বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘অপরাধ’ হিসাবে গণ্য করা যায় কি না, সে বিষয়ে সম্প্রতি দিল্লি হাই কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ দ্বিখণ্ডিত রায় দিল। যে প্রশ্নটিতে দুই বিচারপতি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি, তা হল, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারার এক্সেপশন টু বা দ্বিতীয় ব্যতিক্রমকে (যেখানে বলা হয়েছে যে, স্ত্রীর অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও কোনও স্বামী যদি তাঁর সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হন, তা ধর্ষণ নয়) অসাংবিধানিক বলা যায় কি না। বিচারপতি রাজীব শকধেরের মতে, এই ছাড়টি সংবিধানের ১৪, ১৯ ও ২১ ধারার মতো অংশে আলোচিত মৌলিক অধিকারের প্রাথমিক ধারণাটির পরিপন্থী। বিচারপতি হরি শঙ্কর এই ছাড়টিকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে অসম্মত, কারণ তাঁর মতে, দণ্ডবিধিতে এই ছাড়টি রাখা হয়েছে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির গায়ে যাতে ধর্ষণের অভিযোগের কলঙ্ক নালাগে, তা নিশ্চিত করতে, এবং প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করতে।
১৮৯১ সালে ফুলমণি নামে ১১ বছর বয়সি এক বালিকার সঙ্গে তার স্বামী হরিমোহন মাইতি বলপূর্বক যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হওয়ায় যৌনাঙ্গে চোট ও প্রবল রক্তক্ষরণে মেয়েটির মৃত্যু ঘটে। ঘটনাটি নিয়ে তখন প্রবল হইচই হয়েছিল। কিন্তু তার ফলে একটাই পরিবর্তন হল— বিবাহিত জীবনে যৌনতায় সম্মতি জানানোর বয়স ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করা হল। তার পর ১৩০ বছর কেটে গিয়েছে; ধর্ষণ বিষয়ে একাধিক আইন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, আইনসভায় পাশ হয়েছে একাধিক সংশোধনী। কিন্তু এখনও আইন সংশোধন করে ৩৭৫ ধারার দ্বিতীয় ব্যতিক্রমটিকে বাদ দেওয়ার, অথবা বিচারবিভাগীয় পদ্ধতিতে এই ব্যতিক্রমটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার কথা উঠলে আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। কারণটা বিচারপতি হরি শঙ্করের কথাতেই আছে— বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করা প্রয়োজন। ঘটনা হল, আইন কমিশনের ৪২তম এবং ১৭২তম রিপোর্টে এই ব্যতিক্রমটিকে বহাল রাখার পক্ষেই মত দেওয়া হয়েছে। চোখে পড়ার মতো একমাত্র ব্যতিক্রম বিচারপতি বর্মা কমিটির রিপোর্ট— ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পর ধর্ষণ আইনের বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য এই কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটির প্রায় সব সুপারিশই গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি বৈবাহিক ধর্ষণকে ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থাটিকে তুলে দেওয়ার সুপারিশটিকে প্রত্যাখ্যান করে।
ভারতীয় দণ্ডবিধিতে বৈবাহিক ধর্ষণকে ছাড় দেওয়ার প্রথাটি ঢুকেছিল ঔপনিবেশিক আমলের ভিক্টোরীয় নৈতিকতার হাত ধরে। দু’টি যুক্তির উপর এই ছাড়ের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল— আইনের ভাষায় যে যুক্তি দু’টির নাম যথাক্রমে কনভার্চার এবং ইমপ্লিসিট কনসেন্ট। ‘কনভার্চার’ কথাটির অর্থ হল, বিবাহ সম্পন্ন হলে স্বামী ও স্ত্রী আইনের চোখে অভিন্ন সত্তায় পরিণত হন— কাজেই, স্বামীর পরিচয় ব্যতিরেকে স্ত্রীর আর স্বতন্ত্র কোনও পরিচয় থাকতে পারে না। এই ধারণাটি দাঁড়িয়ে আছে একটি ভিন্নতর ধারণার উপর— জীবনের প্রতিটি ধাপেই মহিলাদের কারও না কারও দেওয়া নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। কনভার্চারের এই ধারণাটি স্ত্রীকে কার্যত স্বামীর সম্পত্তি হিসাবে দেখে। কাজেই, স্ত্রীর যৌনতাও স্বামীরই সম্পত্তি। অন্য কেউ যাতে সেই সম্পত্তিতে দখল না বসাতে পারে, ধর্ষণ আইন তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু, স্ত্রীর যৌনতার উপর স্বামীর অধিকার সর্বদাই প্রশ্নাতীত! তেমনই, ইমপ্লিসিট কনসেন্ট বা অন্তর্নিহিত সম্মতির তত্ত্ব বলে যে, বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি, যেখানে স্ত্রী স্বেচ্ছায় তাঁর শরীর এবং সত্তার অধিকার স্বামীর হাতে তুলে দেন, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। স্পষ্টতই, এই দুই গোত্রের যুক্তির কোনওটিই স্বামী ও স্ত্রীকে একটি সম্পর্কের সমান অংশীদার হিসাবে দেখে না। মহিলাদের সব সময়েই দুর্বল হিসাবে দেখার যুক্তিটি পরিবর্ধিত হয়ে পৌঁছে যায় ‘স্ত্রী হলেন স্বামীর সম্পত্তি’, এই ধারণাটিতে। এবং, সেখান থেকে কিছু গোলমেলে পূর্বানুমানে পৌঁছে যাওয়া যায়। যেমন, নারীর যৌন এবং শারীরিক স্বাধিকারের প্রশ্নটি নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ভাবে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জুড়ে যায়। ধরে নেওয়া হয় যে, কোনও নারী বিবাহ নামক সম্পর্কটিতে প্রবেশ করেছেন মানেই তিনি তাঁর শরীর ও যৌন পছন্দের স্বাতন্ত্র্য সঁপে দিয়েছেন তাঁর স্বামীর কাছে। বিবাহে আবদ্ধ হলেই স্ত্রী তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্বামীর হাতে তুলে দেন, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এই অবস্থানটিকে তার সাম্প্রতিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিষয়ক রায়ে কঠোর ভাবে নস্যাৎ করেছে ঠিকই, কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণের প্রসঙ্গে এই ধারণাটি এখনও কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে— দিল্লি হাই কোর্টের রায়ের একটি অংশ অন্তত সে কথাই বলে।
ভারতীয় সংবিধানের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, বৈবাহিক অধিকার সংক্রান্ত ব্যতিক্রম ভারতীয় সংবিধানপ্রদত্ত একাধিক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারা আইনের সামনে নাগরিকদের সমতা এবং বৈষম্যহীনতার কথা বলে। সমতা সংক্রান্ত আইন দাঁড়িয়ে আছে দু’টি যুক্তিক্রমের উপর— রিজ়নেব্ল ক্লাসিফিকেশন অ্যাপ্রোচ, এবং ম্যানিফেস্ট আর্বিট্রারিনেস অ্যাপ্রোচ। প্রথমটি বলে যে, রাষ্ট্র তখনই দুই শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে প্রভেদ করতে পারে, যখন এটা প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণ করা যায় যে, এই দুই শ্রেণির মধ্যে বুদ্ধিগ্রাহ্য প্রভেদ রয়েছে, এবং যে কারণে এই শ্রেণিবিভাজন করা হচ্ছে, তার সঙ্গে এই বিভাজনের যুক্তিগ্রাহ্য সম্পর্ক রয়েছে। বৈবাহিক ধর্ষণের প্রশ্নে শ্রেণিবিভাজনের অক্ষটি হল মহিলাদের বৈবাহিক অবস্থান— তিনি বিবাহিত কি না, এই প্রশ্নটি। কোনও মহিলা তাঁর স্বামীর হাতে ধর্ষিতা হলে তাঁকে এক ভাবে দেখা হবে, এবং অন্য কারও হাতে ধর্ষিতা হলে ভিন্ন ভাবে— এই অবস্থানটি যুক্তিহীন, বিচিত্র। কোনও বিভাজন যদি দৃশ্যতই যুক্তিহীন হয়, তবে ম্যানিফেস্ট আর্বিট্রারিনেস অ্যাপ্রোচে তা অবৈধ বিবেচিত হবে। নভতেজ জোহর মামলায় ভিক্টোরীয় নৈতিকতায় ভর করে সমকামিতাকে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ’ বলার বিরুদ্ধে আদালত রায় দিয়েছিল এই যুক্তিক্রমের উপর ভর করেই। জোসেফ শাইন মামলাতেও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্র-নির্ভর যুক্তি খণ্ডিত হয়েছিল এই যুক্তিক্রমেই। নভতেজ জোহর মামলায় বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় কোনও একটি জনগোষ্ঠীকে দুর্বলতর বলে দেগে দেওয়ার, এবং সনাতন লিঙ্গ-ভূমিকার উপর ভর করে তৈরি করা যুক্তিকে কড়া ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারা বাক্স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারের কথা বলে। নালসা মামলায় তার ব্যাখ্যা করে বিচারপতি রাধাকৃষ্ণন বলেন যে, “সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারায় লিঙ্গ-রূপান্তরিত গোষ্ঠীর মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তা, স্বাধিকার এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যে মৌলিক অধিকার স্বীকৃত, সেই অধিকার স্বীকার করতে, এবং তাকে রক্ষা করতে রাষ্ট্র বাধ্য।” একই ভাবে, নভতেজ মামলায় বিচারপতি দীপক মিশ্র এলজিবিটি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের ক্ষেত্রে সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারাকে পাঠ করেছিলেন এ ভাবে: এই ধারা তাঁদের “বাক্স্বাধীনতা, প্রেম বা যৌনতার সঙ্গী নির্বাচন, প্রেম বা যৌনতার প্রকাশ, সম্পর্কের স্বীকৃতি বা অন্য কোনও রকম” অধিকারকে রক্ষা করে।
সংবিধানের ২১ ধারায় দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মৌলিক অধিকার স্বীকৃত। এই ধারাটি মানুষের জীবনে তাঁর আত্মমর্যাদা, স্বনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এবং শরীরের উপর অধিকারের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব স্বীকার করে। ধর্ষণ যার হাতেই ঘটুক না কেন, তাতে এই তিনটি মৌলিক অধিকারের প্রতিটিই ক্ষুণ্ণ হয়, এবং সংবিধানের ২১ ধারা ভারতের নাগরিকদের যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তাকে ব্যাহত করে। তা ছাড়াও, পুত্তাস্বামী মামলায় আমরা দেখেছি, নিজের উপর মানুষের অধিকারের ধারণাটি সংবিধানে অত্যন্ত মৌলিক। বিবাহিত স্ত্রী তাঁর নিজের উপর অধিকারের রাশটি স্বামীর হাতে সমর্পণ করেন, এ ধারণা সংবিধানের চরিত্রবিরোধী।
বৈবাহিক সম্পর্কে ধর্ষণকে যদি অপরাধ হিসাবে গণ্য না করা হয়, তবে তা যে সংবিধানের এই ধারাগুলিকে উল্লঙ্ঘন করে, তা স্পষ্ট। তা ছাড়াও, বৈবাহিক ধর্ষণকে ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য করলে সংবিধানের ২৩ ধারায় স্বীকৃত বাধ্যতামূলক শ্রম ও শোষণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার মৌলিক অধিকারটিও লঙ্ঘিত হয়। ১৯৮২ সালে পিপলস ইউনিয়ন ফর ডেমোক্র্যাটিক রাইটস (পিইউডিআর) বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি ভগবতী স্পষ্ট জানান যে, সংবিধানের এই ধারায় ‘ফোর্সড’ বা ‘বাধ্যতামূলক’ শব্দটিকে পড়তে হবে তার বিস্তৃত অর্থে— “শুধুমাত্র বাহ্যিক বা আইনি বলপ্রয়োগ নয়, আর্থিক পরিস্থিতির কারণে যদি কারও কাছে এই শ্রম বা পরিষেবা দেওয়া ভিন্ন আর কোনও উপায়ান্তর না থাকে, তবে তাকেও বলপূর্বক আদায় করা ‘বাধ্যতামূলক’ শ্রম হিসাবেই গণ্য করতে হবে।” পারিবারিক পরিসরে ক্ষমতার উচ্চাবচতা, এবং অসাম্যের কথা মাথায় রাখলে— বিশেষত যেখানে স্বামীর উপর স্ত্রীর আর্থিক নির্ভরতা স্বামীকে যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র দেয়— সেখানে স্ত্রীর অমতে তাঁর সঙ্গে যৌনতাকে বিচারপতি ভগবতীর সংজ্ঞা অনুসারে বাধ্যতামূলক শ্রম হিসাবে দেখা যেতেই পারে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কোনও ব্যক্তিবিশেষ যদি সংবিধানের ২৩ ধারাকে উল্লঙ্ঘন করেন, তবে সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
যে ছাড় ভারতের সংবিধানের ভিত্তিকে সরাসরি উল্লঙ্ঘন করে, এ বার তা বিদায় হওয়া ভাল।
আইনবিদ্যা বিভাগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy