ভারত কি এই সঙ্কটের মোকাবিলা করতে পারবে গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অর্থনীতির ইতিহাসবিদ চার্লস কিন্ডলবার্গার বলেছিলেন, কোনও দেশে আর্থিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে গেলে এক আধিপত্যবাদীর শাসন কায়েম হওয়া প্রয়োজন। তাঁর এই ‘আধিপত্যবাদী স্থিতাবস্থার তত্ত্ব’ পরবর্তী কালে বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এমনকি, অনেক সময়ে অর্থনীতির সীমানা ছাড়িয়েও তা প্রসারিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটেনের অর্থনীতি পতনমুখী হয়ে পড়ে এবং সেই সময় আমেরিকাও বিচ্ছিন্নতার নীতি অনুসরণ করে। বিশ্বের উপর প্রভুত্ব করার কোনও ইচ্ছাই তখন আমেরিকার তরফে দেখা যায়নি। সেই সময় থেকে আমেরিকানরা নিজেদের এবং বিশ্ববাসীকে বলতে থাকে যে, বিগত ৭৫ বছরে বিশ্বব্যবস্থার ছাঁচ তাদেরই নির্মাণ। তাদের এই বক্তব্যে যথেষ্ট সত্যতা ছিল। যদিও বিভিন্ন ঐকমত্য সিদ্ধান্ত থেকে আমেরিকানদের পিছু হঠার কাহিনিটিকে এই প্রচার খানিক ঢাকাচাপা দিয়ে রাখে।
আজ এই ‘আধিপত্য’ বিষয়টিই চ্যালেঞ্জের সামনে। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার বিশৃঙ্খল অবস্থায় ‘সরে আসা’-র বিষয়টিকে কিছু ঘটনাক্রমের পাশাপাশি ফেলে দেখা যেতে পারে। যেমন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তাদের হস্তক্ষেপের ‘হতাশাজনক’ পরিণতি, ২০০৩-এ ইরাকে সাদ্দাম হুসেনকে অপসারণের পরে তাদের দ্বারা সে দেশের ক্ষমতা কাঠামোর অবলোপ, ১৯৭৯-এ ইরানে ইসলামি শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আন্দাজ করতে ব্যর্থতা এবং ১৯৭৫-এ ভিয়েতনামে স্থানীয় বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কৌশলগত ব্যর্থতা ইত্যাদি। এই তালিকায় অবশ্যই যুক্ত আছে ‘আরব বসন্ত’-এর বিষয়টিও।
অথচ বছ পঁচিশেক আগেও বিষয়টি এমন ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে স্বল্প সময় আমেরিকা একা মহাশক্তিধর হিসেবে বিরাজ করার অবকাশ পেয়েছিল, সেই সময় ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ পত্রিকার (ইউএস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত) নিবন্ধগুলিতে নতুন সর্বময় ক্ষমতা হিসেবে আমেরিকার এক প্রকার জয়গান গাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু আজ সেই একই পত্রিকায় অন্য সুর ধ্বনিত। যদিও কিছু লেখক এখনও বলে চলেছেন যে, চিনের শক্তি অতিব্যবহারে দীর্ণ হয়ে পড়বে এবং ২১ শতকও ‘আমেরিকার শতক’ হিসেবে বিবেচিত হবে। তরুণতর বুশ থেকে প্রবীণতর বাইডেন— বিদেশের মাটিতে আমেরিকার কীর্তি সম্পর্কে কোনও ইঙ্গিত দেননি এবং এরই পাশাপাশি চিন আপাতদৃষ্টিতে তার ক্ষমতা ও সম্পদবৃদ্ধিকে পাখির চোখ হিসেবে দেখতে ও দেখাতে সমর্থ হয়েছে।
সুতরাং, পুরনো দৃষ্টান্ত আগের চাইতে কম ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকেরা গণতন্ত্রকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করছেন। বহু দেশের জাতীয় নীতি বিশ্বের কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। চিনের উত্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলিকে নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য করছে বা তাদের দশা দাঁড়াচ্ছে ঠান্ডা লড়াই চলাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডকে যে ভাবে হাতের পুতুলে পরিণত করে তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছিল, ঠিক সেই রকম। বেজিংয়ের প্রতিপত্তি-বলয় মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে রাশিয়া তার আশপাশের অঞ্চলের মধ্যেই নিজেকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এর ফলে আবার পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদি চিন ও রাশিয়ার দাপটে আমেরিকা আরও জমি ছাড়তে বাধ্য হয়, তা হলে ‘একাধিপতি’ হিসেবে তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল নয়। চিন্তাবিদরা ভবিষ্যৎকে সেই ভাবেই দেখতে পাচ্ছেন, যাকে বলা হয় ‘থুকিডিডিসের ফাঁদ’ (প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসবিদ থুকিডিডিস আথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে সংঘটিত পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের ভাষ্যকার)। অর্থাৎ, যখন কোনও প্রতিষ্ঠিত শক্তি (থুকিডিডিসের আমলে স্পার্টা) নতুন কোনও শক্তির উত্থানে (সেই যুগে আথেন্স) সন্ত্রস্ত বোধ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তেমন অবস্থা। একটি হিসেবে চোখ রাখলেই বিষয়টি বোঝা যায়— যুদ্ধের শেষে ১২ থেকে ১৬টি প্রধান শক্তির পক্ষ পরিবর্তনই যুদ্ধের পরিসমাপ্তিকে ডেকে এনেছিল— প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেন এবং রাশিয়া জার্মানির উত্থানে ভয় পেয়েছিল। কিন্তু এটা ভাবা যায়নি যে, যাবতীয় কূটনৈতিক ব্যর্থতার পর সদ্যোত্থিত শক্তি জাপান ১৯০৪ সালে সাহসে ভর করে রাশিয়াকে আক্রমণ করে বসবে। বেজিং নিজেকে এ কথা বোঝাতেই পারে যে, ইতিমধ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, খোলা আকাশের নীচে ঝঞ্ঝাটে জড়ানোর কোনও প্রয়োজনই নেই।
চিনা বাজারের চুম্বকাকর্ষণ এড়ানো খুব সহজ নয়। বেশি সংখ্যক দেশ আমেরিকার সঙ্গে না জড়িয়ে চিনের সঙ্গে অধিক মাত্রায় বাণিজ্য সম্পর্কে জড়াচ্ছে। আমেরিকার অগ্রণী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য আবার চালু করার জন্য আর্জি জানাচ্ছে। ‘কোয়াড’ (কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা বিষয়ক সংলাপ , যা আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত— এই চারটি দেশের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল)-এর অন্তত দু’টি পক্ষের ঘাড়ে ড্রাগনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভূত হচ্ছে। অর্থনৈতিক ভাবে অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক এবং সামরিক, দুই অর্থেই। দীর্ঘকাল হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরে আমেরিকার ‘কোয়াড’-এর নেতৃত্বে অবতীর্ণ হওয়ার পিছনে যে যুক্তিটি কাজ করেছিল, সেটি এই— যেন তেন প্রকারেণ আমেরিকার বন্ধু প্রয়োজন। ‘কোয়াড’-এর অংশীদারিত্বের পিছনে এই বিপন্নতাই কাজ করেছে। অন্য দিকে, সাম্প্রতিক আফগান ঝঞ্ঝার উত্থানের বিষয়ে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, তাঁর দেশ অধিক মাত্রায় নিজের প্রতিরক্ষা নিয়েই ভাবিত। আমেরিকার বিষয়ে ততখানি নয়। যদি আমেরিকার মিত্ররা এই ভাবনার অনুসারী হতে শুরু করে, তা হলে আমেরিকার আধিপত্যের স্বপ্ন দূরপরাহত।
আবার কিন্ডলবার্গারের কথাতেই ফিরে আসা যাক। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পরিবর্তনের সময় কি ‘একাধিপতি’ তার টান-বাঁধনগুলি হারাতে থাকে? এই অস্থির সময়ে তা হলে ভারত কী করে তার পন্থা নির্ধারণ করবে? আসন্ন ঝঞ্ঝাগুলির মোকাবিলার জন্য দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক শক্তি যথেষ্ট তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy