এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা হল।
৮ মার্চ। মাধ্যমিকের দ্বিতীয় দিন। একেবারে সামনের বেঞ্চে বসা একটি মেয়ে হঠাৎ বলে উঠল, “স্যর, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে, গা বমি করছে।” মনে হল, যে হেতু ইংরেজি পরীক্ষা, সুতরাং এই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মেয়েটি একটু বেশি ঘাবড়ে গিয়ে এমন করছে। ফলে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে মেয়েটিকে জল খেতে বলে পরীক্ষা হলে নজরদারির কাজ চালিয়ে গেলাম। কিছু ক্ষণ পর দেখি আরও একটি মেয়ে আমাকে একই কথা বলল। সঙ্গে সঙ্গে হেডস্যরকে বলে স্কুলে কর্তব্যরত স্বাস্থ্যকর্মীকে ডাকা হল। তখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। কাকতালীয় কি না জানি না, তবে ওই দিনই চার জন মাধ্যমিক ছাত্রীর এ রকম ঘটনার কথা আমরা সবাই জানতে পারলাম। একই স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে আসা চারটি মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা, এই খবরে ধাক্কা লাগে তো বটেই।
মাধ্যমিক পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনেই খবরের কাগজে একটা সংবাদে চোখ আটকে গিয়েছিল। এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী একটি মেয়ের পথ আটকে দাঁড়ায় তার স্বামী! জানা গেল, মেয়েটি দশম শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে বাড়ির অমতে বিয়ে করে। কিছু দিন পর মেয়েটি বাপের বাড়ি চলে আসে। সে পড়তে চায়। কিন্তু, বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার স্বামীই! অবশেষে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা পেয়ে মেয়েটি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। ওই একই দিন টিভির সংবাদেও দেখলাম এক অন্তঃসত্ত্বা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী পরীক্ষার ঠিক এক ঘণ্টা আগে হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেও যথারীতি পরীক্ষা হলে উপস্থিত হয়েছে!
ঘটনাগুলির মধ্যে কিছু মিল আছে। ওরা প্রত্যেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে ৮ মার্চ, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। আর সবচেয়ে বড় মিল হল, ওরা প্রত্যেকেই জিতেছে, প্রচলিত নিয়ম আর বাধার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে।
নিশ্চিত ভাবেই ওরা কন্যাশ্রী। যে কন্যাশ্রীর জন্য রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। অথচ, সেই রাজ্যেই কিনা মেয়েদের মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে? এটা ঠিক যে, এ রকম দু’একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা কখনও দৃষ্টান্ত হতে পারে না। এই চিত্র নিশ্চয়ই গোটা রাজ্যের সামগ্রিক চিত্রও নয়। কিন্তু সংবাদ শিরোনামে আসা দু’একটি ঘটনা ছাড়াও আরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা সবার অলক্ষ্যে থেকে গেল কি না, সেই তথ্য জানা নেই। জানা নেই ঠিকই, তবে সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়।
আসলে ঘটনার তাৎপর্য বেড়েছে এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হিসেবে ছাত্রীদের সংখ্যাবৃদ্ধির তথ্যে। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর প্রায় এগারো লক্ষ সাতাশ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ছয় লক্ষ সাতাশ হাজার। অর্থাৎ, যত ছাত্র এই বার পরীক্ষা দিচ্ছে, তার চেয়ে এই দফায় পরীক্ষার্থী ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় এক লক্ষের মতো বেশি। নিঃসন্দেহে এই তথ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এবং এটি যে বহুলাংশে কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুফল, তাও বলা যেতেই পারে। কিন্তু, সেই সাফল্যের আলোর নীচেই জমে থাকে অন্ধকার— বহু মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, সব ঠিক নেই। এই ঘটনাগুলি দিয়ে কন্যাশ্রীর ব্যর্থতা প্রমাণ করা চলে না, সে কথা ঠিক। তবে মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া যে আন্তর্জাতিক খেতাব জয়ী কন্যাশ্রী প্রকল্পের গায়ে কালো দাগ, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কথা ঠিক যে, কোনও প্রকল্পই একশো শতাংশ সফল হতে পারে না। কিছু না কিছু দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। এই সীমাবদ্ধতার পিছনে ঠিক কোন কোন কারণ লুকিয়ে আছে, তা খুঁজে বার করার চেষ্টা করলেই সেই অন্ধকার দিকটি থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব। সরকারের উচিত সে বিষয়ে সচেতন থাকা।
করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের জেরে প্রায় দু’বছর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তারই মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়া এবং অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার জন্য প্রথমত তার পরিবারই দায়ী। আর দায়ী অভিভাবকের শিক্ষার অভাবও। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতা অনেকখানি। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সে কাজে কিছুটা হলেও বিলম্ব হয়েছে, বলাই যায়। কিন্তু সরকারি স্তরের পর্যবেক্ষণের ফাঁক দিয়ে এ রকম লজ্জাজনক ঘটনা কী ভাবে আজও ঘটে চলেছে, তার সূত্র ধরে ধারাবাহিক ভাবে এগোতে হবে এ বার। না হলে শুধু ছাত্রীদের সংখ্যাবৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়েই তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলা উচিত হবে না।
লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী কিংবা ঐক্যশ্রীর মতো সরকারি প্রকল্পের জন্য এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারের যাবতীয় তথ্য সরকারের নখদর্পণে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মহিলারা কিছুটা হলেও আর্থিক সুফল পাচ্ছেন। মেয়েরা সুফল পাচ্ছে কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য। অথচ, এ সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েও যে সব পরিবার অসচেতন ভাবে নাবালিকার বিয়ে দিয়ে সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে, তাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করা দরকার। চিহ্নিতকরণের কাজ করতে বিদ্যালয়ের সহযোগিতাও পাওয়া যাবে। চিহ্নিত করে সেই পরিবারগুলিকে বিশেষ ভাবে সচেতন করা প্রয়োজন, নাবালিকা বিবাহের কুফল বোঝানো প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধির প্রকল্পে এই পরিবারগুলিকে সংযুক্ত করে নেওয়া যেতে পারে। আগামী একটা বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে নাবালিকা বিয়ে আটকানোর সব রকম প্রচেষ্টা চালু হোক। সে ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত এবং রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা দূর করতে সরকার কতটা সদর্থক ভূমিকা নিতে পারে, সেটাও দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy