Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Afghanistan War

‘কেঁদে যাব অনন্তকাল ধরে’

আফগানিস্তানে বহু মহিলা-কলম অচিরেই থেমে যায়, নয়তো দেশান্তরি হতে বাধ্য হন তাঁরা।

ঈশিতা ভাদুড়ি
শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:৫৯
Share: Save:

ও আমার হৃদয়! আমি জানি বসন্ত অস্তমান, এবং তার আনন্দও,/ কিন্তু কী ভাবে আমি উড়তে পারি এই উপড়ে-নেওয়া ডানা দিয়ে…

লিখেছেন যিনি, তাঁর নাম নাদিয়া আঞ্জুমান (ছবিতে), এক জন আফগান কবি। ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তালিবানরা যখন হেরাট দখল করে, তখন মেধাবী ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও নাদিয়ার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। শুধু নাদিয়া নয়, শত শত আফগান মেয়ের স্কুলে যাওয়ায় বাধা ছিল তখন। স্কুল পোড়ানো, বিষ খাওয়ানো, মুখে অ্যাসিড নিক্ষেপ থেকে শুরু করে হত্যা, অপহরণ সবই করা হত। কিন্তু সেই অবস্থাতেও নাদিয়ার মতো অনেক মেয়েই সাহসের সঙ্গে লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছেন, সেলাই শিখতে যাওয়ার নাম করে গোপনে তাঁদের শিক্ষা জারি রেখেছিলেন হেরাট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মুহম্মদ আলি রাহিয়াবের তত্ত্বাবধানে। বিষয়টি খুবই বিপজ্জনক ছিল, ধরা পড়লে চরম নির্যাতন, এমনকি ফাঁসিও হতে পারত। তখন মেয়েদের উচ্চৈঃস্বরে হাসা, সশব্দে হেঁটে যাওয়া বা নিজের মনের কথা বলার অধিকার ছিল না। মনের ভাব প্রকাশে নাদিয়ার মতো মেয়েরা কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তালিবানরা ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হলে, ২০০১ সালে মেয়েদের জন্যে শিক্ষাব্যবস্থা পুনরায় স্বীকৃত হলে নাদিয়া আঞ্জুমান হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য-বিভাগে ভর্তি হন। যদিও তিনি বা তাঁর মতো বহু নারী সম্পূর্ণ ভাবে স্বাধীনতা কখনও পাননি।

২০০২ সালে নাদিয়া স্নাতক হন এবং তার পর তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ গুল-এ-দোদি (স্মোকি ফ্লাওয়ার) প্রকাশিত হয়। ফারসির একটি উপভাষা দারি-তে লিখতেন তিনি। এই কবিতা-চর্চায় অধ্যাপক রাহিয়াব নাদিয়াকে বিভিন্ন ভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন, অনেক কবি-লেখকের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁদের কলম নাদিয়াকে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে বিস্তৃত হতে সাহায্য করে। ক্রমশ নাদিয়ার লেখনী স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল, কবিকৃতিতে খুবই প্রতিভাময়ী ছিলেন তিনি, এবং গুল-এ-দোদি ইরান, পাকিস্তান ও আরও অনেক দেশে খ্যাতি লাভ করেছিল। বইটির তিনটি সংস্করণ হয়। তাঁকে আফগানিস্তানের অন্যতম আধুনিক কবি বলে গণ্য করা হয়।

হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ফরিদ আহমেদ মজিদ নেইয়ার সঙ্গে নাদিয়ার বিবাহ হয়েছিল। নেইয়া সাহিত্যে স্নাতক এবং হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য লাইব্রেরিয়ান হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার আলো আসেনি তাঁদের ঘরে। যতই নাদিয়া লেখেন— “ইচ্ছে করে আমি তার সৌন্দর্যের নেশায় নেশাতুর হই,/ অথবা, তার ভালবাসার আগুনে পুড়ে তার হৃদয়ের কর্ত্রী হয়ে উঠি।/ ইচ্ছে করে আমি তার মুখের অলঙ্কারে অশ্রুবিন্দু হই,/ অথবা, তার সুগন্ধিযুক্ত চুলে ঢেউ হই”— ততই তিনি তাঁর স্বামী এবং পরিবারের বিরাগভাজন হয়ে উঠলেন। কারণ, প্রেম ও সৌন্দর্য বিষয়ে কোনও নারীর কবিতা লেখা পরিবারের পক্ষে অবমাননাকর আফগানিস্তানে। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নাদিয়া আঞ্জুমান যখন লেখেন— “ভালবাসায় প্রশ্ন কোরো না, কারণ তোমার অক্ষরবিন্যাসে প্রেরণা সে/ আমার প্রেমময় অক্ষরে মৃত্যু বাস করে”— তখন নাদিয়ার ভাগ্য যে সুপ্রসন্ন হবে, এ কথা তো অভাবনীয়ই। কিন্তু নাদিয়ার কী অপরাধ ছিল? তিনি এক জন নারী? তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন? মেয়েদের কথা বলতে চেয়েছিলেন? তিনি লিখেছিলেন— “কোনও এক দিন ভেঙে ফেলব এই খাঁচা, এর ভয়ানক নির্জনতা/ উল্লাসের নেশায় মত্ত হব আমি, গেয়ে উঠব বসন্তে পাখি গায় যেমন।”

কিন্তু তিনি খাঁচা ভেঙে ফেলতে পারেননি, বসন্তের গান গেয়ে উঠতে পারেননি। তিনি ২০০৬ সালে ইয়েক সাবাদ ডেলহোরেহ (অ্যান অ্যাবান্ডান্স অব ওরি) শিরোনামে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই ২০০৫ সালের ৪ নভেম্বর তাঁর স্বামী কর্তৃক প্রহৃত হন এবং মারা যান ছ’মাসের একটি সন্তানকে রেখে। ২০০৭ সালে ‘দ্য ইরানিয়ান বার্ন্ট বুকস ফাউন্ডেশন’ আঞ্জুমানের সমস্ত রচনা মূল ফারসি-দারি ভাষায় প্রকাশ করে।

শুধুমাত্র নাদিয়া আঞ্জুমান নয়, আফগানিস্তানে বহু মহিলা-কলম অচিরেই থেমে যায়, নয়তো দেশান্তরি হতে বাধ্য হন তাঁরা। লায়লা সারাহাত রুশানি, পারওয়াইন পাঝোয়াক, আয়িস্তা আইয়ুব, জোহরে এসমাইলির মতো অনেক কবি-লেখককেই দেশত্যাগী হতে হয়েছিল। যাঁরা দেশ ছেড়ে যাননি বা যেতে পারেননি, তাঁদের কণ্ঠ অচিরেই থেমে গিয়েছে হত্যায় বা আত্মহত্যায়। যদিও ২০০১-এর পর কিছু সময়ের জন্যে তাঁদের লড়াই তাঁদেরকে স্বাভাবিক যাপনে কিছুটা সাহায্য করেছিল, কিন্তু আজকের আফগানিস্তান তাঁদের এই লড়াইকে আবার অনেক পিছনে নিয়ে গেল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এ যেমন অবস্থা হয়েছিল, ঠিক সেই অবস্থারই পুনরাবৃত্তি। আজ ২০২১-এ আবার আফগান মেয়েরা বোরখার নীচে, অন্ধকার কুঠুরিতে, যৌনদাসী হিসেবেই। যে দেশে স্বগৃহে নারীরা নিরাপদ নন, সেখানে জনপদ কী-ই বা নিরাপত্তা দেবে তাঁদের? যে দেশে বহু সংগ্রামের পরেও নারীদের সামনে শুধুমাত্র অন্ধকার, সেখানে আলো আসবে কোন পথ দিয়ে? কী ভাবেই বা মুক্তি? তাই নাদিয়ার মতো কবিরা লিখেই যান— “আমি এক জন আফগান-কন্যা— আমি কেঁদে যাব অনন্তকাল ধরে…”

অন্য বিষয়গুলি:

Afghanistan War Taliban 2.0
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy