Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
বাংলার বিজেপি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কোনও মাথাব্যথা নেই
BJP

বেড়াল, ঘণ্টা এবং...

এক বছরের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট। তার পরের বছরেই লোকসভা নির্বাচন। এই আবহে বাংলায় বিজেপির নড়বড়ে অবস্থা প্রকট হচ্ছে।

‘মার্গদর্শন’: বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার কলকাতা সফরকালীন বৈঠক, মঞ্চে উপস্থিত শুভেন্দু অধিকারী-সহ অন্যরা, ৮ জুন। পিটিআই

‘মার্গদর্শন’: বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার কলকাতা সফরকালীন বৈঠক, মঞ্চে উপস্থিত শুভেন্দু অধিকারী-সহ অন্যরা, ৮ জুন। পিটিআই

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২২ ০৪:৪৮
Share: Save:

বা‌ংলার রাজনীতি এখন এক অদ্ভুত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। নানা কারণে সরকার ও শাসক দলের পক্ষে সময়টি পীড়াজনক। কিন্তু একই সঙ্গে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের টালমাটাল অবস্থাও লক্ষণীয়। এক বছরের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট। তার পরের বছরেই লোকসভা নির্বাচন। এই আবহে বাংলায় বিজেপির নড়বড়ে অবস্থা যে ভাবে প্রকট হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিরোধী শিবিরের মুখচ্ছবি কী দাঁড়াতে পারে, সেটিও ক্রমশ পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ ও চর্চার বিষয় হয়ে পড়ছে।

একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ, আইন-আদালত, সিবিআই তদন্ত, নেতা-মন্ত্রীদের ঘন ঘন জেরায় ডাকা ইত্যাদি হতে থাকলে কোনও শাসকের কাছেই তা স্বস্তিকর হতে পারে না। তৃণমূল সেখানে কোনও ব্যতিক্রম নয়। কারণ রাজনৈতিক মোকাবিলা এবং আইনি প্রক্রিয়ার বাইরেও কিছু কিছু বিষয়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। যেটা এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই আপাতত এগুলি সরকার ও শাসকের কাছে বিশেষ চাপের।

কিন্তু বিরোধী দলের ক্ষেত্রে তো তা নয়। তাদের সমস্যা তৈরি হয়েছে দলের ভিতর থেকেই। সেখানে বিরোধ যেমন বেআব্রু, তেমনই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে এই রাজ্যের বিষয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিরাসক্ত মনোভাব। রাজ্য-দলে ভাঙন রেখাও খুব একটা অস্পষ্ট নয়। তাই আমরা দেখতে পেয়েছি, এক বছর আগেও বিজেপির যে সব কেষ্টবিষ্টু এখানে ক্ষমতা দখলের আস্ফালন করতেন, নির্বাচনে ব্যর্থতার পরে গত এক বছরে তাঁদের কেউ এ দিকে কার্যত পা বাড়াননি।

যত দূর জানি, বাংলায় বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাবে বসে ওই বিপর্যয়ের বিশদ বিশ্লেষণ পর্যন্ত করেননি। যেটুকু যা হয়েছে, তা বিচ্ছিন্ন ভাবে কথাবার্তার ফাঁকে।

তবে সম্প্রতি রাজ্যে পর পর ঘুরে গেলেন অমিত শাহ এবং জে পি নড্ডা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহের মূল কর্মসূচি অবশ্য ছিল সরকারি। তারই মধ্যে দলের কয়েক জন নেতার সঙ্গে সামান্য বৈঠক। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি নড্ডা এসেছিলেন পুরোপুরি সাংগঠনিক সফরে। দলের লোকেদের সঙ্গে বৈঠকে বসে তাঁরা দু’জনেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে গিয়েছেন। যেগুলি যুগপৎ ‘আত্মোপলব্ধি’র এবং হতাশার! তাঁদের উভয়ের বক্তব্যের সারমর্ম হল, বিজেপি এখনও এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করতে পারেনি। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় পৌঁছতে তাই দলকে এ বার দ্রুত পথে নামতে হবে।

ভোটে জিতে আসার দিন থেকে মমতাকে ‘জব্দ’ করার হাতিয়ার হিসেবে রাজ্যে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের অপেক্ষায় যাঁরা প্রহর গুনেছেন, সেই দলীয় নেতাদের শাহ পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার কোনও শর্টকাট নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিরলস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন বলেই আজ ক্ষমতায় পৌঁছেছেন। বিজেপি তা পারছে না। প্রায় একই সুরে নড্ডাও বলে গিয়েছেন, শুধু ‘সন্ত্রাস’ বলে কাঁদলে চলবে না। দল হেরে গেলে আঘাত আসবেই। সেটা মেনে নিয়ে তার মোকাবিলা করতে পারা চাই।

এ সব কি সত্যিই তাঁদের ‘বিলম্বিত বোধোদয়’? না কি, নির্বাচনী বিপর্যয়ের দায় দিল্লির থেকে রাজ্যের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়ার জন্য এগুলি এক প্রকার কুশলী চাল? যাতে তত্ত্বের মোড়কে বাস্তব ঢাকা পড়ে যায়!

উদ্দেশ্য যা-ই হোক, এটা ঘটনা যে, রাজ্য বিজেপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে হতাশার বীজ লুকিয়ে রয়েছে এই জায়গায়। এবং তারই কারণে সর্বোচ্চ স্তরের দুই নেতার ‘নীতিপাঠ’ সত্ত্বেও দলের অন্দরে ক্ষোভের আঁচ বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ আজ স্পষ্ট।

এরই প্রেক্ষাপটে রয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলটির বর্তমান দিশাহারা অবস্থার উৎস। আসলে বেড়াল এবং ঘণ্টা দেখিয়ে দিলেই কাজ ফুরোয় না। বেড়ালের গলায় সেই ঘণ্টা বাঁধার প্রক্রিয়াটি দক্ষতার সঙ্গে সমাধা করাই হল মূল। আর সেখানে বাংলার বিজেপি ডাহা ফেল! কেন্দ্রও উদাসীন।

রাজ্যে শাসক তৃণমূলকে গদিছাড়া করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কী ভাবে লেজেগোবরে হতে হয়েছে, নতুন করে তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। এটাও বলতে হবে, ২০১৯-এর লোকসভায় বিজেপির কাছে এক ধাক্কায় আঠারোটি আসন হারানো যেমন তৃণমূলের সব হিসাবের বাইরে ছিল, তেমনই এ বার বিধানসভা ভোটে মাত্র সাতাত্তর আসনে খাতা বন্ধ হয়ে যাবে, এতটা ‘দুর্যোগ’ বিজেপিও আশঙ্কা করেনি।

অজানা বা অভিনব কোনও তথ্য না হলেও কিছু বিষয় ঝালিয়ে নেওয়া এখানে প্রাসঙ্গিক। বাংলায় ভোটের আগে শাসক তৃণমূলে বড় ভাঙন ধরিয়ে বিজেপি নিজেদের ঘর ভরেছিল। হেরে যাওয়ার পরে উল্টো স্রোতে ঘর খালিও হয়ে গেল দ্রুত। সেই থেকে তারা অন্তঃকলহে খানখান হচ্ছে! কেন?

কথায় বলে, যুদ্ধ জয়ের জন্য ‘অন্যায্য’ বলে কিছু হয় না। ভোটের আগে দল ভাঙিয়ে নিজেদের ঘর ভরার স্রোতকে স্বয়ং শাহের নেতৃত্বে আগল খুলে ডেকে আনা হয়েছিল। সেই সময় বিজেপির শীর্ষস্তরের ‘মার্গদর্শন’ ছিল— এখন বাছবিচারের দরকার নেই।

দল ভাঙানোর রাজনীতি নতুন নয়। কিন্তু ভোটের আগে তৃণমূল থেকে ভাঙিয়ে এনে যে ভাবে এক-এক জনকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ করে তোলা হয়েছিল, তা নিয়ে বিজেপির মতো সংগঠনবদ্ধ এবং ‘অনুশাসিত’ দলে পুরনোদের মধ্যে প্রশ্ন ও ক্ষোভ ছিল স্বাভাবিক।

তখন থেকেই দলের ভিতরে আদি ও নব্য বিজেপিদের আড়াআড়ি বিভাজন দানা বাঁধতে থাকে। এমনকি তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যে এ ভাবে ‘লক গেট’ খুলে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না, সেটাও আজ আর গোপন নেই। যদিও ভোটের লাগাম তখন ছিল কেন্দ্রীয় বিজেপির হাতে। রাজ্যের বিজেপি কার্যত সুতোয় বাঁধা পুতুল হয়ে নেচেছে।

অন্য দিকে, বিরুদ্ধবাদীরাও তখন ভোটের ফল সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না বলে একটি জায়গায় থেমে গিয়েছিলেন। বিরোধ তাই চাপা ছিল। হারের পরে তাঁরা মুখ খুলতেই ভিতরের হাড়গোড় বেরিয়ে পড়েছে। বিক্ষোভও হচ্ছে প্রায়ই।

গত এক বছর ধরে রাজ্য দলের ভিতরকার পরিস্থিতি এ ভাবে ঘোরালো হয়ে ওঠার পিছনে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকা তাই অস্বীকার করা যায় না। নিজেদের কৃতকর্মের ‘ভুল’ স্বীকার বা সংশোধনের চেষ্টা না করে তাঁরা কার্যত সমালোচকদের ‘দাবিয়ে’ রাখার পথ নিয়েছেন। দিলীপ ঘোষদের মতো অনেকে বস্তুত ‘একঘরে’ বলা যেতে পারে। দলের রাশ দেওয়া হয়েছে তাঁদের হাতে, যাঁদের কেউ নবাগত, কারও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা কম, কয়েক জনের আবার সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে স‌ংযোগের ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়েছে।

সব মিলিয়ে ফল হয়েছে এই যে, রাজ্য দলের কর্মসূচিতে ‘প্রত্যাশিত’ সাড়া মেলে না। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির অবয়ব থেকে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ছাপ মুছে ফেলা অসম্ভব, জনগণও তা বিশ্বাস করবে না। ওই রাজনীতির ভাল-মন্দ নিয়েও আলাদা করে আলোচনায় যেতে চাই না। শুধু এটা বলব, তিন দিন আগে মেয়ো রোডে বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের ডাকা ধর্না-কর্মসূচির মঞ্চে তাঁদের দলের নেতাদের উপস্থিতির যে ছবি ধরা পড়েছে, তা কি রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানকে কোনও ভাবে ‘মহিমান্বিত’ করে?

কথাগুলি বলার কারণ হল, পথের রাজনীতি করার জন্য সাংগঠনিক দক্ষতা দরকার। বাংলার বিজেপিতে এখন সেটারই সবচেয়ে বড় অভাব। কথায় কথায় রাজভবন, সিবিআই বা আদালতের ‘আশ্রয়’ খোঁজা সেই ব্যর্থতাকে আড়াল করার শোচনীয় পন্থা মাত্র। তাতে আখেরে লাভ হবে— এটা ভাবা শুধুই মূর্খামি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

BJP West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy