ভারতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের— নিদেনপক্ষে প্রকৃত সাংবাদিকদের— সম্পর্ক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, মণিপুরে তার উদাহরণ মিলল। দীর্ঘ কয়েক মাসের পরিচিতিভিত্তিক রক্তক্ষয়ী হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়ার তরফে তথ্যসন্ধানী দল গিয়েছিল সে রাজ্যে। সেই দলের তিন প্রতিনিধি ও সংগঠনের সভাপতির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে মণিপুর পুলিশ। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তাঁদের গ্রেফতার করা যায়নি, এটুকুই ভরসা।
গিল্ডের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিলেন নিজেকে সমাজকর্মী হিসাবে পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি। কিন্তু সেই এফআইআর-এর কথা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ। তিনি অভিযোগ করলেন, এডিটরস গিল্ডের সত্যসন্ধান কমিটির রিপোর্ট ‘একপেশে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। বললেন, গিল্ডের দলটি এই সমস্যার জটিলতা, প্রেক্ষাপট ও এই রাজ্যের ইতিহাস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি অভিযোগ করলেন যে, এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়ার সভাপতি সীমা মুস্তাফা এবং বাকি তিন সদস্য সীমা গুহ, ভারত ভূষণ ও সঞ্জয় কপূর ‘দেশবিরোধী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী’।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘দেশবিরোধী’ হওয়ার অভিযোগ কেন, সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে খোঁজ করা ভাল যে, গত ৭ থেকে ১০ অগস্ট মণিপুর সরেজমিন ঘুরে বিভিন্ন মহলে কথা বলে এডিটরস গিল্ড যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে কী বলা হয়েছে? রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতিদাঙ্গার সময়ে প্রশাসন কোনও দায়িত্ব পালন করেনি। বস্তুত, সংঘর্ষের সময় পক্ষপাতিত্ব করেছে রাজ্য প্রশাসন। কোনও সম্প্রদায়ের পক্ষ নেওয়া তাদের উচিত হয়নি। আমলাতন্ত্র ও পুলিশ জাতিগত ভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। মণিপুর মিডিয়াও অত্যন্ত একপেশে রিপোর্ট করেছে। মণিপুরের সংবাদমাধ্যম কার্যত ‘মেইতেই’ হয়ে উঠেছিল। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা একই ভাষা ব্যবহার করে ‘সিলেক্টিভ রিপোর্টিং’ করেছে। এর উপরে আগুনে ঘিয়ের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করার ফলে। এর ফলে হুহু করে নানা গুজব ছড়াতে থাকে। অসম রাইফেলসের বিরুদ্ধেও ক্রমাগত বিষোদ্গার করেছে মিডিয়া। স্রেফ জনতার কথার উপরে ভিত্তি করে রিপোর্ট করা হয়েছে।
এ রিপোর্ট শাসককে অস্বস্তিতে ফেলবেই। এবং, গত দশ বছরে ভারত একটা কথা বুঝে নিয়েছে— শাসকের বিরুদ্ধে যিনি বা যাঁরা প্রশ্নের আঙুল তোলেন, তাঁরা শুধু সেই কারণেই দেশবিরোধী। বেশ কিছু সাংবাদিক তেমনই ‘দেশবিরোধী’— রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুর শিকার। আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস’ (আরএসএফ)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক অনুসারে ২০২৩ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৬১তম, গত বছরের চেয়েও এগারো ধাপ পিছনে। নয়াদিল্লি-ভিত্তিক সংস্থা ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস গ্রুপ’ প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ভারতে সাত মহিলা-সহ মোট ১৯৪ জন সাংবাদিক নানা দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১০৩ জন পুলিশ কিংবা সরকারি এজেন্সির রোষের শিকার। বাকি ৯১ জন অসরকারি, যেমন রাজনৈতিক হিংসা বা সমাজবিরোধীদের হেনস্থার শিকার। যে ১০৩ জন সাংবাদিক সরকারি রোষের শিকার, তাঁদের মধ্যে ৭০ জনকে গ্রেফতার বা আটক করা হয়েছিল। ১৪ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়— দেশদ্রোহিতা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা ছড়ানোয় মদত দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগও আনা হয়। কাশ্মীরের সাংবাদিক তথা লেখক গওহর গিলানি-সহ চার জনকে পুলিশ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়। বাকিরা নানা ভাবে পুলিশ ও প্রশাসনের হাতে শারীরিক নিগ্রহ, হুমকির সামনে পড়েন। কয়েক জনের বিদেশযাত্রা একেবারে শেষ মুহূর্তে অভিবাসন দফতর আটকে দেয়। সাংবাদিক হেনস্থায় পরিসংখ্যানের নিরিখে সব থেকে এগিয়ে কাশ্মীর। সেখানে ৪৮ জন নিগ্রহের শিকার। এর পরে তেলঙ্গানা (৪০)। ষষ্ঠ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ (১১)।
সংবাদমাধ্যমের যে অংশটি সরকারের সামনে নতজানু হতে গররাজি হবে, তার সঙ্গেই এমন বৈর-সম্পর্ক তৈরি করলে তা কি নেতাদের পক্ষেও শেষ অবধি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না? ক্রিস্তফ জাফ্রেলো তাঁর মোদি’জ় ইন্ডিয়া: হিন্দু ন্যাশনালিজ়ম অ্যান্ড দ্য রাইজ় অব এথনিক ডেমোক্র্যাসি বইটিতে লিখেছিলেন, এক দিকে টুইটার (বর্তমানে এক্স), এবং অন্য দিকে রেডিয়োয় মন কি বাত অনুষ্ঠান— এই জোড়া পথে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর সঙ্গে একটি একমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। তিনি যা বলতে চান, যে ভাবে বলতে চান, তা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁর আর মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে প্রয়োজন নেই, নিজের কথা তিনি সরাসরি পৌঁছে দিতে পারেন মানুষের কাছে। ফলে, মূলধারার সংবাদমাধ্যম তাঁর আমলে ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়েছে— সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী হয় বেছে নিয়েছেন এমন কোনও সাংবাদিককে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি যাঁর বিশ্বস্ততা নিয়ে সংশয় নেই; অথবা বেছেছেন কোনও চলচ্চিত্রাভিনেতা বা বিজ্ঞাপন নির্মাতাকে, যাঁরা সামান্য বাঁকা প্রশ্নও করবেন না বলে নিশ্চিত
থাকা যায়।
আশঙ্কা হয়, দেশ জুড়ে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের সামনে এখন বিকল্প মাত্র দু’টি— হয় রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রদর্শন, নয় ‘দেশবিরোধী’ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা। রাষ্ট্রীয় রোষকে সাহসের অভিজ্ঞান হিসাবে সর্বাঙ্গে ধারণ করাই বুঝি এখন সৎ সাংবাদিকদের নিয়তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy