২০১৮ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর সমীক্ষায় প্রকাশ যে, থানায় লিখিত অভিযোগ তথ্যাকারে নথিবদ্ধ হয় শতকরা ৫২ ভাগ। তবে আদালত মারফত পাঠানো অভিযোগ লিপিবদ্ধের অনুপাত প্রায় নব্বই শতাংশ। কিন্তু যদি মানবাধিকার বা মহিলা কমিশন সেই অভিযোগ পেশ করে, তখন এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪ কি ৫ শতাংশ। অৰ্থাৎ, এক জন ছাপোষা মানুষের দৈনিক জীবনযাত্রার স্বাধীনতা বিপন্ন হলে থানার মধ্যে তিনি একাকী। অন্য দিকে, বিচারব্যবস্থাও স্থবিরতায় ভারাক্রান্ত। গোটা দেশে অমীমাংসিত মামলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটির কাছাকাছি। নীতি আয়োগ প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানা গিয়েছে যে, মহামান্য আদালত যদি পূর্ণ উদ্যমেও চেষ্টা করে, তা হলেও সব বকেয়া মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগবে ৩২৪ বছরের সামান্য বেশি।
অন্য এক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আইনসভায় নির্বাচিত ৩৬৩ জন সদস্য— নিজেদেরই হলফনামা অনুযায়ী— ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত। যদিও গড়পড়তায় কয়েক দশক ধরেই অমীমাংসিত, তবু অনেকেরই বিরুদ্ধে খুন, ডাকাতি এবং ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশি ব্যবস্থার নিষ্ক্রিয়তা, শ্লথ বিচার প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক পরিসরে দুর্বৃত্তায়ন নিশ্চয়ই সংসদীয় গণতন্ত্রের ত্রিস্তর কাঠামোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার চিহ্ন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, এই দুরবস্থার জন্য আইনবিভাগ-বিচারবিভাগ-শাসনবিভাগের এই ত্রিস্তরের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক কতখানি দায়ী?
সম্প্রতি ব্রিটেন এবং সিঙ্গাপুরের তিন শিক্ষক চেষ্টা করেছেন শেষোক্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো থেকে প্রকাশিত খ্যাতনামা এক আইনি জার্নালে লেখা গবেষণাপত্রে গবেষকত্রয়ী ১৯৯৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের লড়া বড় মাপের ৬২৫টি মামলার রায়ের অন্তর্নিহিত তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সামগ্রিক ভাবে বিচারপতিদের মধ্যে যাঁরা ওই সমস্ত মামলায় সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন, অবসরের পর তাঁদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য অংশ পেয়েছেন নানান সরকারি পদ, চাকরি ও দাক্ষিণ্য। গবেষকত্রয়ী ব্যবহার করেছেন মেশিন লার্নিংয়ের অত্যাধুনিক পদ্ধতি— বাছাই করা প্রতিটি বিচারের রায়ের ভাষা, সেখানে ব্যবহৃত বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের বৈশিষ্টসমূহ পাখিপড়া করে শিখিয়েছেন শক্তিশালী কম্পিউটারকে। তার পর এই প্রক্রিয়া থেকে উঠে আসা তথ্য আতশকাচের তলায় রেখে পর্যবেক্ষণ ও জারণ করে, অত্যাধুনিক পরিসংখ্যান শাস্ত্রের সহায়তায় বারংবার যাচাই করে দেখেছেন যে, সরকারের পক্ষে অনুকূল একটি বাড়তি রায় থেকে অবসর নেওয়ার পর পদপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় প্রায় ১৫ শতাংশের কাছাকাছি।
এই তথ্য থেকে অবশ্যই এমন কথা প্রমাণিত হয় না যে, রাজনীতিকমাত্রেই অভিযুক্ত, বা বিচারপতিরা কাজ করেন তাঁদের অবসরপ্রাপ্ত জীবনে সরকারি দাক্ষিণ্যের আশায়। তবে তথ্যের এই সুচিন্তিত ও নিরপেক্ষ পর্যালোচনা ইঙ্গিত করে যে, সর্ষের মধ্যে স্বল্প হলেও কিছু পরিমাণ ভূত তো আছেই।
আইনি অনুজ্ঞাপত্র নিয়ে এক জন সরকারি উচ্চপদস্থের ক্ষমতার অপব্যবহার প্ররোচনা দেয় সেই বৃত্তে থাকা অন্যদের। আইনলঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি থেকেই সংক্রামক এই ব্যাধি ছড়িয়ে যায় সারা সমাজের ধমনীতে। এক জন ক্ষমতাশালী মানুষের এক বারের পদস্খলনে সমগ্র সমাজে অন্যায্য পথে চলার ঘটনার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। গোটা সমাজ নীচে নামে আরও কয়েক ধাপ। ফলস্বরূপ দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষ শিকার হন রাষ্ট্র-পরিচালিত রাজনৈতিক উৎপীড়নের, অথবা অন্ধ ধর্মীয় অনুশাসনের। তার উপর নিষ্ক্রিয় প্রশাসন, শ্লথ বিচারব্যবস্থা, ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ত্র্যহস্পর্শে তিনি হারান তাঁর ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারও। অবস্থা নাগালের বাইরে চলে গেলে, প্রকাশ্যে খুন, অপহরণ হয়ে দাঁড়ায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। তারই প্রতিফলন হাথরস, দাদরি, হাঁসখালি, বগটুইয়ের ঘটনা; দলিত কন্যার উপর পৈশাচিক নির্যাতন, অসহায়ের উপর গোরক্ষকদের বর্বর অত্যাচার, নাবালিকা ধর্ষণ। পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যেকার দূরত্ব নাকি একেবারে যথার্থ। কম-বেশি হলে পৃথিবী আবহমান কাল ধরে পুড়ে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হত, অথবা নেমে আসত চিরকালীন এক হিমযুগ। মনে হয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের ত্রিস্তরের মধ্যকার নৈকট্যের প্রকৃতিও তাই। ক্রমবর্ধমান সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে অস্বীকার করা মুশকিল যে, অনেক ক্ষেত্রেই আজকের দেশব্যাপী অরাজকতার অন্যতম কারণ এদের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান দূরত্ব।
প্রশাসনের একাংশের মদতে পুষ্ট অরাজকতার ইতিহাস পৃথিবীর সর্বকালে এবং সর্বত্রই আছে। যেমন, গত শতাব্দীর বিশের দশকে আমেরিকায় মাফিয়া-রাজ। শিকাগো শহর থেকে সংক্রামক ব্যাধির মতোই তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। যাবতীয় মাদকসামগ্রীর সিন্ডিকেট, কালোবাজারি, জুয়া, গণিকালয়, বেআইনি সুদ, অস্ত্রপাচার, ব্যবসার রমরমা। মুনাফার টাকায় আইনরক্ষকদের এক অংশ তখন ভেবেচিন্তেই নিশ্চুপ ছিলেন। সে দিন গর্জে উঠেছিলেন এই ত্রিস্তরেরই অন্য অংশের নির্ভীক, ব্যতিক্রমী রাজনীতিক, পুলিশকর্তা এবং বিচারপতিরা। তিন দশকব্যাপী সম্মিলিত অক্লান্ত লড়াইয়ের পরই ফিরে আসে আইনের শাসন ও নাগরিক স্বাধীনতা।
ইতিহাসের শিক্ষা বলে যে, কেবলমাত্র ত্রিস্তরের মধ্যেকার বিবেকবান, উন্নতশির মানুষদের দুষ্টদমনের দৃঢ়তা এবং সঙ্কল্পই পারে অন্য অংশের উঞ্ছবৃত্তিকে সমূলে উৎপাটন করতে। বাস্তুঘুঘু ভাঙার এই লড়াই এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেই কারণেই, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে আপাতত স্থগিত করতে সরকারকে বাধ্য করার মধ্যে আশার ঝলকানি দৃশ্যমান।
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যাম
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy