অবশেষে: জেল থেকে মুক্তি পেলেন সুধা ভরদ্বাজ। ৮ ডিসেম্বর, ২০২১। মুম্বই। পিটিআই।
সুধা ভরদ্বাজ জামিনে মুক্তি পেলেন ৯ ডিসেম্বর। এই আইনজীবী ও আন্দোলনকারী প্রায় তিন বছর বাইকুল্লার জেলে বন্দি ছিলেন। তাঁর জামিনে ষোলোটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি প্রত্যাশিত, প্রায় সব সময়েই থাকে। যেমন, তিনি আদালতের নির্দেশ ছাড়া এলাকা ছাড়তে পারবেন না, নিকটস্থ থানায় নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে। কিন্তু আর একটি শর্তও দেওয়া হয়েছে, যা সাধারণত দেখা যায় না। তা হল, মামলা চলাকালীন সুধা তা নিয়ে কোনও সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে পারবেন না— সংবাদপত্র, টিভি, সমাজমাধ্যম, কোথাও নয়।
গোড়াতেই বলে নেওয়া ভাল, এই লেখা কাউকে দোষী বা নির্দোষ দেখানোর জন্য নয়। কিছু প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করাই উদ্দেশ্য— আমাদের ফৌজদারি আইন যখন সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের ঘোলা জলে অপরাধী ধরতে নামে, তখন যে প্রশ্নগুলো বার বার উঠে আসে। যেমন, সুধার জামিনের এই কঠোর শর্তের যুক্তি কী? অনুমান, সুধা তাঁর লেখা বা কথার মাধ্যমে বিচারকে যাতে প্রভাবিত না করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা। জামিনের আর একটি শর্ত— সুধার যে ধরনের কার্যকলাপের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে এবং ইউএপিএ ধারায় এফআইআর করা হয়েছে, তার সদৃশ (‘সিমিলার’) কোনও কাজ তিনি করতে পারবেন না। সুধা এক জন সমাজ আন্দোলনকারী, আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষদের অধিকার রক্ষায় আইনি উপায়ে এবং অন্যান্য পদ্ধতিতে কাজ করেন তিনি। জামিনের শর্ত মানতে গেলে তাঁকে কাজ থেকে সরে আসতে হবে। কারণ তাঁর যে কোনও কাজকেই আদালত সেই সব কাজের ‘সদৃশ’ বলে মনে করতে পারে, যেগুলোর জন্য সুধাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
এই দু’টি শর্ত নিয়ে যদি একটু চিন্তা করা যায়, তা হলে এই দু’টির মধ্যে নিহিত মূল কথাটি বেরিয়ে আসবে। সাধারণত কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তকে নির্দোষ বলে ধরে নেওয়া হয়, রাষ্ট্রকেই অপরাধ প্রমাণ করতে হয়। ইউএপিএ-র মতো সন্ত্রাসবিরোধী ধারার ক্ষেত্রে এই পূর্বধারণা উল্টে যায়। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে আইন অনেকটা বেশি ক্ষমতা দিয়েছে পুলিশ এবং অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থাকে। দেশের আইন যে কোনও অভিযুক্তকে যে সব মৌলিক সুরক্ষা দিয়েছে, সেগুলো খারিজও করতে পারে পুলিশ। যেমন, ইউএপিএ-র ৪৩(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত কোনও কাজের সূত্রে যদি অভিযুক্তের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক বা তেমন কোনও বিপজ্জনক পদার্থ পাওয়া যায়, অথবা অনুসন্ধানে প্রাপ্ত (‘ফরেন্সিক’) প্রমাণ যদি ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্তের সংযোগের ইঙ্গিত দেয়, তা হলে আদালত ধরে নেবে যে, অভিযুক্ত অপরাধী। অপরাধীকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি নির্দোষ। তেমনই, ৪৬ নম্বর ধারায় ফোনে আড়ি পেতে পাওয়া তথ্যকে সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে পেশ করার অনুমতি দেয়, যা সাধারণত করা যায় না (তার অবশ্য কিছু পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া রয়েছে)। এই ধারাগুলো থেকে বোঝা যায়, সাধারণ ফৌজদারি আইন যে ভাবে কাজ করে, তার সঙ্গে সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের কাজের গতিপ্রকৃতির যথেষ্ট পার্থক্য আছে।
এমনই একটি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ফাদার স্ট্যান স্বামী। অশীতিপর স্ট্যানও ওই একই মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাবন্দি হন, এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর ঠিক দু’দিন আগে তিনি বম্বে হাই কোর্টে একটি আবেদন করে বলেন, ইউএপিএ-র ৪৩ঘ (৫) ধারাটি সংবিধানবিরোধী। ওই ধারাটি হল জামিন সংক্রান্ত। একটু সরল ভাবে বললে, ওই ধারায় বলা হয়েছে যে, ইউএপিএ-তে অভিযুক্তকে জামিন দিতে হলে আদালতকে সরকারি কৌঁসুলির কথা শুনতে হবে, এবং কেস ডায়রি ও অন্যান্য পুলিশ রিপোর্ট খতিয়ে দেখতে হবে। যদি আদালতে মনে হয় যে অভিযোগটি আপাতদৃষ্টিতে (‘প্রাইমা ফেসি’) সত্য, তা হলে জামিনের আবেদন খারিজ হবে। যদিও অন্যান্য ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে জামিন হল অভিযুক্তের অধিকার।
যে ভাবে এত দিন সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের মামলাগুলির বিচার হয়েছে, সে দিকে তাকালে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালত সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্যকেই প্রায় বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়ে জামিনের আবেদন খারিজ করেছে। খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে জামিন মিলেছে— যখন মামলা অপ্রত্যাশিত রকম দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে, অথবা যখন অভিযুক্ত অত্যন্ত অসুস্থ (যেমন ভারাভারা রাও)। এর বিপরীতেও মত দিয়েছে আদালত। বিচারপতি এস মুরলীধরের নেতৃত্বে দিল্লি হাই কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চের একটি পর্যবেক্ষণ (জ়াহুর আহমেদ শাহ বনাম এনআইএ, ২০১৮)হল, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে অভিযোগ সত্য বলে মনে হচ্ছে, সেখানে আদালতগুলি কেবলমাত্র ‘তদন্তকারী সংস্থার ডাকঘর’ (‘পোস্ট অফিস অব দি ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি’) হিসাবে যেন কাজ না করে। তাদের উচিত বাড়তি মনোযোগের সঙ্গে সব সাক্ষ্য খতিয়ে দেখা।
তবে, সন্ত্রাসের ঘটনার তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি (এনআইএ) ওই মামলা সুপ্রিম কোর্টের কাছে নিয়ে গেলে শীর্ষ আদালত হাই কোর্টের সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়, এবং বলে যে, কেবল সরকারপক্ষের পেশ করা তথ্যের ভিত্তিতেই জামিন খারিজ করা যেতে পারে— যদি বিচারে শেষ অবধি সেই সব তথ্যের যাথার্থ্য প্রতিষ্ঠা না-ও হয়, তা হলেও জামিন খারিজ করা অসিদ্ধ নয়। এ কথা স্বীকার করলে জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্ট্যান স্বামী সে কথাই বলেছিলেন তাঁর আবেদনে— ৪৩ (ঘ) ধারা অভিযুক্তের সামনে অনতিক্রম্য বাধা (‘আনসার্মাউন্টেবল হার্ডল’) তৈরি করে, তাই তা সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা (সাম্যের অধিকার) এবং ২১ নম্বর ধারা (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার) লঙ্ঘন করে।
প্রশাসন তথা বিচারব্যবস্থার মধ্যে কী করে কিছু নাগরিকের প্রতি এমন অনাস্থা জন্মায় যে, তাদের মৌলিক অধিকার খারিজ করার আগে সব তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখার প্রয়োজনও আর অনুভূত হয় না? এর একটা উত্তর মেলে স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ক্যাথলিন টেলরের কথায়— এ হল ‘অপরায়ণ’ (‘আদারাইজ়েশন’)। যখন সমাজে অল্প কিছু লোক অন্য মতে বিশ্বাসী, তখন তাঁদের প্রতি অধিকাংশের মনে কিছু আবেগ কাজ করে— যেমন ভয়, ক্রোধ, প্রবল বিরক্তি। হিংস্র আক্রমণে এই সব আবেগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অতীতে আমরা বরাবরই ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের ভিত্তিতে দূরত্ব তৈরি হতে দেখে এসেছি। সন্ত্রাসবাদ বা জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গে এসে এই ‘অপরায়ণ’ যেন এক অন্য মাত্রা গ্রহণ করে। কোনও আচরণ ‘জাতীয়তা-বিরোধী,’ এমন আভাস-ইঙ্গিত মিললেই সরকারের নানা বিভাগ এবং নাগরিক সমাজ প্রায় দ্বিধাহীন ভাবে, এক সুরে তার নিন্দা করে, তাকে দমন করতে উঠেপড়ে লাগে।
আদালতের নানা রায় দেখেও আন্দাজ হয়, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠলে রাষ্ট্রের বক্তব্যই মোটের উপর মেনে নেয় আদালত, ‘সর্বাগ্রে সুরক্ষা’ নীতি ধরে এগোয়। সুধা ভরদ্বাজের জামিনের কঠোর শর্ত, জামিনের অপেক্ষায় স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু, সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের এক বছরের উপর বন্দিদশা— এই সব ঘটনা সে দিকেই ইঙ্গিত করে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy