Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৬০তম জন্মতিথি
Swami Vivekananda

এক অনাসক্ত মানবপ্রেমিক

মাত্র ঊনচল্লিশ বছরে দেহাবসান হয়েছিল তাঁর, সংবেদনশীল মনের অধিকারী ছিলেন, দেশের মানুষের ভাল, আর বিশ্বের মানুষের সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৪৮
Share: Save:

কেবল মানুষের আধ্যাত্মিক-জাগরণের জন্য কর্মনিষ্ঠ ছিলেন না স্বামী বিবেকানন্দ, পরাধীন ভারতবর্ষের সমাজ-সংসারে নানা অপপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র লড়াই করেছিলেন। এই জন্য তাঁকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেই প্রতিকূলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসেছিল সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে। তাঁর বিপ্লবী ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ঠিক কথাই লিখেছেন যে, এই সন্ন্যাসী পুরোহিততন্ত্র ও জাতিভেদপ্রথার অন্ধ প্রচারকদের হাতে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের নামে যাঁরা গর্ভাধান প্রথা, বালবিবাহ, গোমাতার ঐকান্তিক সেবা বুঝতেন বিবেকানন্দের তাঁদের প্রতি গভীর বিরক্তি ছিল। অলৌকিকত্বে অন্ধবিশ্বাস তাঁর ছিল না, ধর্মের নামে বিভিন্ন ম্যাজিক দেখিয়ে লোক ঠকানোর আয়োজন করতেন যাঁরা, তাঁদেরকে নিয়ে উদ্বোধন পত্রিকার পাতায় কৌতুক-কাহিনি রচনা করেছিলেন। সে লেখা পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ জাতীয় লেখারই যেন পূর্বরূপ। ‘ভাববার কথা’-য় বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল ভট্টাচার্য্য মহা পণ্ডিত, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খবর তাঁর নখদর্পণে। ... কৃষ্ণব্যাল মহাশয় না জানেন এমন জিনিষটীই নাই, বিশেষ টিকি হ’তে আরম্ভ করে নবদ্বার পর্য্যন্ত বিদ্যুৎপ্রবাহ ও চৌম্বুকশক্তির গতাগতিবিষয়ে তিনি সর্ব্বজ্ঞ।” পড়লে না-হেসে উপায় নেই।

স্বামী বিবেকানন্দের এই অপছন্দের পাশাপাশি তাঁর পছন্দের বিষয়গুলি খেয়াল করা উচিত। মাত্র ঊনচল্লিশ বছরে দেহাবসান হয়েছিল তাঁর, সংবেদনশীল মনের অধিকারী ছিলেন, দেশের মানুষের ভাল, আর বিশ্বের মানুষের সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন। সমমর্মী গুরুভাইদের নিয়ে সেবাব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিদেশিদের কাছে পরাধীন দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকগুলি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই ভাবনাসূত্রগুলিকে বিশেষ সাংগঠনিকতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল তাঁকে। খুবই কঠিন ছিল সে কাজ। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি চিন্তকেরা অনেকেই সন্ন্যাস আশ্রমটিকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাইছিলেন। এমনিতে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই চতুরাশ্রমের ধারণা সুপ্রচলিত। বানপ্রস্থ পরবর্তী সন্ন্যাস আর গার্হস্থাশ্রমে প্রবেশ না করেই সন্ন্যাসগ্রহণ দুই এক নয়। কেন এই সন্ন্যাস? তার উদ্দেশ্য কি কেবল মোক্ষ বা মুক্তি লাভ? বিবেকানন্দ কিন্তু সন্ন্যাস বলতে কেবল মোক্ষমুখী জীবনচর্যাকে মাত্র বোঝাননি। নিষ্কাম কর্ম ত্যাগ করেননি। তাঁর সেবাব্রত, দেশের কাজ সবই নিষ্কাম কর্মের নিদর্শন।

এই কাজের জন্য সন্ন্যাসীদের সংগঠন গড়ে তুলতে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন। বিবেকানন্দের সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল দেখার মতো। তিনি কখনও নিজেকে সংগঠনের প্রধান-পুরুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। গুরুভাইদেরকে দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের পাশে থেকেছেন। কী ভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে সন্ন্যাসীদের এই সংগঠনটি চালানো যায় সে-বিষয়ে নানা পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছেন। গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দকে ১৮৯৬ সালে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “একজন প্রপোজ করিল, অমুক এক বৎসরের জন্য মহান্ত হউক। সকলে হাঁ কি না কাগজে লিখিয়া একটা কুম্ভে নিক্ষেপ করিবে।” সন্ন্যাসী সঙ্ঘের কার্যপরিচালনায় এই গণতান্ত্রিকতার নিদর্শন অভিনব। ১৮৯৭ সালে স্বামী শুদ্ধানন্দকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “এখন মনে হচ্ছে— মঠে একসঙ্গে অন্ততঃ তিনজন করে মহান্ত নির্বাচন করলে ভাল হয়; একজন বৈষয়িক ব্যাপার চালাবেন, একজন আধ্যাত্মিক দিক দেখবেন, আর একজন জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করবেন।” সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি কেবল বড় বিষয়েই খেয়াল রাখতেন না ছোট ছোট বিষয়েও তাঁর সমান নজর ছিল। রামকৃষ্ণানন্দকে লেখা চিঠিটিতে জানিয়েছিলেন, “একটি ছোট ঘর থাকিবে তামাক খাইবার জন্য। তদ্ভিন্ন অপর কোনও স্থানে তামাক খাইবার আবশ্যক নাই।” আবার “যিনি গালিমন্দ বা ক্রোধাদি করিতে চান তাঁহাকে ওই সকল কার্য মঠের বাহিরে যাইয়া করিতে হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলি পড়লে বোঝা যায় তাঁর মনে প্রত্যাহারের সুরটি ধ্রুবপদের মতো ক্রিয়াশীল। ‘সখার প্রতি’ কবিতায় লিখেছিলেন, “ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন— / মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।” সুখ-দুঃখ-মৃত্যু-অমৃত’র বাইরে যে অনাসক্ত মন সেই মন কী দিতে পারে? “অনন্তের তুমি অধিকারী, প্রেম-সিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,/ দাও-দাও যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।” জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি যাপন করছিলেন অধ্যয়নে, গুরুভাই ও শিষ্যদের সাধ্যমতো বলছিলেন তাঁর ভাবনা ও উপলব্ধির কথা। কুকুর, ছাগল, হাঁসের সাহচর্যে সময় কাটাচ্ছিলেন। নিজের হাতে রান্না করে পরম যত্নে খাইয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে।

এই মানুষটিকে কোনও কায়েমি স্বার্থের সপক্ষে ব্যবহার করার সাম্প্রতিক কৌশলী প্রয়াসের বিরোধিতা করতে গেলে বিবেকানন্দের রচনাবলি ও জীবনবৃত্তান্ত অনুসরণ করা উচিত। কেবল পুজো না করে তাঁর লেখা মন দিয়ে পড়া জরুরি।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekananda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy