Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Indian Judiciary

মামলা জমছেই, বিচার কবে

২০১৯ সালে কলকাতা হাই কোর্ট তিন মাওবাদী নেতা সুশীল রায়, পতিত পাবন হালদার ও সন্তোষ দেবনাথকে নির্দোষ ঘোষণা করে জেল থেকে মুক্তি দেয়।

ওসমান মল্লিক
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:১৯
Share: Save:

২০২১ সালে দমদম জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বেরিয়েছেন দীপক জইশি। আদালত বলেছে, তিনি নির্দোষ। যে দিন ঢুকেছিলেন জেলে, বয়স ছিল ৩০ বছর। নেপালের এই নাগরিক আজ ৭০ বছরের বৃদ্ধ।

সম্প্রতি আব্দুল গনি, লতিফ ওয়াজা, আলি ভাট, মীর্জা নাসির, রাইজ বেগকে রাজস্থান হাই কোর্ট বেকসুর খালাস দিল। তত দিনে একটি বোমা বিস্ফোরণ মামলায় তাঁরা জেলের ভিতরে কাটিয়ে ফেলেছেন প্রায় তেইশ বছর। না মিলেছে জামিন, না পেয়েছেন প্যারোল।

২০১৯ সালে কলকাতা হাই কোর্ট তিন মাওবাদী নেতা সুশীল রায়, পতিত পাবন হালদার ও সন্তোষ দেবনাথকে নির্দোষ ঘোষণা করে জেল থেকে মুক্তি দেয়। তত দিনে তাঁদের ১৪ বছর জেল খাটা হয়ে গিয়েছে, জেলেই সুশীল রায় মারা গিয়েছেন।

এমন উদাহরণের শেষ নেই, আজও দেশের নানা জেল খুঁজলে এমন অনেক বন্দি পাওয়া যাবে যাঁরা জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়ে দিয়েছেন বিচারের প্রত্যাশায়। শুধু ফৌজদারি মামলাই নয়, দেওয়ানি মামলাতেও রায় পেতে বহু পরিবার জেরবার। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে পরম প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিশেষ কোনও পদক্ষেপও চোখে পড়ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোরও এ ব্যাপারে বিশেষ হেলদোল নেই। মামলা চলতে চলতেই সাক্ষ্য-প্রমাণ অনেকটা নষ্ট হয়। সমাজের অর্থশালী ও প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে নানা ভাবে মামলাকে আরও বিলম্বিত করে চলেছেন। কাজটা সহজ বলেই ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়াও বটে, আইন ভাঙতে তাঁরা দ্বিধা করেন না।

ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয় একাধিক বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, দ্রুত বিচার পাওয়াটা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু কী ভাবে সেই অধিকার রক্ষা হবে? ২০১৯ সালে একটি সাক্ষাৎকারে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু বলেন, যদি আর একটিও নতুন মামলা দায়ের না হয় তা হলেও, শুধুমাত্র জমে-থাকা মামলাগুলি নিষ্পত্তি করতেই লেগে যাবে ৩৬০ বছর। ন্যাশনাল জুডিশিয়াল ডেটা গ্রিডের তথ্য থেকে আমরা পাচ্ছি, ভারতের আদালতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা এখন সাড়ে চার কোটিরও বেশি। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে রয়েছে সত্তর হাজার, হাই কোর্টগুলিতে ছাপ্পান্ন লক্ষ, বাদবাকি নিম্ন আদালতগুলিতে। প্রায় দশ কোটি পরিবার এই সব মামলার সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল সংখ্যক মামলার নিষ্পত্তি কবে হবে, কী
ভাবে হবে?

অথচ, বিচারব্যবস্থার কতখানি প্রসার প্রয়োজন, সে হিসাব করতে গেলে কেবল জমে-থাকা মামলার নিরিখে তা চিন্তা করাও যথেষ্ট নয়। আজও ভারতে অধিকাংশ বিবাদের নিষ্পত্তি হয় আদালতের বাইরে। কখনও ক্লাবঘরে বা পাড়ার সালিশি বৈঠকে, কখনও থানায় বা পঞ্চায়েতে। তাতে কতটা ন্যায় মেলে, সে প্রশ্নটা রয়েই যায়। নিম্নবর্ণ বা মহিলাদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব, ধনীর আধিপত্য, রাজনৈতিক দলের প্রভাব, এ সবই যে কাজ করে সালিশিতে, এমন বহু অভিযোগ বার বার উঠেছে। ওই সব বিবাদ যদি আদালতের মধ্যে আসত, তবে সংখ্যাটা যে কোথায় দাঁড়াত তা অনুমান করা দুঃসাধ্য।

আসলে স্বাধীনতার পর এত বছর কেটে গেলেও বিচারবিভাগীয় সংস্কারের কাজটি এগোয়নি। প্রশাসনের কাজ পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত পৌঁছলেও আদালত কিন্তু মহকুমা স্তরে এসেই আটকে গিয়েছে। মাঝে অবশ্য কোনও কোনও রাজ্যে, এমনকি এই রাজ্যেও, আদালতকে ব্লক স্তর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার একটি প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সৎ ছিল না, বিচারবিভাগের সঙ্গে প্রশাসন ও রাজনীতিকে জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই তা বিরোধিতার মুখে পড়ে ও বাতিল হয়। নতুন করে, সততার সঙ্গে ভাবতে হবে, কী ভাবে আদালতকে ব্লক স্তর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়।

বিচারপতির সংখ্যা যে যথেষ্ট নয়, সে সমস্যাটি তবু আলোচিত। জাতীয় আইন কমিশন তার ১২০তম রিপোর্টে এর উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। কী ভাবে দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারপতি নিয়োগ করা যায়, তাও ভাবা চাই। আদালতে কর্মদিবস বাড়ানোর কাজটি এড়িয়ে গেলেও চলবে না ।

ভারতের রাজনীতি, ব্যবসাজগতে দুর্নীতি নিয়ে বহু আলোচনা হয়। কিন্তু দ্রুত বিচার সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই যে বহুলাংশে দুর্নীতি রুখে দিতে পারা যায়, সে কথাটা সামনে আসে না। কোনও নেতা বা তারকার বিচার পাওয়া-না পাওয়াকে কেন্দ্র করে সমাজ মাঝেমধ্যে আলোড়িত হয় বটে, কিন্তু বৃহত্তর জনসাধারণের বিচার পাওয়া-না পাওয়াতে আমরা বড়ই নির্বিকার। বিচারের শ্লথগতি যে আমাদের গণতন্ত্রকে রাজনীতিকদের হাতের ক্রীড়নক করে তুলছে, আমরা তা বোঝার চেষ্টাও করছি না। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী, কোনও রাজনৈতিক দল কেন বিচারব্যবস্থার সংস্কারে আগ্রহী নয়, তার কারণও আমাদেরই খুঁজতে হবে। একটা যুক্তিগ্রাহ্য সীমার মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করার দাবি উঠতে হবে নাগরিক সমাজ থেকেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Judiciary Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy