Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Sunil Gangopadhyay

Sunil Gangopadhyay birthday: বাবাকে বলতে ইচ্ছা করে, অনেককে তুমি পাত্তা দিয়েছো, যাঁরা ভাল নন

বাবার জন্মদিনের সেই জৌলুস, সেই ব্যস্ততা, সেই অভিমান, সেই ছোটাছুটি, এখন আর কিছুই নেই। আমি বিদেশে বসে আছি

আপনাদের ‘সুনীল গাঙ্গুলী’, আমার বাবা, ভোরের কলকাতায় আমার পাশে পাশে হাঁটত।

আপনাদের ‘সুনীল গাঙ্গুলী’, আমার বাবা, ভোরের কলকাতায় আমার পাশে পাশে হাঁটত। ফাইল ছবি

শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়
শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:৫৬
Share: Save:

ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে ভোরে ওঠার অভ্যাস ছিল। মর্নিং ওয়াকে যেতাম। কাছেই ঢাকুরিয়া লেক। সকালে উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বাবার সঙ্গে। মর্নিং ওয়াক সেরে বাবার কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়িতে যেতাম। গল্প করতাম। শৈশবের ভোর ছিল এমনই— আমার আর বাবার। সেই ভোরের আদুরে হাওয়া এখন পাল্টে গিয়েছে। আমি কালাপানি পার করে অন্য দেশে। বাবা নেই বহু বছর। তবু ঋতু বদলে বসন্তের মতোই বাবার জন্মদিন আসে। আর আমার ভোরের কথা মনে পড়ে। আপনাদের ‘সুনীল গাঙ্গুলী’, আমার বাবা, ভোরের কলকাতায় আমার পাশে পাশে হাঁটত। হাত ধরে। হাত আমি এখনও হয়ত ধরেই আছি। বাবা চলে গিয়েছে। ‘সুনীল গাঙ্গুলীর ছেলে’ আর আমি এখন হাত ধরে হাঁটি।

শৈশবে এত সব বুঝতাম না। কে কবি, কবিতা কী, গল্প, উপন্যাস কী, বুঝতে বুঝতে অনেক দিন লেগেছে। শুধু দেখতাম, বাবার জীবন ছিল নিয়মে বাঁধা। ছিল রোজ লেখার অভ্যাস। সকালে উঠে চা খেয়ে কাগজ পড়া। তার পর লিখতে বসা। অফিস যাওয়া তার পর। ফিরে এসে ফের লেখা। রাতে আড্ডা। নিয়মে আঁটা জীবন। তবুও একটু একটু পেতাম বাবাকে। বড় হলাম, মানে ক্লাস সেভেন-এইট হবে, দেখতাম, ভিড় বেড়ে গেল বাবার চারিদিকে। ‘কই, আমাকে তো সময় দেয় না আর’, মনের মধ্যে অভিমানের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ছোট-বড় হয়ে এই কথাটাই বার বার ফিরে আসত। এক বার হল কী, হঠাৎ দেখি বাড়িতে হাজির আমার স্কুলের এক শিক্ষিকা। আমি তো ওঁকে দেখেই ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছি! কী জানি, আমার নামে নালিশ ঠুকবেন নাকি! নাহ্, তা হয়নি। আনন্দবাজারে কর্মরত বাবার কাছে এক আর্জি নিয়ে এসেছিলেন ওই শিক্ষিকা। যদি সাংবাদিকতার পরিচয়ে কিছু সমাধান হয়। সারা দিন এমনই নানা কাজে বাবাকে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে হত, কথা বলতে হত। আমাদের জন্য সময় তেমন ছিল কই!

বাবার জীবন ছিল নিয়মে বাঁধা। ছিল রোজ লেখার অভ্যাস।

বাবার জীবন ছিল নিয়মে বাঁধা। ছিল রোজ লেখার অভ্যাস। ফাইল ছবি।

ধীরে ধীরে বাবার খ্যাতি বাড়তে থাকল। বাবা আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একের পর এক অনুষ্ঠান, রোজই কিছু না কিছু থাকে। না হলে বাড়িতে ভিড় লেগেই থাকত। অনেকেই আসতেন। তবে আজ মনে হয়, বাবার দোষও ছিল। কেন সবাইকে পাত্তা দিত? কেন উপকার করতে চাইত? সবাই ভাল নয়। হতে পারে না ভাল। বাবাকে বলতে ইচ্ছা করে, এমন অনেক লোককে তুমি পাত্তা দিয়েছো, যাঁরা ভাল নন। আবার এমন অনেককে দূরে সরিয়ে দিয়েছো, যাঁরা প্রকৃত ভাল মানুষ। ঠিক হয়নি সেটা। ভাল মানুষগুলোকে পাত্তা দিলে হয়ত ক্যানভাসে অন্যরকম ছবি আঁকা হত। বাবার মধ্যে যে গুন্ডা ব্যাপারটা ছিল, সেটাও বোধহয় এই ভালমানুষটির চাপে ধীরে ধীরে নিজেকে ঘরবন্দি করেছিল। তাই ‘না’ বলতে কষ্ট হত বাবার।

কেমন গুন্ডামি ছিল শুনবেন? এটাও মর্নিং ওয়াক ফেরত একটা গল্প। ওই দিন ঢাকুরিয়া লেক থেকে ফেরার পথে বাবা ঠিক করল বাস ধরবে। আমরা সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা বাস চোখে পড়ল বাবার। স্ট্যান্ড থেকে ছাড়ার মুহূর্তে বাবা ছুট দিল বাসের দিকে। লাফিয়ে উঠে পড়ল। আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছি। বাবাও বাসের গেটে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, আমি তখনও ফুটপাতে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার দিকে এমন একটা নজরে বাবা সে দিন তাকিয়ে ছিল, দেখে মনে হল বাবা বোঝাতে চাইছে, আমি এই গুন্ডামির গুণটুকুও পাইনি। হয়ত পাইনি। তাই হয়ত কখনও বাবাকে কেড়ে আনতে পারিনি। কেড়ে আনতে চেয়েছিলাম কি? বাবার জন্মদিনগুলো যত না আমার বা মায়ের ছিল, তত বেশি ছিল কলকাতার। প্রতি বছর জন্মদিনে দেখতাম বাবা ব্যস্ত। একের পর এক অনুষ্ঠান। এখানে যাচ্ছে, ওখানে যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে কাটানোর মতো সময় কই? যখন আরও বড় হলাম, চিন্তা হত মাকে নিয়ে। আমার থেকে মায়ের কষ্টটা হয়ত আরও বেশি। বাবাকে এই দিনটাতেও একলা করে পাওয়া যেত না যে। পেত না মা। এরকম করেই সকলের মধ্যে লোকটা রয়ে গেল। কাটিয়ে দিল জীবনটা।

আমেরিকায় সপরিবার সুনীল।

আমেরিকায় সপরিবার সুনীল। শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সংগ্রহ থেকে

তবে মজা হত বাবার লেখালেখিতে যখন নিজেদের দেখতে পেতাম। আমার তো ভারী আনন্দ হত। বাবার এমন একাধিক ছড়া আছে, যেখানে আমি আছি, বাবা লিখেছিল, ‘পুপলু যাবে ঘুম’। আমাকে নিয়ে লেখা ছড়া। বড় হয়ে বাবার ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখাগুলো যেন আমাকে আঁকড়ে ধরল। ‘রাধাকৃষ্ণ’ আমাকে এখনও মুগ্ধ করে। এমন একটা নারীবাদ কেন্দ্রিক লেখা, যত বার পড়ি, তত বার নতুন করে আবিষ্কার করি। ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর কথা হয়ত অনেকেই বলবেন। কিন্তু আমার সবচেয়ে পছন্দের উপন্যাস ‘রাধাকৃষ্ণ’।

বাবার জন্মদিনের সেই জৌলুস, সেই ব্যস্ততা, সেই অভিমান, সেই ছোটাছুটি, এখন আর কিছুই নেই।

বাবার জন্মদিনের সেই জৌলুস, সেই ব্যস্ততা, সেই অভিমান, সেই ছোটাছুটি, এখন আর কিছুই নেই। ফাইল ছবি।

বাবার জন্মদিনের সেই জৌলুস, সেই ব্যস্ততা, সেই অভিমান, সেই ছোটাছুটি, এখন আর কিছুই নেই। আমি বিদেশে বসে আছি। ওখানে ছিলাম যখন, তা-ও ছোটখাটো কয়েকটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। কিন্তু এখানে তেমন কিছু হয় না। উদ্‌যাপনের অবকাশ কোথায়? চিন্তা হয় অসুস্থ মাকে নিয়ে। এ বারেও বাবাকে ছাড়াই আরও একটা জন্মদিন কাটাতে হবে মা’কে। তবে আর যা হোক, আমার নিজস্ব পরিচয়ের বাইরেও তো আমার মধ্যে বাবা বেঁচে আছে। ওই যে বললাম— আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে।

(লেখক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Sunil Gangopadhyay Bengali Literature digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy