Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Narendra Modi

ভারত আসলে দু’টিই! বীর দাস খুব ভুল কিছু বলে ফেলেননি

আসলে দু’রকমের ভারতবর্ষ সত্যিই বিদ্যমান, ঠিক যেমনটি সম্প্রতি কৌতুকশিল্পী বীর দাস তাঁর নিজের মতো করে বলতে বা বোঝাতে চেয়েছিলেন।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২১ ১০:৪৭
Share: Save:

পঞ্চম জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষার প্রতিবেদনে এই বিষয়টি আবার নতুন করে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, আসলে দু’রকমের ভারতবর্ষ সত্যিই বিদ্যমান। ঠিক যেমনটি সম্প্রতি কৌতুকশিল্পী বীর দাস তাঁর নিজের মতো করে বলতে বা বোঝাতে চেয়েছিলেন।

তামিলনাড়ু যে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে, সেখানে নথিভুক্ত আন্ত্রিক রোগাক্রান্তদের সংখ্যা বিহারের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। তামিলনাড়ুতে শিশুমৃত্যুর হার মাত্র ৪০ শতাংশ এবং প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের হার ৬০ শতাংশ। বিপরীতে বিহারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সে রাজ্যে তামিলনাড়ুর সাপেক্ষে শিক্ষিত মহিলার সংখ্যা মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ, প্রতি ১,০০০ জনে এক জন করে চিকিৎসক বর্তমান। কিন্তু বিহারে শিশুদের বৃদ্ধি এবং বিনষ্টির (পুষ্টিগত নিরিখে) হার তামিলনাড়ুর তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।

এ সব পার্থক্য সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে যে, এই দুই রাজ্য ভারতেরই অংশ। বিশেষ করে যখন বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের সংযোগসম্পন্ন পরিবারের পরিসংখ্যান উঠে আসে (৯৫ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ)। যদি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সম্পন্ন মহিলাদের পরিসংখ্যানের দিকে দেখা যায়, তবে মনে হবে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির তুলনায় ফারাকটি বেশ কম (তামিলনাড়ুতে ৯২ শতাংশ, বিহারে ৭৭ শতাংশ)।

কেউ আশা করতেই পারেন, তামিলনাড়ু যে ভারতবর্ষের মুখচ্ছবি দেখায়, তার পিছনে আরও ঔজ্জ্বল্য বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু উর্বরতার ভিন্নতর অনুপাত তুলে আনলে দেখা যায়, বিহার নামক অঙ্গরাজ্যটিতে এমন এক শ্রেণির মানুষ বাস করেন, যাঁদের সঙ্গে এই ঔজ্জ্বল্য ঠিক খাপ খায় না। তাঁরা যেন এক ভিন্ন ভারতের বাসিন্দা।

‘তামিলনাড়ুর ভারত’-এর মধ্যে পড়তে পারে এ দেশের দক্ষিণ এবং হরিয়ানার মতো পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলি। যেখানে মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় ৩,০০০ আমেরিকান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা)। এই পরিসংখ্যানটি মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়ের থেকে ৭৫ শতাংশ বেশি। ভারতের মাথাপিছু আয় নাইজেরিয়ার তুলনায় সামান্য কম। আলাদা ভাবে দেখলে তামিলনাড়ুর মাথাপিছু আয় ফিলিপিন্সের খুবই কাছাকাছি। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বিহার ভারতের এক-তৃতীয়াংশের ভাগীদার। তাকে নাইজেরিয়ার সঙ্গে এক পংক্তিতে বসানো যেতেই পারে। বিশ্বের ২১৫টি দেশের মধ্যে নাইজেরিয়া মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ২০৪ নম্বর স্থানে রয়েছে এবং বিশ্ব মানবোন্নয়নের তালিকায় প্রায় সর্বনিম্নে। উত্তর প্রদেশকে সম্ভবত নাইজেরিয়ার প্রতিবেশী দেশ মালির সাহেল অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, দু’রকমের ভারতের অস্তিত্ব স্পষ্ট বিদ্যমান। যার একটি আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের সঙ্গে আর অন্যটি ফিলিপিন্সের সঙ্গে সহাবস্থানে বিরাজ করে, তারা বিশ্বের দুই ভিন্ন প্রান্তের অঞ্চল হলেও এ কথা সত্য। অর্থনীতির উন্নয়নের হারের সঙ্গে তুলনা করে কোনও লাভ নেই। কারণ, রাজ্যগুলির উন্নয়নের হার জাতীয় পরিসংখ্যানের চাইতে এক কণাও অধিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু সহজেই দেখা যায় যে, ফিলিপিন্সের তুলনায় ভারতে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সমান সমান। সে ক্ষেত্রে সাহেল অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের তুলনা করা যায় না। সরকারি স্তরে বিনিয়োগ কি এই মাপকাঠিতে সমান? তেমনটা মনে হতে পারে, যে হেতু উত্তর প্রদেশের কিছু পরিকাঠামোগত সরকারি পরিকল্পনা এই মুহূর্তে সংবাদ শিরোনামে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে মাথাপিছু আর্থিক ব্যয়ের পরিমাণ ধনী রাজ্যগুলির তুলনায় বিহারে বেশ কম। এবং দরিদ্রতর রাজ্যগুলির নিজস্ব রাজস্ব-উৎস ধনী রাজ্যগুলির তুলনায় নগণ্য।

এই দুই ভারত কিন্তু কিছুতেই পরস্পরের কাছাকাছি আসে না। যদিও তাদের ভুবনবোধকে প্রায়শই একই রঙে রঞ্জিত হতে দেখা যায়। উত্তর প্রদেশ নজরকাড়া এক্সপ্রেসওয়ে বানাতে সমর্থ এবং দাবি করে যে, জেওয়ারে তারা এশিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দরটি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দিল্লির বর্তমান বিমানবন্দরটিই জেওয়ারের ফেজ ৪-এর যাত্রীসংখ্যা ধারণ করতে সমর্থ। এই বিমানবন্দরের পরিকল্পনা তো কয়েক দশক আগে সম্পন্ন হয়েছিল! তা ছাড়া এশিয়ায় কমপক্ষে আরও পাঁচটি বৃহত্তর বিমানবন্দর বর্তমান। যা-ই হোক, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জেওয়ারের প্রকৃত পশ্চাদভূমির সঙ্গে দেশের রাজধানীর তুলনা চলতে পারে না।

যে পন্থায় এই সব অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলগুলিকে দেশের অধিকতর স্বচ্ছল এলাকার সঙ্গে একাকার করে দেখানো হয়, তার পিছনে রয়েছে পরিযানের একটি বড় ভূমিকা। দেশের একটি বড় অংশের মানুষ যে পূর্ব থেকে পশ্চিমে অন্ন সংস্থানে পরিযায়ী হয়েছিল, এ কথা সেই মুহূর্তেই অনুভূত হয়, যখন দেখা যায় ক্লান্ত পদক্ষেপে হাজার হাজার মানুষ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ফিরে আসছে ২০২০-র কোভিড-লকডাউনের কালে।

হরিয়ানা ‘বহিরাগত’দের কাজ দিতে অস্বীকার করে এ কথা না বুঝেই যে, ভারতের ‘সাহেল’ থেকে আগত জনগণ অনেক কম মজুরিতেই কাজ করতে রাজি। এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে খুব খারাপ পরিবেশে থেকেও তারা কাজ করতে রাজি, যা হরিয়ানার ভূমিপুত্ররা করতে কখনওই রাজি হবেন না। এই ভূমিপুত্ররা অবশ্য হরিয়ানা রাজ্যের স্ফটিক-প্রাসাদের বাসিন্দা। যদিও তাঁদের সেই অনুপাতে শিক্ষার মানটি যথেষ্ট নয়। সেই নিরিখে দেখলে দুই ভারতের পাশাপাশি দু’টি হরিয়ানাও বিদ্যমান। যদি আপনি দু’টি ভারতকে একত্রে দেখেন, তবে দেখা যাবে যে, এখানে তেমন জীবিকা সংস্থানের উপযুক্ত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নেই। এবং সেই কারণেই অধিকতর মাত্রায় কম শিক্ষিত এবং কম স্বাস্থ্যকর বিহার থেকে দলে দলে মানুষ পলায়নের চাইতে অধিক লাভজনক পরিযানকেই বেছে নেবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy