প্রায় প্রবচন হয়ে উঠেছে শোলে ছবির সেই সংলাপ। ‘অব তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া!’ এখন এমনই কিছু চর্চা চলছে রাজ্যের রাজনীতিতে। নির্দিষ্ট ভাবে বললে, সেই চর্চা বেশিটাই হচ্ছে তৃণমূল শিবিরে। যার সবটাই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
এখানে কে সেই ‘কালিয়া’, তা নিয়ে আলোচনার আগে বিষয়টির সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বোঝা দরকার। শাসক দল তৃণমূলের ভিতরে সাম্প্রতিক টানাপড়েনের খবর এখন আর গোপন নেই। সবাই সব দেখছেন, জানছেন, বুঝছেন। এত দিন যে সব বিষয় সামনে আসত না, এখন তা আসছে।
আর তাতেই দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের স্রষ্টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে দলকে চালাতে চান, তাতে বাদ সাধার এক কুশলী ও সমান্তরাল প্রচেষ্টা জারি হয়েছে। অর্থাৎ কার্যত মমতার নিজের দলে তাঁর অবিসংবাদী নেতৃত্বকে নিশানা করা হচ্ছে বললে হয়তো খুব ভুল হবে না। আর মুখে উচ্চারিত হোক না-হোক, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এর মধ্যে নানা ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন। বস্তুত বিতর্কের অনুঘটক হিসাবে প্রকাশ্যে কাজ করেছে অভিষেকের সাম্প্রতিক বিবিধ বক্তব্য, মন্তব্য, ক্রিয়াকলাপ।
সন্দেহ নেই, অভিষেক আজ তৃণমূলের তরুণ প্রজন্মে সবচেয়ে আকর্ষক নাম। বিবিধ ক্ষমতারও তিনি অধিকারী। মমতাকে আলোচনার ঊর্ধ্বে রাখলে এটা অবশ্যই বলা যায়, তিনি ছাড়া তাঁর দলে শুধু অভিষেকই এখন একক ভাবে সভা ভরাতে পারেন। তাঁর সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ আছে। তাঁর পদক্ষেপের দিকে সর্বদা নজর থাকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক মহলের। তাঁর প্রতি রাজনৈতিক আক্রমণ তো থাকেই।
অনেকেই বলেন, এর পিছনে অনেকাংশে আছে মমতার উত্তরাধিকার। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, মমতার পরিবারের সন্তান হিসাবে অভিষেক যে এগোতে পেরেছেন, বা মমতা যে তাঁকে সেই পথ করে দিতে চেয়েছেন, সেটা অভিষেকের মধ্যে কিছু গুণ এবং সম্ভাবনা লক্ষ করেই। যদি তা না থাকত, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৪ সালে তাঁর সাতাশ বছরের ভাইপোকে লোকসভা ভোটে জিতিয়ে আনতেন না।
সব মুদ্রারই তো দু’টি দিক থাকে। অভিষেকের ক্ষেত্রেও আছে। এক দিকে তাঁর মধ্যে বিবিধ সম্ভাবনা, দক্ষতা ও গুণের সমাহার। অন্য দিকে নিজস্ব এক মানসিক গঠন, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে দ্রুত উত্থানের অভিলাষ। ওই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্যের অভাবেই হয়তো তাঁর অবস্থান বার বার বিতর্কিত হয়ে উঠছে। বহু বার বলা একটি কথা আজ আবারও প্রাসঙ্গিক। সেটি হল, ধৈর্য ও সময়-বিচার। অনেকেরই মনে হচ্ছে, অভিষেক হয়তো সময়কে পিছনে ফেলে তাড়াতাড়ি এগোতে আগ্রহী।
ভেবে দেখুন, ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে জিতে মমতা যখন দ্বিতীয় বার সরকার গড়ছেন, তখনই রাস্তায় অভিষেকের ছবি দিয়ে ‘ম্যাচ উইনার’ লেখা হোর্ডিং ঝুলেছে। তাঁর সাংসদ-জীবন তখন মাত্র দু’বছরের। সেই জল কত দূর গড়িয়েছিল, সে কথা থাক। তবে এটা বলতে হবে, ‘টিম অভিষেক’ তৈরির সেটাই ছিল প্রথম প্রকাশ।
তৃণমূলে নব প্রজন্মের প্রধান মুখ হিসাবে অভিষেক অল্প কয়েক বছরের মধ্যে যে ভাবে গুরুত্বের অধিকারী হয়েছেন, সর্বস্তরের নেতারা তা জানেন ও মানেন। কংগ্রেসে থাকাকালীন মমতাও এক সময় যুব সভাপতি ছিলেন। তবে তাঁর দাপট ছিল প্রতি দিন আন্দোলনের ময়দানে। কংগ্রেসে প্রকৃত ক্ষমতার বৃত্তে তাঁকে দলের মধ্যেই লড়তে হত নিরন্তর। সে দিক থেকে অভিষেক নিশ্চয় ভাগ্যবান। তাঁকে পথে বা দলে কোথাও লড়াই করে সাংগঠনিক ক্ষমতা ‘ছিনিয়ে’ নিতে হয়নি। ক্ষমতাই তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে।
এর ফলে তৃণমূলের উপরতলায় কী ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে, নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। সেই সময়ও দলের অভ্যন্তরে ক্ষমতার দড়ি টানাটানিতে অভিষেকের দিকেই ছিলেন মমতা। তবে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তের পরে তৃণমূলে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের আগমন ও প্রভাব বিস্তার ক্রমশ মমতার দলকে আজ যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে, তা যেন সুখী পরিবারে ভাঙন ধরানোরই নামান্তর। তৃণমূল যে হেতু রাজ্যে একক ক্ষমতাশালী শাসক, তাই তাদের দলে টালমাটাল হতে থাকলে প্রশাসন ও জনজীবন তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। সেই কারণে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।
সবাই জানেন, লোকসভা ভোটের পরে পেশাদার ভোটকুশলী পিকে-র সংস্থাকে বাংলায় তৃণমূলের জন্য আনার মূল ব্যবস্থাপক ছিলেন অভিষেক। তিনিই মমতাকে রাজি করান। সে দিন যে লক্ষ্যে অভিষেক এই কাজ করেছিলেন, তাতে কৌশলগত ভুল ছিল বলে মনে করি না। লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়া মমতা তখন বিধানসভা ভোটের ভবিতব্য নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন।
সেই অবস্থায় পিকে-র মতো পরিচিত এক পরামর্শদাতাকে পাশে রাখার যুক্তি থাকতেই পারে। এমনকি, আজ যাঁরা পিকে-র সমালোচক, তাঁরাও কিন্তু সে দিন ওই প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেননি। যদিও ‘বণিকের মানদণ্ড’ যে এ ভাবে ‘রাজদণ্ড’ রূপে দেখা দেবে, সেটা কেউই সে দিন ভাবেননি। বুঝতেও পারেননি।
সেই সময় তৃণমূলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি চালু করা থেকে শুরু করে ভোটের সময় বাঙালির জাত্যভিমানকে উস্কে দিতে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ প্রচারের মতো কয়েকটি পদক্ষেপ অবশ্যই বিধানসভার লড়াইতে মমতাকে এগিয়ে দিয়েছিল। সেখানে পিকে এবং অভিষেকের যৌথ ভূমিকা অস্বীকার করার নয়।
কিন্তু তার বাইরেও পিকে আর যা যা করেছেন, করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তাতে তৃণমূলে ভাঙন-রেখা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। দলে প্রশ্ন উঠেছে, টাকার বিনিময়ে আসা এই ভোটকুশলীর গূঢ় উদ্দেশ্য কী? একটি রাজনৈতিক দলকে কার্যত ‘কব্জা’ করে ফেলা? অভিষেকের সমর্থন পিকে-র দিকে থাকে বলেই বিষয়টি স্বাভাবিক কারণে আরও ঘোরালো হয়েছে।
পিকে-র সংস্থা আইপ্যাক-এর উপর ‘ভার’ ছিল সরেজমিন সমীক্ষা করে বিধানসভা ভোটে একটি প্রার্থী তালিকা তৈরি করা। একই কাজ তারা করেছে কলকাতা-সহ পুরসভাগুলির বেলাতেও। কিন্তু সেই সব তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে দলের মধ্যেই। এমনকি লেনদেনের অভিযোগও চাউর হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভোটকুশলী সংস্থাটি তৃণমূলে সাংগঠনিক পদাধিকারী বাছাইতেও সরাসরি নাক গলিয়েছে বলে খবর। বহু জেলা থেকে তেমন ক্ষোভের আঁচ মমতা পেয়েছেন।
সত্য-মিথ্যার পরিমাপ জানা নেই। তবে এটা বলতে পারি, মমতার দলে এই ধরনের অভিযোগ নজিরবিহীন। এটাও বোঝা কঠিন যে, টাকা নিয়ে কাজ করতে আসা এক জন পরামর্শদাতা এতখানি ‘অধিকার’ পেলেন কিসের জোরে? তাঁকে কার্যত নির্ধারকের চেয়ারে বসানোর বা প্রশাসনের অন্দরমহলে ঢুকতে দেওয়ার কারণ কী? কেনই বা দলের সকল বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি? দলের পুরনো নেতারাই বা কেন তাঁর আচরণে ‘অপমানিত’ বোধ করবেন? শুধু বাংলা নয়, গোয়ার তৃণমূল নেতারাও আজ একই অভিযোগে সরব।
এ কথা ঠিক, একটা সময় পর্যন্ত মমতার প্রশ্রয় না থাকলে পিকে এতটা ডানা ছড়াতে পারতেন কি না সন্দেহ। সেই প্রশ্রয়ের পিছনে প্রয়োজনের তাগিদ কতটা ছিল, কতটা পরিস্থিতির ‘চাপ’, সেটা অবশ্যই অনুমানসাপেক্ষ। তবে অভিষেককে কেন্দ্র করে তৃণমূলে সাম্প্রতিক আলোড়নের পরেই দলের রাশ শক্ত হাতে ধরেছেন মমতা। পুরনোদের গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি পিকে-র সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করার ভাবনা উস্কে দেওয়া এক অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ।
রাজনীতি সদা পরিবর্তনশীল। পিকে-র ‘অব ক্যায়া হোগা’ বলবে ভবিষ্যৎ। তবে ‘দর্পচূর্ণ’ করার তাগিদটা তৃণমূল নেত্রী এ বার বোধ হয় বুঝেছেন এবং বোঝাতে চাইছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy