Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Transgender Rights

সমকামী-বিদ্বেষীর দেশ

সমীক্ষা বলছে যে, ভারতে স্কুলগুলি হল সমকামী-রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে বেশি হেনস্থা হওয়ার জায়গা। আশি শতাংশ ক্ষেত্রে পাশে বসা বন্ধুটিই প্রথমে অবমাননা করতে পারে।

ভাস্কর মজুমদার
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৩ ০৭:২৫
Share: Save:

দিল্লির দশম শ্রেণির এক ছাত্র ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, কারণ সে ‘মেয়েলি’ বলে তার সহপাঠীরা তাকে ক্রমাগত মানসিক অত্যাচার করে চলছিল। শিক্ষকদের কাছে নালিশ করলে অত্যাচারিত ছাত্রটিই তিরস্কৃত হয়। ছাত্রটি তার মাকে সব জানায়। তার মা এ ব্যাপারে শিক্ষকদের কাছে সহযোগিতা প্রার্থনা করলে, তাঁরা বলেন যে ছেলেটি ‘নৌটঙ্কি’ (নাটুকেপনা) করছে, এবং মাকে বলেন এ সব পাত্তা না দিতে। প্রসঙ্গত, ছেলেটির মা নিজেই ওই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন।

ছেলের আত্মহত্যার পর মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ স্কুল অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিশু-সুরক্ষা (পকসো) আইনে এফআইআর দায়ের করলে বিভিন্ন মহল থেকে তা তুলে নেওয়ার চাপ আসতে থাকে। স্কুল থেকে অন্যায় ভাবে চাকরি যায় মায়ের! কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন না। দেড় বছর লড়াইয়ের পরে, গত ১৪ জুলাই পঞ্জাব-হরিয়ানা হাই কোর্ট এই মামলায় পকসো বলবৎ রাখার কথা ঘোষণা করেছে। ছেলেটি হয়তো ফিরবে না, কিন্তু ভারতে আজ প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের প্রতি ঘটে চলা নৃশংসতা-বিরোধী একটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে অপরিসীম।

সমীক্ষা বলছে যে, ভারতে স্কুলগুলি হল সমকামী-রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে বেশি হেনস্থা হওয়ার জায়গা। আশি শতাংশ ক্ষেত্রে পাশে বসা বন্ধুটিই প্রথমে অবমাননা করতে পারে। ভারতে প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে এক জনের এমন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। অন্তত অর্ধেক শিশু অভিযোগ করে না, কারণ তারা মনে করে যে, মেয়েলি হওয়ার জন্য তাদের প্রতি দুর্ব্যবহারই স্বাভাবিক।

প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার বিষয়টি ভারতে লোকে দেখেও দেখে না, জেনেও এড়িয়ে যায়। চোখের সামনে যা উপস্থিত, তাকে দূরে সরিয়ে রাখে অস্বস্তিতে, ভয়ে। সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা মানসিক অসুস্থতা নয়, জীবনের কোনও অস্থায়ী পর্যায় নয়, বিদেশ থেকে আমদানি করা কোনও ধারণাও নয়। সমকামিতা মানুষের সহজাত যৌন প্রবৃত্তি, এবং রূপান্তরকামিতা এক লিঙ্গ থেকে অন্য লিঙ্গে বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়া। রূপান্তরকামিতায় অনেক সময় চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য লাগে বলে অনেকে সেই প্রক্রিয়াকে ‘খোদার উপর খোদকারি’ বলেন, অথচ ভুলে যান খোদার উপর খোদকারি না করলে মানুষ নদীতে বাঁধ দিতে পারত না, চাঁদে যান পাঠাতে পারত না, সম্ভব হত না অস্ত্রোপচারে জীবনরক্ষা।

২০১৮ সালে ৩৭৭ ধারা বিলোপ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে আদালত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিল গণমাধ্যমের সাহায্যে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের সমাজে ‘দৃশ্যমানতা’ (ভিজ়িবিলিটি) বৃদ্ধি করতে। সেই নির্দেশের পালন হয়নি বললেই চলে। আশি-নব্বইয়ের দশকে ভারতে সমকামী পুরুষেরা বিভিন্ন ক্লাব, সিনেমা হল, পার্ক এমনকি পাবলিক টয়লেটেও একে অপরকে খুঁজে নিতে বাধ্য হত, সামাজিক অবমাননার জন্য। এক দশক আগে দেশে নানা রকম অ্যাপ এল, যেগুলি সমকামী, উভকামী বা বিসমকামী মানুষদের মধ্যে সংযোগ অনেক সহজ করে দিল। এই সব অ্যাপকে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল মুক্তির টাটকা বাতাস। নিজস্ব যৌন-বৈশিষ্ট্য গোপন রেখে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার উপায় মিলল। এমন একটি বিশেষ অ্যাপ ব্যবহারে সারা বিশ্বে ভারত দ্বিতীয়, ব্রাজ়িলের পরেই। অতএব, ধরে নেওয়া যায় এর ব্যবহারকারীদের মধ্যে বহু উভকামী, অন্তরালে থাকা সমকামী, বিসমকামীরা আছেন। অবশ্যই এমন মানুষও আছেন যাঁরা তাঁদের যৌনতা নিয়ে স্পষ্ট অবস্থানে নেই।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই অ্যাপেরই মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শহরে অগণিত মানুষ লুট হচ্ছেন। সামাজিক অবমাননার ভয়, সমকাম-বিদ্বেষের জন্য অ্যাপ-ব্যবহারকারীরা গোপনীয়তা বজায় রাখতে বাধ্য হবেন, সেই সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির দুষ্কৃতী এই লুণ্ঠন চালাচ্ছে। দিল্লি, চণ্ডীগড়, ফরিদাবাদ, মুম্বইয়ে তো বটেই, কলকাতাতেও এমন একটি দল কিছু দিন আগে ধরা পড়েছিল। এরা অ্যাপ-এর মাধ্যমে বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে, গোপন ছবি ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করেছে। এই সব অপরাধ বেশির ভাগ সময়ই নথিভুক্ত হচ্ছে না, কারণ রাহাজানির শিকার মানুষগুলো পুলিশের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁরা জানেন, সমকাম-বিদ্বেষী সমাজে তাঁদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। কেন্দ্র রাজ্য, কোনও সরকারই এই সংগঠিত অপরাধের দিকে দৃকপাত করছে না। সচেতন করার দায় নিতেও নারাজ।

চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবলীনার সাম্প্রতিক ছবি গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি-র বিষয় ভারতে সমকামী-বিবাহ। ওড়িশার রাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পর কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে কয়েক ঘণ্টার নোটিসে এর প্রদর্শন ও আলোচনা বন্ধ হল। অথচ, প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতা, এবং সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা সম্বন্ধে সর্বাগ্রে আলোচনা হওয়া উচিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই। কোন শিক্ষা আমাদের সমকাম-বিদ্বেষী করে তুলছে, তা ভাবা দরকার। যে কলকাতায় দেশের প্রথম ‘প্রাইড প্যারেড’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে প্রান্তিক যৌনতা বিষয়ক ছবির প্রদর্শন এবং আলোচনা বন্ধ করা হচ্ছে, এটা বিস্মিত, ব্যথিত না করে পারে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Transgender Rights India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy