চিত্রকলা প্রদর্শনী, তার উদ্বোধন করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কারণ শিক্ষামন্ত্রীকে পাওয়া যায়নি... এ রকম এক দৃশ্য এবং কথোপকথন ছিল মৃণাল সেন নির্দেশিত চলচ্চিত্র কলকাতা ৭১-এ। ১৯৭২-এ ছবিটি মুক্তির পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে সন্দেহ হয়, চিত্রকলা নয়, সিনেমা, ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী দর্শকধন্য বলিউডের পিছনে হয়তো নিরন্তর পরামর্শদাতার মতো হয়ে উঠেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
সম্প্রতি তুমুল জনপ্রিয় সূর্যবংশী-র কথা ভাবা যেতে পারে। নভেম্বরে দীপাবলির সময় মুক্তি পাওয়া ছবিটি এ দেশে এবং দেশের বাইরে প্রায় ২৯৪ কোটি টাকার মতো বাণিজ্য করেছে। এর শুরু অবশ্য হয়েছিল অগস্টে, বেল বটম ছবিটির মুক্তির পর। তখন সিনেমাহলগুলো প্রায় ধুঁকছিল, দর্শক আসছিলেন না। বেল বটম দর্শক নিয়ে এল, প্রায় ৫১ কোটি টাকার বাণিজ্য দিল।
দর্শক ফিরিয়ে আনার মূলমন্ত্র কী দেখলাম? দেশ বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানকে মারো, সঙ্গে মুসলমান সন্ত্রাসীদেরও। দু’টি ছবিরই একই প্রতিপাদ্য। বেল বটম-এর গপ্পে অবশ্য পাকিস্তানিদের সঙ্গে অশুভ আঁতাঁত তৈরি করেছে খলিস্তানিরা (সেটা বোধ হয় দেখানো জরুরি হয়ে উঠছিল: প্রসঙ্গত, তখন দেশের কৃষক আন্দোলনে অগ্রাধিনায়ক ছিল পঞ্জাব)। বলিউড অনেকটা হাওয়া-মোরগের মতো, দেশের সরকার যে সামাজিক কাঠামোটাকে চালু রাখে, সাধারণত সেই আদলেই বিনোদনের অভিমুখ তৈরি করে। নব্বইয়ের দশক জুড়ে হিন্দুত্বের রাজনীতির যে সাংস্কৃতিক আধিপত্য, তার অনুগত দর্শকরুচি তৈরি করাই ছিল তখন বলিউডের বাজার বজায় রাখার শর্ত। ওই দশকের শেষ থেকে নতুন শতকের প্রথম দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত যখন ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনকাল, তখন থেকেই তৎকালীন রাষ্ট্র আর তার সরকারকে সামাজিক নেতৃত্বের প্রধান উৎস মেনে নিয়ে পা ফেলা শুরু করল বলিউড।
ইন্ডাস্ট্রি চালান যাঁরা, সেই মালিকদের অধিকাংশ কেন সাধারণত সরকারের বিরোধিতা করতে চান না, বুঝতে অসুবিধে হয় না। ফলে যে সরকার সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ চায়, তারা এই নিয়ন্ত্রণটাকে আরও আধিপত্যকামী, আরও জোরদার করে তুলতে পারে। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, তবে বাজার বজায় রাখার স্বার্থে বিনোদনের এই ধরনটির খুব একটা ব্যত্যয় ঘটে না। তাই সন্ত্রাসবাদী এবং পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট মুসলমান নাগরিকের ইমেজটা প্রায়ই ঘুরেফিরে এসেছে গত কয়েক বছরে, এবং বিষয়টাকে স্পষ্ট করার জন্য ভারতীয় মুসলমানকে দুই ভাবে সাজানো শুরু হয়েছে: খারাপ মুসলমান এবং দেশভক্ত মুসলমান। এ দেশের খারাপ, বেইমান, প্রায়-পাকিস্তানি মুসলমান চরিত্রদের পাশাপাশি ভাল মুসলমানদের জন্য পরিসর তৈরিও জরুরি হয়েছে। কেননা, শেষ অবধি, বলিউডের ছবি তৈরির সময় ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে বলিউডি পুঁজির বাণিজ্য-বিপণনের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিস্তারের কথা তো আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বেল বটম-এও পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছে অন্য এক মুসলিম দেশকে, ভারতের মিত্রপক্ষ তারা।
ভারতীয় মনে পাকিস্তান আর পাকিস্তানিদের সম্পর্কে আজন্ম বিরূপতা কতখানি, সে আর বলে দিতে হয় না। সেই ছোটবেলায় পাকিস্তানের হকি টিমকে হারাতে পারলে যেমন আনন্দ হত আমাদের, তেমনই হয় আজও, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে জয় এলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে যত না আনন্দ আমাদের, তার চেয়ে বেশি আনন্দ ১৯৭১-এ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সেনাদের মার খেয়ে পিছু হটার স্মৃতিতে। কোনও চিরশত্রু প্রতিবেশী দেশ থাকলে নিজের দেশের প্রতি আবেগ জাগানোর কাজটা নিশ্চয়ই সহজ। তাই, বার বার উঠে আসে তাদের কথা যারা আমাদের দেশটাকে দু’টুকরো করে একটা মৌলবাদী রাষ্ট্র বানিয়েছে, যাদের গুপ্তচর সংস্থার লোকজন ছদ্মবেশে আমাদের দেশে ঘুরে বেড়ায়, আর যাদের নাশকতায় আমরা বিপন্ন হই, তাদের কথা।
বলিউডের প্রভাব কত গভীর আর বিস্তৃত, আমরা জানি। জনমানসে এই রাষ্ট্রিক গৌরবের সামনে তাই কোনও যুক্তি ধোপে টেকে না। সুতরাং বলিউডি হিরোদের মতো সাধারণ ভারতীয়ও পাকিস্তান বলতে বোঝেন পাকিস্তানি রাষ্ট্র, সে দেশের শাসক। সেখানকার সাধারণ মানুষকে তাঁর শাসকের সঙ্গে গুলিয়ে একাকার করেন। নতুন দশকের প্রথম বছরে বলিউডে সেই পুরনো ধারাটিই নতুন করে সবল হল সূর্যবংশী, বেল বটম-এর সৌজন্যে।
কয়েক বছর আগে পাকিস্তান-জাত প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আয়েশা জালাল এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের সঙ্কটকে দেশভাগ বা বিশ্ব-ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বোঝার কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, সেই “প্রেক্ষিত বোঝার জন্য যে সহমর্মিতা ও ‘এমপ্যাথি’ দরকার, ভারতীয়দের পক্ষে বোধ হয় সেটা আয়ত্ত করা কঠিন।” (১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, আবাপ, পৃ ৪)। বলিউডের এই ক্রমাগত পাকিস্তান-বিরুদ্ধতাকে জনপ্রিয় হতে দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, আমাদের দেশে ক্রমশই ‘এমপ্যাথি’র পরিসর আরও ছোট হয়ে আসছে এই বিপুলবিস্তৃত বিদ্বেষবিষের ফলে।
আমাদের মনের ধারণাগুলিকে চোখের সামনে অবয়ব দেয় সিনেমা। দেশ বলতে আমাদের মনে যে রাষ্ট্র জেগে ওঠে, রাষ্ট্র মানেই তার আইন পুলিশ-প্রশাসন আর কাঁটাতারের যে ইমেজ আমাদের মনে তৈরি হয়— তাকে নির্মাণ আর সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা তার। জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের অবদান হিসেবে এই ইমেজগুলি জনমানসে থেকে যায়, ছড়িয়ে পড়ে, অন্যান্য বার্তা ও যুক্তিকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। এই ইমেজ-ই যেন একমাত্র বাস্তব, বাকি সব ভুয়ো।
এই ক্রমবিলীয়মান এমপ্যাথির দেশ কোন অভিমুখে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? যে ছবির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। কলকাতা ৭১-এ পুলিশের গুলিতে খুন হয়ে-যাওয়া ছেলেটি ছবির শেষে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল: “আজ বাঁচলে কিন্তু কাল? পরশু? তার পরের দিন, তারও পরের দিন?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy