মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পালা শেষ— প্রতি বছরের মতো এ বারেও ‘এত নম্বর কেন’ মর্মে কিঞ্চিৎ তর্কবিতর্ক হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোর উদ্দেশ্য হল ‘যাচাই’ করা— এত দিন পাঠক্রমে যা পড়ানো হয়েছে, শেখানো হয়েছে, ছেলেমেয়েরা তার কতখানি আত্মস্থ করতে পেরেছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে হয়ে গেল বহু দফা অ্যাডমিশন টেস্টও। এই ভর্তির পরীক্ষাগুলির লক্ষ্য হল ‘বাছাই’— বহু পরীক্ষার্থীর মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে বেছে নেওয়া।
ভেবে দেখলে, পরীক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য মোটের উপর দু’রকম। প্রথমটা হল যোগ্যতা যাচাই করা— কেউ কোনও কাজ শিখে সেটা করার বা কোনও বিশেষ পদের যোগ্য কি না, তা স্থির করা। যেমন, ধরা যাক কেউ গাড়ি চালাতে জানে কি না সেটার প্রমাণ মিলবে তার ড্রাইভিং টেস্টের ফলাফলে। এই পরীক্ষায় নম্বর দেওয়ারও প্রয়োজন নেই— পরীক্ষার্থী হয় পাশ করবে, নতুবা ফেল, ব্যস। এ ক্ষেত্রে, অন্যের সঙ্গে তুলনা অথবা বাছাইয়ের কোনও প্রয়োজন নেই। তুমি আমার থেকে বেশি দক্ষ কি না, তাতে কিছু যায় আসে না।
অন্য দিকে থাকবে বাছাইয়ের জন্য পরীক্ষা, যাকে আমরা সচরাচর ‘কম্পিটিটিভ’ পরীক্ষা বলে থাকি। এখানে পাশ-ফেল তো নেই-ই, এমনকি পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থী ঠিক কত নম্বর পেল, তা-ও জানার দরকার নেই। যেমন, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার জন্য যত আসন আছে, কোনও পরীক্ষার্থী তত জনের মধ্যে থাকতে পারলেই তার যথেষ্ট। সে অন্যদের তুলনায় কতটা ভাল বা খারাপ পরীক্ষা দিল, শুধু সেটাই এখানে বিবেচ্য। তবে, এই বাছাই প্রক্রিয়ায় একটা গোলমালের দিকও থাকতে পারে। যে-হেতু একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পরীক্ষার্থীকে বেছে নিতেই হবে, তাই এমনটাও হতে পারে যে, যত জনকে বাছাই করা হল, তাদের মধ্যে শেষ দিকে থাকা কিছু পরীক্ষার্থী— পরীক্ষায় অসফলদের চেয়ে যোগ্যতর হলেও— যথেষ্ট যোগ্য নয়।
যাচাই-বাছাই দুটো কাজই করে, এমনও পরীক্ষা হয় বইকি। কোনও বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে চাইলে প্রার্থীকে ‘অডিশন’ দিতে হবে— সেই পরীক্ষায় এক দিকে দেখা হবে যে, প্রার্থী সেই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য উপযুক্ত কি না; অন্য দিকে এটাও দেখা হবে যে, মোট যত জন প্রার্থী এই ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য অডিশন দিয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে কে। খেলার দলবাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটে— শুধু যোগ্য হলেই চলবে না, অন্যদের চেয়ে যোগ্যতর হতে হবে। বলা বাহুল্য, পরীক্ষা বা ট্রায়াল নেওয়া ছাড়াও বাছাই করার অনেক পদ্ধতি আছে; যেমন, ইন্টারভিউ, যেখানে পরীক্ষার্থীকে সরাসরি সব ব্যাপারে খোলনলচে খুলে বাজিয়ে দেখে নেওয়া হয়।
পৃথিবীর সব দেশের মতোই, আমাদের রাজ্যেও কলেজে এই সব প্রক্রিয়ার সমন্বয়েই ছাত্রছাত্রীদের বেছে নিয়ে ভর্তি করা হয়। শুধুমাত্র টেস্ট বা ইন্টারভিউয়ের ফলের উপর ভিত্তি না করে সঙ্গে দেখা হয় শিক্ষার্থীর উচ্চ মাধ্যমিকের মোট নম্বর এবং শিক্ষার্থী যে বিষয়ে পড়তে চায় সেই বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর। উচ্চ মাধ্যমিক বা অ্যাডমিশন টেস্ট, এই দুই পরীক্ষা যাচাইও বাছাই এই দুটো কাজই করছে। কিন্তু মুশকিল হল, বিপুল জনসংখ্যার চাপেই হয়তো, আমাদের এই পরীক্ষাব্যবস্থা শুধুই বাছাই হয়ে গেছে। এখানেই গলদ— আমাদের সব পরীক্ষাই এখন কেবলই রেস, খেলা: শুধু যোগ্য নয়, জয়ী হতে হবে; তাই, সেই তাগিদে অন্যদের হারাতেই হবে। অগত্যা, কে বেশি নম্বর পাবে, সেটাই একমাত্র চিন্তার।
পরীক্ষাব্যবস্থা তাই এখন কেউ যোগ্য কি না তার বিচার করে না; যোগ্যতমকে খোঁজে। নামী স্কুলগুলিও অভিভাবকদের কাছে এ বছর কত জন স্ট্যান্ড করেছে তারই ফলাও ফিরিস্তি দেয়। শুধু মাধ্যমিক পরীক্ষা নয়, একে অন্যের চেয়ে দড় এ কথা প্রমাণের প্রবণতা আমাদের সমাজে তাই এখন সর্বত্র। আমরা এখন সামান্য কোনও ব্যাধি সারাতেও ‘সবচেয়ে ভাল’ ডাক্তারের খোঁজ করি।
এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার একটা উপায় আছে। বিভিন্ন দেশে পরীক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, তার ভাল দিকগুলো নকল করা যায়। তার সার কথাটি হল, যাচাই এবং বাছাইকে আলাদা ভাবে দেখা। এর দু’টি ধাপ। প্রথমটা হল, কে যোগ্য, তা নির্ধারণ করা। পরীক্ষায় নম্বরের বদলে পশ্চিমি ধারার গ্রেড পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। পাশ-ফেল’এর মতো ‘বাইনারি’ গ্রেড হতে পারে, অথবা কয়েকটা স্তরের মাপকাঠি, যেমন ‘এ’ থেকে ‘এফ’ অথবা ১-১০। দ্বিতীয়ত, যোগ্যতা নির্ধারণ থেকে বাছাই পর্বকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। যোগ্যদের মধ্যে বাছাই করার জন্য লাগবে তুলনামূলক র্যাঙ্কিং, পরিভাষায় যাকে বলে ‘পারসেন্টাইল স্কোর’। বাছাই পদ্ধতি নানাবিধ হতে পারে, কিন্তু তার ফলাফল হিসাবে আমাদের শুধু জানা জরুরি যে, কে কার থেকে কত এগিয়ে।
তবে, মেনে নেওয়া ভাল, আমাদের দেশে বা রাজ্যে এই পদ্ধতি চালু করতে গেলে হোঁচট খেতেই হবে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে তো প্রায় সবাই প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ‘গ্রেড’টুকু পেয়েই বাছাই-পর্বে চলে আসবে, তখন সেই ভিড় সামলাবে কে? অতএব, যত দিন না চাহিদার তুলনায় আসনসংখ্যার জোগান যথেষ্ট হচ্ছে, অথবা ডাক্তারি, বা অর্থশাস্ত্রের মতো কোনও একটি ‘ভাল’ বিষয় নিয়ে পড়ার অত্যুৎসাহ কিঞ্চিৎ স্তিমিত হচ্ছে, তত দিন এই বাছাই ‘রেস’-এর হাত থেকে তো আমাদের মুক্তি নেই।
মুক্তির একটা সমান্তরাল পথ হল পড়ার বিষয়গুলোকে ‘স্ট্রিমলাইন’ না করে আমেরিকার ‘লিবারাল’ কলেজ-ব্যবস্থার মতো মুক্ত করা যেতে পারে। এতে কলেজে কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে ভর্তি হওয়ার চাপ কমবে। মাধ্যমিক স্তর থেকেই নানা বিষয় পড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অঙ্ক, ভাষা, সাহিত্য আবশ্যিক হলেও সবাইকে দশটা বা এগারোটা বিষয় পড়তে হবে না। জীবনবিজ্ঞান বা ইতিহাস-ভূগোলের বদলে, ধরা যাক, কেউ কেউ বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষা, সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়েই মাধ্যমিক স্তর উতরোতে পারবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy