গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তাঁকে চিনি ১৯৯৭ সালের শেষাশেষি থেকে। তখন কর্মসূত্রে আনন্দবাজার পত্রিকার নয়াদিল্লি ব্যুরোয়। কংগ্রেস ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল গড়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন। দিল্লির নির্বাচন কমিশন-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত দৌড়োদৌড়ি। মুকুল রায়ের সঙ্গে যিনি ঘোরতর সক্রিয়, তাঁর নাম জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ডাকনাম বালু। মমতা-নামও বটে।
জ্যোতিপ্রিয় তখন সবে চল্লিশ। টগবগে, আড্ডাবাজ, বৈঠকি এবং রসিক। পরনে খদ্দরের সাদা কুর্তা-পাজামা। সাদা (ক্বচিৎ-কদাচিৎ রঙিনও) কুর্তার ওপরের কিছু বোতাম অবধারিত ভাবে খোলা। পায়ে চামড়ার চপ্পল। তখনও বোধহয় চোখে চশমা ওঠেনি। উচ্চারণে মন্তেশ্বর-জনিত সামান্য ‘স’-এর টান। রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালের উল্টো দিকে সাংসদ মমতার ফ্ল্যাট তখন তৃণমূলের গর্ভগৃহ। আইএনএস বিল্ডিংয়ের অফিস থেকে বেরিয়ে রোজ রাতে সেখানে যেতাম আর দেখতাম, একটু একটু করে কী ভাবে ঘাসফুলের বীজ বপন হচ্ছে। তাতে পরম যত্নে জল-বাতাস দিচ্ছেন বালু-মুকুল (তখন এই ক্রমান্বয়েই বলা হত। কালক্রমে সেটা উল্টে ‘মুকুল-বালু’ হয়ে যায়) জুড়ি। মুকুল বরাবরই খানিক সিরিয়াস। খানিক চিন্তিত। কিছুটা মেপে হাসেন। মেপে বলেন। কিন্তু বালু মমতার ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমের সোফায় অনর্গল। তিরিশ না-ছোঁয়া সাংবাদিককেও বিনাদ্বিধায় ‘গুরু’ বলতেন (প্রথমে অস্বস্তি হত। তার পরে বুঝলাম, সম্বোধনে অত ‘গুরু’ত্ব দেওয়ারও কিছু নেই। ওটা একেবারেই কংগ্রেসি রাজনীতির পরিচিত লব্জ)। তো সেই ‘সোনো না গুরু’ বলে আলাপ শুরু করে বালু বিবিধ দলীয় ‘অ্যানেকডোট’ বলতেন আর একটা মিঠে এবং আন্তরিক হাসি হাসতেন।
মনে হত, তাঁকে ‘বালুদা’ এবং ‘তুমি’ বলা যায়। যত দিন পর্যন্ত কথা হয়েছে, তত দিন তা-ই বলতাম।
তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর থেকে বালু নেত্রীর অন্যতম ‘ম্যান ফ্রাইডে’ হয়ে গেলেন। তাঁর জুড়িদার মুকুল কখনও তেমন ভাবে ভোট লড়ে পরিষদীয় রাজনীতিতে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি ‘জনতার নেতা’ও নন। বরং সংগঠনে অনেক বেশি মনোযোগী। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের নিয়ে তাঁর কারবার। বালু সেখানে একেবারে বিপরীত মেরুর। তাঁর বাস হট্টমেলার দেশে। অপার জনসংযোগ। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তিনি ভোটে জিতে বিধানসভায় যেতে চান।
গেলেনও। ২০০১ সালে উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। এবং মাটির গন্ধ শুঁকে-চলা বালুই প্রথম মমতার মাথায় ঢোকালেন মতুয়া ভোটের কথা। তার আগে পর্যন্ত মতুয়া সম্প্রদায় নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলেরই বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। কালের নিয়মে তাঁরা ছিলেন। তাঁদের অস্তিত্ব ছিল খানিকটা নিরাকার ব্রহ্মের মতো। ধুরন্ধর বালু দলনেত্রী মমতার সম্মতিতে তাঁদের জোটবদ্ধ করে তৃণমূলের দিকে টেনে আনলেন। যার ফল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত একের পর এক ভোটে পেয়ে এসেছে তৃণমূল।
মতুয়া ভোটের পাশাপাশি সংগঠনও হাতে রেখেছিলেন বালু। ২০০১ এবং ২০০৬ সালে বালু গাইঘাটার বিধায়ক। সেই আসন তফসিলি সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় ২০১১ থেকে তিনি আসন বদলে হাবড়ায়। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার রাশ কখনও হাত থেকে যেতে দেননি (২০২১ সালের ভোটের পর থেকে অবশ্য জেলার সংগঠনে তাঁর আর কোনও দাপট নেই। কারণ, তিনি আর সংগঠনের পদাধিকারী নেই)।
২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বালুর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন দেখা হত। বিধানসভা ভবনে। তখন চুটিয়ে তৃণমূল ‘বিট’ করি। স্মৃতিভ্রমও হতে পারে। কিন্তু বালুকে কখনও দীর্ঘ সময় বিধানসভার অধিবেশন কক্ষের ভিতরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিধানসভা চলুক বা না-চলুক, তিনি বসতেন বিরোধী দলনেতার ঘরের দরজার ঠিক সামনে মাঝারি সাইজের একটা ঘরে। আদতে সেটা বিরোধী দলের বিধায়কদের জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু বালু কী করে যেন হলঘরটায় নিজস্ব মালিকানা কায়েম করে ফেলেছিলেন!
যে কারণে খানিকটা ফিচলেমি এবং খানিক আদর করে ঘরটার নাম দিয়েছিলাম ‘বালুরঘাট’।
ঘরের মাঝবরাবর বিশাল একটা টেবিল। দু’পাশে সারি সারি কাঠের চেয়ার। সেই লম্বা টেবিলটার ‘হেড অফ দ্য টেব্ল’-এর জায়গায় আবার একটা টেবিল। সঙ্গে একটা সিংহাসন মার্কা কেদারা। কিন্তু সেই টেবিল বা চেয়ারে বালুকে কোনও দিন বসতে দেখিনি। সেখানে মূলত বসতেন সৌগত রায়। একটা এক্সটেনশন ল্যান্ডলাইন ছিল। অধিবেশন না-চললে সৌগত সেই ফোন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ‘কওন বনেগা ক্রোড়পতি’-তে নাম নথিভুক্ত করার চেষ্টা করতেন। বালুকে সে দিকেও কখনও মনোনিবেশ করতে দেখিনি। তিনি বসতেন একটা কোনার চেয়ারে। সামনে গুচ্ছের কাগজপত্র। বেশির ভাগই হল বিধায়কের লেটারহেড প্যাড।
এক পাশে গাব্দা গাব্দা কাঠের আলমারি। কাকে জপিয়ে পেয়েছিলেন জানি না। কিন্তু সে সব প্রাচীন এবং গ্রাম্ভারি আলমারির চাবিও বালুরই অধিকারে থাকত। তার গহ্বর থেকে দিস্তা দিস্তা ফাইলপত্র, প্যাড, ফর্ম, রবার স্ট্যাম্প বার হত। তত দিনে তাঁর দু’একটি ‘টেনিয়া’ (রাজনীতির চালু ভাষা। নেতাদের আশপাশে ঘুরতে থাকা কিছু উমেদার এবং ফাইফরমাশ খাটার লোকজনকে স্নেহভরে যে নামে ডাকা হয়) জুটেছে। তাঁরা ভক্তিভরে ফর্ম ভরে বা লেটারহেডে চিঠি লিখে, ঘপাঘপ রবার স্ট্যাম্প মেরে বালুকে দিতেন। আর ‘এমএলএ সাহেব’ মাথা নিচু করে একটার পর একটা চিঠিতে সই করে যেতেন। কোনওটা রেলের টিকিট কনফার্ম করার। কোনওটা হাসপাতালে ভর্তির অনুরোধ। কোনওটা তাঁর বিধানসভা এলাকার বাসিন্দাদের জন্য কেজো শংসাপত্র।
বালুর ঘাটে কত যে নৌকা ভিড়ত প্রতিদিন!
তখনই তাঁর রক্তে চিনির মাত্রা বিপদসীমা পেরিয়ে চলে গিয়েছে বহু দূর। রোজ দুপুরে রিপোর্টারদের গজল্লার জন্য দরাজ-হাতে কখনও তিনি, কখনও আব্দুল মান্নান হাই কোর্ট পাড়া থেকে বোমার সাইজের শিঙাড়া এবং গভীর প্যাঁচযুক্ত জিলিপি আনাতেন। সঙ্গে মুড়ি। কিন্তু কখনও নিজে খেতেন না। সুগার নিয়ে অসম্ভব সতর্ক থাকতেন।
প্রশ্ন করতাম, ব্রায়ান লারার রেকর্ড ভাঙতে পারলে?
ক্রিকেটের সঙ্গে হাজার মাইল দূরত্বের বাসিন্দা বালু সবিস্ময়ে তাকাতেন। বলতাম, লারার বিশ্বরেকর্ড তো ৪০০ রানের। তোমার স্কোর এখন কত যাচ্ছে? বালু আবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেন। বলতাম, সুগার কত এখন? ৪০০ পেরোল? পরিচিত শব্দ শুনে বালুর মুখে পরিচিত হাসি ফিরে আসত। কখনও বলতেন, সাড়ে ৩০০। কখনও আড়াইশো। তার পরে নিজেকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলতেন, ‘‘না-না! রোজ সকালে কলেজ স্কোয়ারে হাঁটছি তো।’’ তখনও তিনি থাকতেন কলেজ স্কোয়ারের কাছে নিজের পৈতৃক বাড়িতে। হয়তো সকালে নিয়মিত হাঁটাহাঁটির কারণেই শেষ পর্যন্ত লারাকে টপকাতে হয়নি।
২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বালুরঘাট সরগরম ছিল। দিনের বেলা দেখা তো বটেই, গভীর রাতে ফোনে দেদার আলোচনা হত রাজনীতি নিয়ে। কারণ, কে না জানে, অবামপন্থী দলের রাজনীতিকদের দিন শুরু হয় বেলা করে। শেষ হয় গভীরতম রাতে। সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁদের ‘নোট এক্সচেঞ্জ’-এর সেরা সময় জগৎ ঘুমিয়ে পড়ার পরে।
রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-এর পরে অবশ্য বালুরঘাট গুটিয়ে গেল। বালু মন্ত্রী হলেন। খাদ্য এবং খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রী। তখন তাঁর দফতর মির্জা গালিব স্ট্রিটে। বিধানসভায় আসেন কালেভদ্রে। তা-ও দফতরের বাজেট বা ওই ধরনের কিছু কাজ থাকলে। বন্ধ হয়ে গেল তাঁর রাতের ফোনও। তাঁকে ঘিরে রচিত হল এক জ্যোতির্বলয়। বালুর ঘাট থেকে নোঙর তুলে তিনি রওনা দিলেন ‘জ্যোতিপ্রিয়’ হওয়ার পথে।
ক্ষমতার আঁচ থেকে দূরে থাকতে চাওয়ার সহজাত প্রবৃত্তিতে যোগাযোগটা প্রায় ছিন্নই হয়ে গেল। বহু দিন পরে হঠাৎই এক দিন ‘খাদ্যমন্ত্রী’ বালু ফোন করে বললেন, ‘‘আমার অফিসে চলে এসো। দারুণ চাউমিন খাওয়াব।’’ মনে হল, তিনি আর ফুটপাথের দোকানের শিঙাড়া-জিলিপির কাগজের ঠোঙায় নেই। এখন তিনি ‘এলিট’ চিনে খাবারের বৃত্তে। যাওয়া হয়নি। তার পরে কয়েক বার কাজে-অকাজে ফোন করেছি। ধরেননি। মন্ত্রী তো হাজার হোক। ব্যস্ততাও বেড়েছে বহু গুণ।
সুতোটা ছিঁড়ে গেল। দূর থেকে খবর-টবর পেতাম। ছবিতে দেখতাম, বালুর আঙুলে দামি গ্রহরত্ন সম্বলিত আংটির সংখ্যা বেড়েছে। চোখে রিমলেস ফ্রেমের ফ্যাশনেব্ল চশমা উঠেছে। হাতে খুনখারাবি রঙের মোবাইল। মহা ধুমধামে কন্যার বিবাহ দিয়েছেন বলেও কানে এল। এ-ও কানে এল যে, বিধানসভায় এক নতুন ‘বালুরঘাট’ তৈরি হয়েছে। স্পিকারের ঘরের কাছাকাছি। সেখানে দলের লোকেদের (মূলত উত্তর ২৪ পরগনার) ভিড় লেগে থাকে অষ্টপ্রহর। শুনলাম, সেই ঘরেই এক দিন বেআক্কেলে গোটা কয়েক লেডিকেনি খেয়ে ফেলেছেন। ব্যস, ঝপ করে সুগার বেড়ে কেলেঙ্কারি! উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। মনে হল, এক বার ফোন করি। পরক্ষণেই মনে হল, ‘বালুদা’কে ফোন করা যেত। ‘জ্যোতিপ্রিয়’কে নয়।
দশ বছর হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি। মুখোমুখি তো দূরস্থান, ফোনেও নয়। ছুটকোছাটকা যা সব কানে আসত, তাতে তাঁকে বালুরঘাটের দিনগুলোর সঙ্গে মেলাতে পারতাম না। তাঁর সম্পত্তি নাকি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে! বরুণ বিশ্বাসের খুনের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন নিহতের পরিবার। তিনি কি সত্যিই ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন? বালুরঘাটের কাণ্ডারিকে প্রশ্ন করা যেত। কিন্তু ‘জ্যোতিপ্রিয়’কে নয়।
২০২১ সালে তৃণমূল তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল খাদ্য দফতর থেকে। তুলনায় দেওয়া হল অনেক কম গুরুত্বের বন দফতর। সে কি ওই সমস্ত বিতর্কের জন্য? না কি বিরোধীদের লাগাতার ‘চালচোর’ কটাক্ষের কারণে? বালুরঘাটের কাণ্ডারিকে প্রশ্ন করা যেত। কিন্তু ‘জ্যোতিপ্রিয়’কে নয়।
শুক্রবার আদালতে ইডি হেফাজতের নির্দেশ শুনে যে বালু অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সশব্দে বমি করে ফেললেন, যাঁকে দেখতে বিচারক আসন ছেড়ে নেমে এলেন এবং তার পরে যিনি কন্যার ওড়নায় আবৃত হয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে পরিবারের আস্থাভাজন বেসরকারি হাসপাতালের পথে রওনা হলেন, তাঁকে দেখে মনে পড়ছিল, এই সে দিনও তিনি গলা উঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কে বাকিবুর? আমি ওই নামে কাউকে চিনিই না!’’
মনে পড়ছিল, সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মরত এক জুনিয়র সহকর্মী সম্পর্কে বালুরঘাটে বসে এক দিন চমৎকৃত এবং বিস্মিত মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘কী অসাধারণ একটা ছেলে জয়েন করেছে তোমাদের কাগজে! এক কাপ চা খাওয়ালেও খেতে চায় না! এত অসম্ভব সৎ!’’ মনে পড়ছিল, বালুরঘাটের বালুকে কোনও দিন ‘কওন বনেগা ক্রোড়পতি’ হওয়ার ফোন ঘোরাতে দেখিনি।
দশ বছরের মন্ত্রিত্বের জ্যোতির্বলয় কি সব গোলমাল করে দিল? আলো সরে যাওয়ায় কি প্রতিমার গায়ের রং চটে গিয়ে খড়ের ভঙ্গুর কাঠামো বেরিয়ে পড়ল? যে কাঠামো থেকে ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে মাটির আস্তরণ? বালুরঘাটের কাণ্ডারিকে এই প্রশ্ন করা যেত। কিন্তু ‘জ্যোতিপ্রিয়’কে নয়।
‘বালু’ থেকে ‘জ্যোতিপ্রিয়’ হয়ে যেতে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy