Advertisement
০৬ অক্টোবর ২০২৪
school

স্কুল খুলুক, কিন্তু এখনই কি

ভারতে টিকাকরণের সংখ্যা একশো কোটিতে পৌঁছেছে। কিন্তু, সত্যিই কত জন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী একটি বা দু’টি ডোজ় পেয়েছেন?

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২১ ০৪:৩২
Share: Save:

থার্ড সিমেস্টারের ছাত্রীরা এক বাক্যে সায় দিল, তারা খুব খুশি— কলেজ খুলে যাচ্ছে। “আগের বছর থেকে অপেক্ষা করে আছি ম্যাডাম, কখন কলেজ যেতে পারব।”— অনলাইন ক্লাসের পর্দায় সকলের সহাস্য উত্তর। আর করোনা? তার ভয় নেই? “করোনা তো আর নেই ম্যাডাম। মানে চার পাশে সে রকম কারও শুনছি না।” আবারও অনলাইন ক্লাসে আনন্দ মুখরিত হাস্যরোল।

মাত্র আর কিছু দিনের অপেক্ষা। ছাত্রছাত্রীদের এই আনন্দ আর হাসির স্বপ্নই সত্যি হতে চলেছে। সরকারি নির্দেশমতো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু নভেম্বরের ১৬ তারিখ। দেড় বছর পেরিয়ে দেশ ও রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। অনলাইন পড়াশোনা, তার অসংখ্য দোষ-ত্রুটি, প্রভাব— সব কিছু শেষ হয়ে আবার পুরনো ছন্দে ফিরবে সব কিছু। শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয়, মা-বাবা’রাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন।

পরিচিত এক দোকানের মালিক সেই পুজোর আগে থেকেই জানতে চাইছিলেন, “কিছু খবর পেলেন, কবে খুলবে স্কুল? ছেলেকে তো আর বাড়িতে আটকে রাখা যাচ্ছে না।” অবশ্য ভদ্রলোকের ছেলেটি এখনও নবম শ্রেণির নীচে, তাই তিনি এখনও স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারবেন না, কিন্তু বাড়ির ছেলেমেয়ে আবার আগের মতো স্কুলে যাবে, নিয়মিত পড়াশোনা আর পরীক্ষা হবে— এতে খুশি প্রায় সব অভিভাবক।

কিন্তু করোনার প্রকোপ? তথ্য, পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে, পুজোর পরে সংক্রমণ বেড়েছে, এখনও প্রতি দিন আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় এক হাজার মানুষ, পজ়িটিভিটি রেট ২.১৮ শতাংশ। চিকিৎসকেরা ক্রমাগত সতর্ক করছেন, এই পরিস্থিতিতে সতর্ক না হলে অবস্থা বদলে যেতে পারে তৃতীয় ঢেউয়ে। পশ্চিমবঙ্গের ডক্টর্স ফোরামের কৌশিক চাকীর মতে, পুজোর পরে করোনা ঊর্ধ্বমুখী, তবে এই সময় সতর্কতা নিলে এবং ভিড় এড়ালে হয়তো তৃতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। একই মত কোভিড-বিশেষজ্ঞ রাহুল জৈনেরও।

‘ভিড়’ যাতে না হয়, সে জন্য নানা রকম উপায় বার করার চেষ্টা করছেন প্রশাসক ও শিক্ষকেরা। বিভিন্ন সিমেস্টারের ছাত্রছাত্রীদের ‘ভার্টিকালি’ ভাগ করে দেওয়া হবে না কি ‘ল্যাটেরালি’— অর্থাৎ কলা ও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভাগ করা হবে, না কি একই বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেক সংখ্যায় ডাকা হবে— এই নিয়ে নানা রকম আলাপ আলোচনা, দীর্ঘ প্রশাসনিক বৈঠক চলছে স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই পড়াকে দু’ভাগে ভাগ করে কী ভাবে পড়ানো সম্ভব, শুধু ফিজ়িক্যাল ক্লাসরুম না কি সঙ্গে অনলাইনও চলবে— এ রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা।

তবে এই প্রশ্ন শুধু রাজ্যসাপেক্ষ নয়। অন্যান্য রাজ্যেও খুলে গিয়েছে শিক্ষাঙ্গন। যেমন, দিল্লিতে সেপ্টেম্বর মাসেই খুলেছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ও, ১ নভেম্বর থেকে স্কুল খুলে গিয়েছে সব শ্রেণির জন্যই। দু’ভাগে ভাগ হয়ে সকালে ও বিকেলে আসছে ছাত্রছাত্রীরা। এর আগেও জানুয়ারি মাসে খুলেছিল দিল্লির স্কুল— কিন্তু প্রায় ১১,০০০ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা আক্রান্ত হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। সবচেয়ে আগে স্কুল খুলেছে মহারাষ্ট্রে, ২৫ অক্টোবর খুলে গিয়েছে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্যেও। এর আগে জানুয়ারিতে খুলেছিল মহারাষ্ট্রের স্কুল, কিন্তু মার্চ মাসে সব স্কুল কোভিড হটস্পট হয়ে দাঁড়ানোয় তা বন্ধ করে দিতে হয়। যেমন হয় গুজরাত, পঞ্জাব, পুদুচেরিতেও।

আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বপ্রথম স্কুল-কলেজ খুলতে শুরু করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে, ২০২০ সালেই খুলে গিয়েছিল তাদের স্কুল। ডেনমার্কে ১০ জন করে মাইক্রো গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের, এবং দু’টি শিফটে ৫০ শতাংশ করে আসে ছাত্রছাত্রীরা। বলা হয়, প্রতিটি মাইক্রো গ্রুপ এক সঙ্গে ক্লাস করবে এবং খাবে, অন্য গ্রুপের সঙ্গে তাদের দেখা হবে না। প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজ়েশনের বিরতি দেওয়া হয়, এবং টিকাকরণও শুরু হয় দ্রুত। সুইডেনে মাত্র দু’মাসের জন্য বন্ধ হয়েছিল স্কুল, তার পর থেকে খোলাই আছে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ইংল্যান্ডে স্কুল খোলে ৫০ শতাংশের মডেলেই, টিকাকরণের পরে। কিন্তু, জনসংখ্যার কারণে মাইক্রো গ্রুপ করা সম্ভব হয় না। তবে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের মতো হয় না ফলাফল। স্কুল খোলার পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাড়তে থাকে করোনা। পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে যখন কোভিড রোগী ০.৮%, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তা দাঁড়ায় প্রায় ৩%।

আর আমেরিকা? যাদের ভয়াবহতা হার মানিয়েছে উপমহাদেশকেও, তাদের সিদ্ধান্তগুলো কেমন ছিল? সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে টিকাকরণ সেরে খুলেছে সব স্কুল, এবং খোলামাত্র এক সপ্তাহেই ২৫০০ ছাত্রছাত্রী আক্রান্ত হয়েছে কোভিডে, যার মধ্যে মারা গিয়েছে ৫২০ জন। এর আগে, গত বছর অগস্টে স্কুল খোলে আমেরিকায়, প্রায় কোনও কোভিড বিধি, এমনকি বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার ছাড়াই, এবং আক্রান্ত হয় ৫৫,০০০-এরও বেশি ছাত্রছাত্রী। একেবারেই অনুকরণযোগ্য নয়, নিঃসন্দেহে, তবু বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির এই অবস্থান নিয়ে আলোচনা নিশ্চয়ই জরুরি।

ভারতে টিকাকরণের সংখ্যা একশো কোটিতে পৌঁছেছে। কিন্তু, সত্যিই কত জন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী একটি বা দু’টি ডোজ় পেয়েছেন? মনে রাখতে হবে যে, নবম থেকে একাদশ শ্রেণি, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা টিকার আওতাতেই পড়ে না। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় আমরা তাদের বিপদের সামনে ছেড়ে দিচ্ছি।

ঘুরে দাঁড়াতে হবে, এ কথা সত্যি। ছাত্রছাত্রীহীন শিক্ষাঙ্গন, ভেঙে পড়া স্কুলের থাম যেমন ভাল লাগে না অভিভাবকদের, তেমনই শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও।

কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এটা ঠিক সময় তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

school Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE