অভিষেক: দলের বিজয়ী বিধায়কদের সঙ্গে ডিএমকে-র নেতা, তামিলনাড়ুর নতুন মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন (বাঁ দিক থেকে চতুর্থ)। চেন্নাই, ৪ মে। পিটিআই।
গত মাসের ৬ তারিখ যখন তামিলনাড়ু আর কেরলে ভোট হল, তখনই একটা কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল: অতিমারি মানুষকে ভোট দেওয়া থেকে আটকাতে পারেনি। আর, এই মাসের ২ তারিখ স্পষ্ট হয়ে গেল আর একটা কথা— বিজেপি যতই চেষ্টা করুক, যত চমকদার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই দিক, এই দুই দক্ষিণী রাজ্য এখনও তাদের বিশ্বাস করতে কম-বেশি নারাজ। তামিলনাড়ু কম, কেরল খুব রকম বেশি।
স্বাধীনতার পর থেকেই তামিলনাড়ুতে যত বার নির্বাচন হয়েছে, সেখানে সব সময়ই কোনও না কোনও ‘অতিমানবিক’ চরিত্র ছিলেন সেই যুদ্ধের কেন্দ্রে। এমন নেতা, যাঁদের টানে ভেসে আসত মানুষ; যে কোনও নির্বাচনে একমাত্র প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতেন তাঁরাই। এই বিধানসভা ভোটে তেমন কেউ ছিলেন না। এ বারে এক দিকে ছিলেন এম কে স্ট্যালিন— করুণানিধির পুত্র, দীর্ঘ দিন ধরে রাজা হওয়ার অপেক্ষায় থাকা রাজপুত্র। প্রথম বার ভোটে জেতেন ১৯৮৯ সালে। দেশের অন্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে তাঁর একটা বড় ফারাক আছে— তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক কাজে হাত পাকিয়েছেন দীর্ঘ দিন ধরে। এক সময় চেন্নাইয়ের মেয়রও হয়েছিলেন।
এই ভোটযুদ্ধে তাঁর বিপরীতে ছিলেন এক ‘অজ্ঞাতকুলশীল’ নেতা। ‘আম্মা’ জয়ললিতার মৃত্যুর পর বহু ডামাডোল পেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হলেন পলানীস্বামী, কিন্তু তাঁর সাফল্য বিষয়ে কেউ বিশেষ আশাবাদী ছিলেন না। তাঁর শাসনকালে পলানীস্বামী বরং অবাকই করলেন একটু। দলকেও চালিয়ে নিয়ে গেলেন, ক্ষমতাও ধরে রাখলেন। জয়ললিতার ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠাও করলেন। রাজ্যের মানুষও তাঁর প্রতি খুব বিরক্ত, এমন কথা বলা যাবে না। কিন্তু, তার পরও এই নির্বাচনে জিতে ফিরতে পারলেন না তিনি।
কেন? প্রথম উত্তর— এ বার এআইএডিএমকে-র কাছে আম্মা ছিলেন না। দ্বিতীয় কারণ হল, তাঁর দল পর পর দু’দফা ক্ষমতায় ছিল। তামিল রাজনীতিতে এটাই রীতিমতো কঠিন কাজ। টানা তিন বার ক্ষমতায় ফিরেছিলেন শুধু কামরাজ আর এমজিআর। ‘অতিমানব’রা যা পারেন, পলানীস্বামীর কাছে তা প্রত্যাশা করা কঠিন।
তৃতীয় কারণটি হল বিজেপির সঙ্গে জোট। অনেক ভোটারই সন্দেহ করছিলেন যে, আসলে বিজেপিই বকলমে রাজ্যে সরকার চালাচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তামিলনাড়ুর সরকারের দোদুল্যমানতা সেই সন্দেহকে আরও গভীর করেছিল। বিজেপিকে অপছন্দ করার একাধিক কারণ রাজ্যের ভোটারদের আছে। কন্যাকুমারীর মতো জায়গায়, যেখানে জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলমান আর খ্রিস্টান, সেখানে মানুষ বিজেপির সঙ্গে জোটের কারণে এআইএডিএমকে কর্মীদের উপর রীতিমতো চটে ছিলেন। এই দুই দলের কর্মীদের মধ্যেও কখনও যথাযথ সমন্বয় গড়ে ওঠেনি। ঘটনা হল, রাজ্যে বিজেপি যে চারটে আসনে জিতেছে, তাতেও অনেকেই ঘোর বিরক্ত। লক্ষণীয়, নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর ডিএমকে একে ‘সনাতন শক্তির বিরুদ্ধে দ্রাবিড়দের জয়’ আখ্যা দিয়েছে।
রাজ্যে বন্নিয়ার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস (এমবিসি) হিসেবে ১০.৫ শতাংশ সংরক্ষণের অধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও অন্য এমসিবি শ্রেণিভুক্ত জাতির লোকেরা ভাল চোখে দেখেননি। তাঁরা সম্ভবত জোটবদ্ধ ভাবে এআইএডিএমকে-র বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। জোটসঙ্গী পিএমকে-র স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে পলানীস্বামীকে বড় খেসারত দিতে হল।
আর এক জনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়— প্রশান্ত কিশোর। এ বার ডিএমকে-র রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি স্থির করার কাজে সহায়তা করেছিল আইপ্যাক। ভোট চলাকালীন চেন্নাইয়ে যেতে হয়েছিল। দেখলাম, নাচ-গানে জমজমাট ডিএমকে-র জনমুখী কর্মসূচির প্রচারভিডিয়ো না দেখে ইউটিউবে কিচ্ছুটি দেখা সম্ভব নয়।
তবে, এআইএডিএমকে যে শেষ অবধি মুছে যায়নি, সেটা কম কথা নয়। তামিলনাড়ুর ভোটাররা সাধারণত এক পক্ষকে ঢেলে ভোট দেন, আর অন্য পক্ষ শূন্যের কাছাকাছিতে নেমে যায়। এই বার পলানীস্বামীরা ৩৩.২৯% ভোট পেয়েছেন, ডিএমকে পেয়েছে ৩৭.৭%। তামিল রাজনীতিতে ভেসে থাকার মতো রসদ পলানীস্বামী পেয়ে গেলেন।
অন্য দিকে, কেরল ফিরিয়ে আনল বাম জোটকেই। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট যখন সব বয়সি মহিলাদের (ঋতুমতী মহিলাদেরও) শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশাধিকার দিল, মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন খানিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই রায় কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিলেন— তার ধাক্কা লেগেছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের গায়ে। রাজ্যের ২০টি আসনের মধ্যে ১৯টিই জিতেছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ। ২০১৮ সালের ৮টি আসন থেকে কমে মাত্র একটিতে নেমে এসেছিল এলডিএফ। যে রাজ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগে সহজে আঘাত লাগে না, সেখানেও যে একটা ধর্মীয় প্রশ্ন নির্বাচনের রং বদলে দিতে পারে, বোঝা গিয়েছিল। তবে, সেই ধর্মীয় হাওয়াতেও কেরল বিজেপিকে একটি আসনও দেয়নি।
শবরীমালার ক্ষোভের পাশাপাশিই কেরলে এলডিএফ সরকার জড়িয়ে পড়ছিল ছোট-বড় নানান কেলেঙ্কারিতে। সবচেয়ে বড় কাণ্ডটা ছিল সোনা চোরাপাচার কেলেঙ্কারি, যার মূল অভিযুক্ত আঙুল তুলেছিল কেরলের মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ও স্পিকারের দিকে। এবং, এই ঘটনা ঘটেছিল নির্বাচনের ঠিক আগে, ২০২১ সালের মার্চে। এর পাশাপাশি আর একটা কথাও মনে রাখা দরকার— ১৯৭৭ সালের পর কেরলে কখনও ক্ষমতাসীন সরকার ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরেনি।
এই অবস্থায় এলডিএফ জিতে ফিরল তো বটেই, আসনসংখ্যা ৯১ থেকে বাড়িয়ে ৯৯ করে ফেলল। কী ভাবে? প্রথম উত্তর হল, কোভিড। ২০২০ সালে অতিমারি সামলানোর যুদ্ধের প্রথম দফায় কেরল দেশের অন্য যে কোনও রাজ্যকে গুনে গুনে দশ গোল দিয়েছিল। এমনকি, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতেও কেরলের কনট্যাক্ট ট্রেসিং প্রক্রিয়া একেবারে প্রথম সারির ছিল। নিপা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরেই কেরল অতিমারি সামলানোর স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি করে নিয়েছিল। ফলে, বিজয়নের কৃতিত্ব প্রাপ্য। শুধু গত বছরের কথাই বা কেন— এই দফায় যেখানে কেরলে ভয়ঙ্কর ভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছে, দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী এই রাজ্যেই, সেখানে সতেরো লক্ষ আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। গোটা দেশে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় মৃত্যুর সর্বনিম্ন হার কেরলেই।
পিনারাই বিজয়নকে তাঁর রাজ্যের লোক লৌহমানব হিসেবে দেখেছেন। দুর্নীতির অভিযোগই হোক, বা অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই, পিনারাই অটল। কোভিড পর্বে তিনি প্রতি দিন সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, সরাসরি পৌঁছে গিয়েছেন রাজ্যের মানুষের কাছে। অন্য দিকে, আদালত বিজয়নের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রসঙ্গে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছয়নি, ফলে সেই অভিযোগ থেকে বিরোধীরা তেমন লাভ করতে পারেননি।
বিজয়নের সরকার কেরল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বোর্ডকে বলেছিল, ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড বেচে টাকা তুলতে। তার ফলে জন্ম হল একটি ঐতিহাসিক দৃশ্যের— এক কমিউনিস্ট রাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে দেখা গেল, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের ঘণ্টা বাজিয়ে এই বন্ডের সূচনা করছেন! বন্ড থেকে যে টাকা উঠল, তা খরচ হল উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক খাতে— সরকারি স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তার পিছনে। আর্থিক ভাবে অনগ্রসরদের জন্য বাড়ি তৈরির প্রকল্প চালু হল। এলডিএফ-এর নির্বাচনী ইস্তাহারে বলা হয়েছে যে, যাঁরা পেনশন পান, তাঁদের টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে।
সব মিলিয়ে রাজ্যবাসী বিজয়নের প্রতি প্রসন্ন। অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তিনি যখন রাজ্যবাসীর কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন, সবাই সাধ্যমতো সাড়া দিয়েছিলেন সেই ডাকে। ২০২০ সালের জেলা পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের ১৪টি জেলার মধ্যে ১১টিতেই জিতেছিল এলডিএফ। কেরলের বিধানসভায় গত দফায় এক জন বিজেপি বিধায়ক ছিলেন— এ বছর সেটুকুও থাকল না। বিজেপির ভোট ১৫% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৩ শতাংশে। এলডিএফ-এর ভোট বেড়েছে, ইউডিএফ-এরও।
দাক্ষিণাত্যের দুই রাজ্যই বিজেপিকে শূন্য হাতে ফিরিয়েছে। কিন্তু, নিশ্চিন্ত না হওয়াই ভাল। বিজেপি পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের পাল্টাতে জানে। জাতীয় স্তরে যদি বিজেপির বিকল্প শক্তি তৈরি না হয়, আজ না হোক পরশুর পরের দিন এই রাজ্যগুলিতেও গৈরিক ছোপ লাগবে, সেই আশঙ্কা থাকছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy