Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Vegetables

শিম-পটলের বিদেশযাত্রা

কিন্তু গত চার-পাঁচ বছরে রাজ্য থেকে তাজা আনাজের রফতানি অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। এটা কেবল অতিমারির ফল নয়।

অঙ্কুশ সাহা
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২২ ০৪:৩৬
Share: Save:

অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে প্রকাশিত হল কৃষিজ পণ্য রফতানি নীতি। ২০১৮ থেকে এই নীতি প্রণয়নের কাজ চলছিল। রাজ্যের ফল ও আনাজের রফতানিকারী ব্যবসায়ীরা বহু বছর অপেক্ষায় ছিলেন যে, কবে রাজ্য সরকার এমন একটি নীতি প্রকাশ করে। এ বিষয়ে তাঁদের সংগঠনও ক্রমাগত সরকারের সঙ্গে বার্তালাপ চালিয়ে গিয়েছে। আক্ষেপ, রাজ্যের বণিকসভাগুলির থেকে এ ব্যাপারে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।

অথচ, এই নীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও দ্বিমত ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ আনাজ উৎপাদনে দেশের মধ্যে প্রথম। কিন্তু, রফতানির বিশেষ সুবিধা না থাকায় যখন এক সঙ্গে প্রচুর আনাজ ওঠে, তখন তা ক্রেতার অভাবে জলের দরে বিক্রি হয়, বা নষ্ট হয়। নীতি আয়োগের হিসাবে (২০১৮), ভারতে প্রতি বছর চুয়াল্লিশ হাজার কোটি টাকার ফল, আনাজ (উৎপাদনের প্রায় চল্লিশ শতাংশ) নষ্ট হয়। বাজার চাঙ্গা রাখা, চাষির লাভ নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়, বিদেশে ফল-আনাজ রফতানি। বার বার দেখা গিয়েছে, বিদেশের বাজারে যে আনাজ নিয়মিত পাঠানো হয়, দেশের বাজারে তার দাম পড়ে না। রফতানি বাড়ালে রাজ্যের চাষির রোজগার বাড়বে।

কিন্তু গত চার-পাঁচ বছরে রাজ্য থেকে তাজা আনাজের রফতানি অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। এটা কেবল অতিমারির ফল নয়। অন্যান্য রাজ্যে আনাজ রফতানির হাল এমন করুণ নয়। অপ্রতুল বিমান পরিষেবা, বিমান থাকলেও বিমানে জায়গা না পাওয়া, সর্বোপরি বিমানের ভাড়ায় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি, এগুলোও কারণ। এখন অতিমারির প্রকোপ কমেছে, যাত্রিবাহী বিমান চলাচল করছে, তা সত্ত্বেও বিমান সংস্থাগুলি আড়াই থেকে তিনগুণ ভাড়া নিচ্ছে। এতে রফতানির অত্যন্ত ক্ষতি হয়েছে।

এ ছাড়াও রয়েছে এ রাজ্যের কিছু মৌলিক সমস্যা। কেন্দ্রীয় সরকারের রফতানি বৃদ্ধির এজেন্সি যেমন ‘অ্যাপেডা,’ কেন্দ্রের বাণিজ্য মন্ত্রক ও কৃষি মন্ত্রক, রিজিয়োনাল প্লান্ট কোয়রান্টাইন অফিস, রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে যৌথ ভাবে কাজ করে না। ফাঁক থাকছে রাজ্য সরকারের উদ্যোগেও— কৃষিজ পণ্য রফতানির আগে তার গুণমান তথা নিরাপত্তার শংসাপত্র বা ‘ফাইটো সার্টিফিকেট’ প্রয়োজন। মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ-সহ নানা রাজ্যে রফতানিকারীরা সেখানকার রাজ্য সরকারের কাছেই ওই সার্টিফিকেট পান। এখানেও রাজ্য সরকার ইচ্ছা করলেই তা দিতে পারে, কিন্তু দেয় না। ব্যবসায়ীরা বাধ্য হন কেন্দ্রীয় এজেন্সি থেকেই সেই সার্টিফিকেট নিতে। সেখানে অনেক সমস্যা হয়। অ্যাপেডা-র তরফ থেকেও পশ্চিমবঙ্গের রফতানিকারীরা অতটা সহযোগিতা পান না, যতটা মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাই বা অন্যান্য জায়গার ব্যবসায়ীরা পান। সেই সমস্যা কলকাতার দফতরকে বার বার জানিয়েও সুরাহা হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু নীতির ফলে আমাদের রাজ্যের আলুও বিদেশে যথেষ্ট রফতানি হয় না।

সমস্যা রয়েছে পরিকাঠামো নিয়েও। উন্নত কারিগরি পরিকাঠামো-সহ যথেষ্ট প্যাকহাউস, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ইউনিট প্রয়োজন, যা এখনও আমাদের রাজ্যে নেই। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বর্জন করে, জৈব উপাদানে চাষ করার প্রশিক্ষণও চাষিকে দেওয়া দরকার। রাজ্য সরকার রফতানি নীতিতে দেখিয়েছে, ভারত থেকে রফতানি হয় যত কৃষিপণ্য, তার এগারো শতাংশ পশ্চিমবঙ্গের। বস্তুত ওই সব ফসলের সবটা এ রাজ্যের নয়। বাংলাদেশে প্রতি দিন প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ, আঙুর, আদা, রসুন, নানা ফল রফতানি হয়, যেগুলি এই রাজ্যের রফতানি বলে সরকারি নথিপত্রে দেখানো হয়। আসলে এই ফসলগুলির ৯৫ শতাংশই আমাদের রাজ্যে উৎপন্ন হয় না, আশেপাশের রাজ্য থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে রফতানি হয়। এ রাজ্যের কৃষকেরা তাতে উপকৃত হন না।

আমাদের রাজ্যের কোনও কৃষিজ পণ্যই আজ পর্যন্ত বিশ্বের দরবারে সে ভাবে তুলে ধরা হয়নি। মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, গুজরাত, ত্রিপুরা, কেরলের মতো রাজ্যের বিভিন্ন ফসলের জন্য বিশ্বের দরবারে কেন্দ্রীয় সরকার প্রচার করে। পশ্চিমবঙ্গই যেন ব্রাত্য রয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেও বিশেষ ভাবে বঞ্চিত উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা। বহু তদবিরেও বাগডোগরা বিমানবন্দর আজ পর্যন্ত রফতানির জন্য তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি।

আশার কথা, কৃষিজ পণ্য রফতানি নীতিতে এই সমস্যাগুলিকে সরকার স্বীকার করেছে; কোন ফসল রফতানি লাভজনক হতে পারে, তার তালিকা তৈরি করেছে; এবং সহজে সার্টিফিকেট দান করার ব্যবস্থার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়েছে। রফতানির উপযোগী ‘ক্লাস্টার’ সারা রাজ্যে তৈরি করার লক্ষ্যও রাখা হয়েছে। মুখ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটিও তৈরি হয়েছে নীতি রূপায়ণের জন্য। চাষি ও ব্যবসায়ীদের আশা, এই কমিটি নামেই থেকে না গিয়ে, কাজ করে দেখাবে। এ রাজ্যের আনাজ ও ফল নিয়মিত রফতানি হলে লক্ষাধিক চাষি ও নানা স্তরের কর্মীর রোজগার বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থানও হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Vegetables Export
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy