেকে ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে চলে যান, কারণ দেশে এই বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই কম। এঁদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে আসেন না। এই মেধা-চালান বন্ধ করতে হলে স্বভাবতই দেশে যথাযথ সুযোগ তৈরি করতে হবে— শুধু উচ্চশিক্ষার মাধ্যমেই নয়, প্রকৃত চাকরির প্রতিশ্রুতিও অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু অনস্বীকার্য যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রাঙ্গণে ভারতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল— অদূর-কালের উন্মুক্ত আহ্বান আমরা যেন অগ্রাহ্য না করি।
ওয়াল্টার আইজ়্যাকসন লিখেছিলেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল যন্ত্রের সঙ্গে শ্রম আর শিল্পের সংমিশ্রণ। আমরা জানি, যন্ত্রকে শ্রমিকের কাজ শেখানো যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, যন্ত্রকে ভাবতে শেখালে যন্ত্র কি শিল্পীও হতে পারবে? হয়তো-বা!
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ, ওয়াশিংটন ডিসি; গ্লোবাল চিফ ইনফরমেশন অফিসার, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy