গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
জানুয়ারি মাস এলেই মনে হয় কেন্দ্রীয় বাজেট দরজায় কড়া নাড়ছে। অন্যান্য ব্যাপারের মতোই মনে হয় এ ক্ষেত্রেও গুরুত্বহীন বিষয়ের কোলাহলে কান না দিয়ে যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
প্রথমেই যদি সরকারি ঋণের কথা ধরি, অতিমারির প্রেক্ষিতে যা কার্যত বাড়তে বাড়তে এক বিপুল ঘাটতিতে গিয়ে ঠেকেছে। রাজস্বহানির সময়ে এমন খরচ অবশ্যই এড়িয়ে যাওয়া যেত না এবং এই খরচ তেমন আহামরিও কিছু ছিল না। তবুও এর ফলাফল আমাদের সঙ্গে থেকেই গিয়েছে। সরকারি ঋণ (কেন্দ্র এবং রাজ্য মিলিয়ে) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তুলনা করতে বসলে দেখা যায়, প্রাক-অতিমারি পর্বে তা যথাক্রমে ছিল ৭০ শতাংশ এবং ৬০ শতাংশ। যাকে খুব মারাত্মক বলা চলে না।
এর ফলাফল হল সুদের বোঝার বৃদ্ধি। প্রাক-অতিমারি পর্বে যা ছিল সরকারি আয়ের (নতুন ঋণ ব্যতিরেকে) ৩৪.৮ শতাংশ। এক দশক আগে ২০১১-’১২ পর্বে যা ছিল ৩৪.৬ শতাংশ। এমন অবস্থাকে মোটামুটি অপরিবর্তিতই বলা যায়। কিন্তু চলতি বছরে বাজেটের ঋণখাতে বরাদ্দ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৪০.৯ শতাংশে। যদি এই অনুপাত ৩৪.৮ শতাংশেই থাকত, তবে সরকারের ১২ হাজার কোটি টাকা বাঁচত অথবা ওই টাকা বিভিন্ন খাতে ব্যয় করা যেত। যদি সুদের হার বাড়তে থাকে (তার সম্ভাবনাও রয়েছে), তবে হিসাবের ফর্দও লম্বা হতে থাকবে। ভবিষতের পক্ষে এই চড়া মূল্যমান বহন করা বেশ কষ্টসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াবে এবং তখন অন্যান্য ব্যয় কমানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।
পাশাপাশি, উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলিতে জিডিপি-র একটি বড় অংশ সরকারের তহবিলে জমা হয় রাজস্ব বা করের আকারে। যা স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা অন্যান্য কল্যাণকর কাজগুলি-সহ পরিকাঠামো বা প্রতিরক্ষার খাতে ব্যয় করা যায়। ভারতের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় মোট রাজস্ব সংগ্রহ জিডিপি-র অংশ হিসেবে প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছে। এক দশক আগে ১০.২ শতাংশ এবং ৯.৯ শতাংশ চলতি বছরের বাজেটে। দ্বিতীয় পরিসংখ্যানটি পরে পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ, করসংগ্রহের অবস্থা ভালই বলা যায়। কিন্তু কর-জিডিপি অনুপাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা ভারতের স্বাস্থ্য বা শিক্ষাখাতে এবং প্রতিরক্ষাতেও ব্যয়সঙ্কোচের ইঙ্গিত দেয়।
সর্বপ্রথমেই এ কথা বলা প্রয়োজন যে, বাজেট-বক্তৃতায় প্রলম্বিত তালিকাগুলিতে উল্লিখিত সরকারি প্রকল্পে বিপুল ব্যয় আসলে অন্তঃসারশূন্যতার খেলা। যদি রাজস্ব এবং সামগ্রিক ব্যয় জিডিপি-র সঙ্গে তাল রেখে না-বাড়ে এবং কিছু প্রকল্পে বেশি টাকা বরাদ্দ হয়, তবে অবধারিত ভাবেই অন্যান্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ কমতে বাধ্য।
সাম্প্রতিক কালে রাজস্বখাতে অচলাবস্থার একটি কারণ হল পণ্য ও পরিষেবা আইন। বৃহত্তর জিএসটি-রাজস্ব সম্পর্কে এ বছর আশাব্যঞ্জক বিবরণী কিন্তু একটি বিষয়কে এড়িয়ে যাচ্ছে। সেটি হল, বিবর্ধমান আমদানি খাতে প্রাথমিক ভাবে উৎসাহ প্রদান (ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আশ্চর্যজনক ভাবে ৭০ শতাংশ)। বিষয়টি এই যে, প্রধান রাজস্ব-সংস্কারগুলি এই প্রতিশ্রুত রাজস্ববৃদ্ধির কথা বলেনি। জিডিপি বৃদ্ধির বিষয়েও নয়। এ সবের কারণগুলি জানা। কিন্তু সেগুলি সংশোধনের প্রণালী খুবই ধীর।
রাজস্ব ক্ষেত্রে শৈথিল্যের আর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে পৌরকর। যখন সাম্প্রতিক সময়ে গত এক দশকে জিডিপি-র মূল্যমান ১৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, পৌরকর থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের বৃদ্ধি সেখানে মাত্র ৭০ শতাংশ। তুলনায়, ব্যক্তিগত আয়কর থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব গত এক দশকের তুলনায় ২৩০ শতাংশ বেড়েছে। এই বৈষম্যের একটি কারণ হতে পারে যে, সংস্থাগুলিকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। সৌভাগ্যবশত, সেই পর্যায়টি আমরা সম্ভবত পেরিয়ে এসেছি। সুতরাং, এই সব অনুপাত কিছু আলোকোজ্জ্বল দিককেই তুলে ধরবে। যখন বাজেটের দিন সংশোধিত কর-পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে।
এ সব সত্ত্বেও কিন্তু বৃহত্তর প্রবণতা অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে। সরকারি রাজস্ব আশানুরূপ ভাবে বাড়ছে না এবং বিশেষ কিছু প্রকল্প খাতে খরচের পরিমাণে পরিবর্তন এক দৃঢ়বদ্ধ বন্ধনীর মধ্যে ছটফট করছে। যে কোনও বাজেটের আর্থ-সামাজিক উদ্দেশ্যসমূহ (অর্থনীতির বৃদ্ধি, চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান অসাম্য দূরীকরণ নিয়ে ভাবনা) চরিতার্থ করতে যে সব রাজস্ব-ঘটিত পদক্ষেপ জরুরি, তার পরিসর আরও বেশি মাত্রায় কমে আসবে যদি পাহাড়প্রমাণ ঋণ পরিশোধের জন্য সুদ গুনতে গিয়ে রাজস্ব তহবিলে হাত পড়ে যায়।
এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং রাজস্ব বাড়ানোর জন্য মাত্র দু’টি পথ খোলা রয়েছে। একটি হল দ্রুতবর্ধমান অর্থনীতির আকারকে প্রকাশ্যে আনা। যে পদ্ধতিতে সুদের বোঝা বিপুল হলেও (সরকারি আদায়-সহ) এই শতকের প্রথম দশকে সঙ্কুচিত হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বের পরিস্থিতি এখন পরিবর্তিত। আর অন্য উপায়টি হল কর ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন। যথা— জিএসটি-র পুনর্বিন্যাস, কর্পোরেট করের ফাঁকফোকরগুলি ভরাট করা এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যে, পুঁজি থেকে প্রাপ্ত মুনাফার উপর করের পরিমাণ আয়করেরর তুলনায় কম কেন এবং কেনই বা সম্পদের উপরে করের কোনও অস্তিত্ব নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy