সবিতা, পার্বতী, মিঠু, সাহানা, লক্ষ্মী, রানি, তহমিনা আলাদা আলাদা নাম, কিন্তু চাহিদা বা খিদে সবার এক রকমের। রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও এক। এঁরা প্রত্যেকেই সংসারের চালিকাশক্তি। জীবনের কাছে মার খেতে খেতে এঁদের দেওয়ালে পিঠ, পাল্টা মার দেওয়া একক শক্তিতে সম্ভব নয়। সেটা যেমন বুঝে গিয়েছেন ‘তেরো বছর স্বামী নিরুদ্দেশ’ সবিতা, তেমন ‘দু’-দু’বার টেট লিখিত পরীক্ষায় সফল’ পার্বতী। মৌখিক পরীক্ষায় গিয়ে এই আদিবাসী কন্যার পাশ করা আর হয় না। পাড়ার নেতাকে ধরেছিলেন পার্বতী, সে তিন লাখে রফা করতে বলে। সে ক্ষমতা পার্বতীর নেই। তাই পার্বতী এখন একশো দিনের কাজের মজুরের দলে।
সেই মেয়ে মজুরদের লড়াইটা কেমন? মে দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি সভায় এসেছিলেন বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটার দিনমজুর, বিড়িশ্রমিক মেয়েরা। সবিতা জানান, তাঁরা উনিশ জন ২০১৯ সালে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে একটানা বেশ কিছু দিন কাজ করেন। তবে কাজের আবেদন জমা নেননি বিডিও, তাঁর মুখের কথায় ভরসা করে কাজ করেছিলেন মেয়েরা। বিডিও অফিসের ভিতরের জঙ্গল সাফসুতরো, পুকুর পরিষ্কারের কাজ। “সাঁতার কেটেও পানা পরিষ্কার করেছি,” বললেন সবিতা। কাজ করতে গিয়ে পুরনো ইটের পাঁজায় বিষধর খড়িশের সামনাসামনি হতেও হয়েছে। সে ঝুঁকিও মেনে নিয়েছিলেন মেয়েরা।
কিন্তু আসল ঝুঁকি কোথায়, তা বোঝেননি। ওঁরা জানতেন না বিডিও অফিসের এতগুলো মানুষ, স্বয়ং বিডিও, তাঁদের কাজ করতে দেখেও, টাকা চাইতে গেলে ঘোরাবেন। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করতে করতে বিডিও ট্রান্সফার হয়ে গেলেন, আর নতুন বিডিও এসে কাজের প্রমাণস্বরূপ কাগজ চাইলেন। সেই টাকা আজও মেলেনি। ওঁরা অসংগঠিত শ্রমিক, কিন্তু সংগঠিত মনোবলে সেই ২০১৯-এর প্রাপ্য মজুরির জন্যে এখনও লড়ছেন।
একশো দিনের কাজের যে ছবি গ্রামে গেলে মেলে, তা সংবাদে পাওয়া ছবির থেকে আলাদা। সংবাদে জানা যায়, একশো দিনের কাজ অঢেল। কিন্তু সাহানা, লক্ষ্মীর মতো একশো দিন কাজের প্রকল্পে নিযুক্ত কর্মীরা অন্য কথা বলেন। এত কাজপ্রার্থী, অথচ কাজ খুব কম। অঞ্চল অফিস হেঁটে হেঁটে চটির সুখতলা ক্ষয়ে যায়। যদিও বা কাজ মেলে, তা ড্রেন পরিষ্কার, মাটি কাটার। ঘরকন্নার কাজ, খেতের কাজ, ছাগল-মুরগি পালনের কাজ-করা হাতগুলো এ ধরনের কাজে একেবারে অনভ্যস্ত। ড্রেনে চোখ বুজিয়ে ময়লা তুলতে গিয়ে উঠে আসে ব্যবহার-করা ঋতুস্রাবের প্যাড, কন্ডোম, প্লাস্টিক। স্বামীর বন্ধুর সুবাদে পাড়াতুতো দেওর, ভাশুর দেখে ফেললে বাড়ি গিয়ে পতিদেবতার কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়। দু’চারটে চড়থাপ্পড়ও জোটে। কিন্তু নর্দমা পরিষ্কারের টাকা জব কার্ডে উঠলে সবার প্রথমে স্বামীর নানা রকম ধার দেনার কথা মনে পড়ে যায়। অঞ্চল অফিসেও মিষ্টিমুখ করাতে হয়।
যাঁদের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে এত গলা ফাটান মেয়েরা, বিধায়ক-সাংসদ হওয়ার পরে তাঁরাই এঁদের চিনতে পারেন না। বিডিও অফিসের লোকদের মতো, এই নেতারাও ‘হচ্ছে, হবে’-র দলে চলে যান। তখন তাঁদের বিরুদ্ধে আবার দল বাঁধতে হয়, গলা ফাটাতে হয় মেয়েদের। লক্ষ্মীর পেটে তিনটে অপারেশন। দুটো সিজ়ার, একটা হিস্টেরেক্টমি। তিনি মাটি কাটতে পারেন না তাই কাজ পান না। এ ছাড়া জন্ম থেকে অপুষ্টির কল্যাণে কমবেশি সব মেয়ের আরও অনেক রকম অসুখও আছে— অস্থি ভঙ্গুরতা, অনিয়মিত ঋতু, সাদাস্রাব, সেই সঙ্গে মন খারাপের ক্রনিক অসুখ। এত দুর্বলতা সত্ত্বেও ওঁরা যখন এক সঙ্গে বাংলা মদের ভাটি ভাঙতে যান, পুলিশও সমঝে চলে তখন ওঁদের। ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে রাষ্ট্রশক্তি ভয় পায়। তাই খুব সুচারু ভাবে সব জায়গায় ‘বিভাজনের দ্বারা শাসন’ চলতেই থাকে। আইনে বলা আছে, একশো দিনের কাজ তিন কিলোমিটারের ভিতর দিতে হবে। মুখে মুখে তর্ক করে বলে সবিতারা তিন কিলোমিটার দূরে, অঞ্চলের শেষ সীমানায় কাজ পান। সাইকেল চালাতে সবাই পারেন না, সবার সাইকেল নেইও। গাড়ি ভাড়া দিয়ে একশো দিনের কাজ তাঁদের কী করে পোষাবে! প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, না পোষালে ছেড়ে দাও। হাজার হাজার সবিতা আছে।
প্রশাসনের তরফে যে কথাটি এই মেয়েরা সব চাইতে বেশি শোনেন, তা হল “মানিয়ে নাও।” হ্যাঁ এ দেশের মেয়েরা সব থেকে ভাল এই কাজটি করতে পারেন। ঘরে, বাইরে। সমস্ত অন্যায়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস তাঁদের যেন জন্মগত।তাই সরকারি হুজুরেরা একশো দিনের মজুরির জন্য নির্দিষ্ট টাকা মেয়েদের না নিয়ে, দেরিতে দিয়ে, অতি সামান্য দিয়ে সবিতাদের বলেন, “আরে, একটু মানিয়ে নাও।” মেয়েদের রুক্ষ কপালে দোনামোনা চিন্তার ভাঁজ পড়ে। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে কত আর বিবাদ করা যায়। তখনই শ্রমিকনেত্রী তহমিনা মণ্ডলের তীব্র কণ্ঠ শোনা যায় মেয়েদের সভায়, “কেন স্যর, কেন ম্যাডাম? ব্লক অফিস-অঞ্চল অফিস কি আমাদের শ্বশুরঘর, যে এখানেও মানিয়ে নিতে হবে?” শুনে লক্ষ্মী, পার্বতী, মিঠুরাও বলে ওঠেন, “হক কথা, ব্লক অফিস, অঞ্চল অফিস কি আমাদের শ্বশুরঘর?”
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy