Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2023

পুজো নিয়েই সারা বছর, পুজো থেকে সরতে বললেই প্রদীপ নিভে যাবে যে

রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ২০০৯ সালে অসিতদার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হল পুজোর দায়িত্ব। অসিতদা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেন ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ করলেন না। নিজের বন্ধুবান্ধব-প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গীদের নিয়ে তৈরি করে ফেললেন মর্নিং টি ক্লাব।

Some interesting characters of Kolkata Durga Puja

চলছে প্যান্ডেল তৈরির কাজ। ছবি: সংগৃহীত।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
দেবদূত ঘোষঠাকুর
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:০০
Share: Save:

গুরু

একজনকে চিনি প্রায় ২৮ বছর। দ্বিতীয় জনের সঙ্গে পরিচয় বছর কুড়ি হবে। তিনটে বিষয়ে দু’জনের ভীষণ মিল। প্রথমত, দু’জনই ঝড়, জল, বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রাতর্ভ্রমণ করবেনই, করবেনই রোজকার শারীরিক কসরৎ। দু’জনকেই কখনও অসুস্থ হতে দেখিনি। দ্বিতীয়ত, দু’জনেই ঘোরতর স্বাধীনচেতা। আর তৃতীয় মিল হল, দু’জনেই পুজো-সর্বস্ব। ছোট পুজোকে কী ভাবে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে হয় তার রেসিপি দু’জনেরই করায়ত্ত। আর দুর্গাপুজোর সূত্রেই ওঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়। বলা যেতে পারে দুর্গাপুজোর রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে ওঁরা আমার পথপ্রদর্শক। কারণ আনন্দবাজার পত্রিকা আমাকে হঠাৎ করেই পুজো রিপোর্টিংয়ের দায়িত্ব দেওয়ার আগে পুজো নিয়ে আমার কোনও উৎসাহই ছিল না।

তাঁর পুজোর ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে তুলোধনা করায় প্রথমজন এক মহাসপ্তমীর সকালে গাড়িতে চেপে সপার্ষদ হাজির হয়েছিলেন আমার বাড়িতে। আপনি দিয়ে শুরু। এক বছরেই তা তুই-তুমির সম্পর্কে পরিণত হল। পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেলেন ঢাকুরিয়ার বাবুবাগান ক্লাবের অসিত মণ্ডল।

রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ২০০৯ সালে অসিতদার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হল পুজোর দায়িত্ব। অসিতদা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেন ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ করলেন না। নিজের বন্ধুবান্ধব-প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গীদের নিয়ে তৈরি করে ফেললেন মর্নিং টি ক্লাব। ফের ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অসিতদা। বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া, পিকনিক, নাট্যোৎসব এ সবেই দিব্যি সময় কেটে যাচ্ছিল।

২০১১ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বাবুবাগান ফের ডাকল অসিতদাকে। অভিমান ভুলে এলেন তিনি। বৌদি বলতেন, ‘বাবুবাগানের পুজোটা ছিল ওর সব থেকে প্রিয় সন্তান।’ কিন্তু প্রত্যাবর্তনের পরে যথাযোগ্য সম্মান পেলেন না। সন্তানের কাছ থেকে দ্বিতীয় আঘাতের পরে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বরাবরের মতো ছেড়ে এলেন তাঁর প্রিয় পুজো। এখন মজা করে নিজেকে বলেন, ‘পুজো পর্যটক’। আর সেই পুজো পর্যটনে বেরিয়ে তুলে আনেন অনন্য সব মণিমুক্তো। কারওর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত, কারওর কাজে হতাশ— চেপে রাখতেন না অসিতদা। প্রকাশ করে ফেলতেন।

বাবুবাগানে অসিতদার পতাকা বহন করার মতো কেউ ছিল না। কিন্তু বড় রাস্তার উল্টোদিকে অসিতদার পথ অনুসরণ করেই একজন নিজেকে গড়ে তুলছিল নীরবে। বস্তি ঘেঁষা সেই পুজোর নেতৃত্ব দিচ্ছিল রতন দে নামে সাদামাটা এক যুবক। বাবুবাগান যখন পড়তির মুখে, যোধপুর পার্ক যখন পড়ছে, তখন শূন্যস্থান পূরণ করতে দ্রুত উঠে আসছে ৯৫ পল্লি। পুজো সংগঠনের ক্ষেত্রে অনেকেই রতন দের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করেছেন ‘নব্য অসিতদা’-কে।

৯৫ পল্লির এ বছরের প্রতিমা।

৯৫ পল্লির এ বছরের প্রতিমা। —নিজস্ব চিত্র।

দ্বিতীয় জনের সঙ্গে আলাপ বড় পুজোর আড়ালে পড়ে থাকা সম্ভাবনাময় পুজোগুলোকে খুঁজে বের করার প্রক্রিয়ায়। সকালে-দুপুরে-রাতে যখনই নির্মীয়মাণ মণ্ডপে যাই, দেখি একজন ঠিক সেখানে হাজির। একমাথা কালো (পরে জেনেছি ওটা কলপ করা) কোঁকড়া চুল, জিনসের প্যান্ট, ওপরে হয় টি-শার্ট বা পাঞ্জাবি পরিহিত মধ্যবয়সী ‘যুবক’। ২০ বছরের পরিচয়। সঠিক বয়সটা ঠাওর করতে পারলাম না আজও। তাই পার্থবাবু থেকে উনি পার্থদা হলেন না কোনও দিনও। কে বলবে বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রী! পুজো এলেই সব ভুলে থাকেন লেক টেম্পল রোডের শিবমন্দির পুজো কমিটির পার্থ ঘোষ।

অসিতদার মতো পার্থবাবুরও দুই ছেলে। দু’জনের স্ত্রীরই অনুযোগ থাকত, ‘কোথা থেকে যে ছেলেরা বড় হয়ে গেল উনি জানেনই না। কোনও বিষয়কেই আমল দেন না। সময় কোথায়?’ আর এই দু’জন পুজো-প্রেমীই বলতেন, ‘সংসারে কোন কাজটা আটকাচ্ছে বলুন তো?’ অনুযোগের সুরে বলতেন, ‘নিয়ম করে বছরে একবার বা দু’বার বেড়াতে যাই, ফাইফরমাস খাটি, আত্মীয়তা কিংবা সামাজিকতাকে (পড়ুন শ্বশুরবাড়ির) গুরুত্ব দিই। আমাদেরও তো একটা রিল্যাক্সেশন চাই। সেটা পুজো। বাঁচার অক্সিজেন।’

অসিতদা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে পুজো সংগঠন ছেড়ে দেন ২০০৯ সালে। সেই সময়টা তিনি কেমন একটা হয়ে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের এই উচ্চপদাধিকারীকে পাশের একটা পুজো সেই সময়ে আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। অসিতদার ছোঁয়ায় সেই পুজো সেবার সুপার হিট। বাজেট তেমন কিছু বাড়েনি, কিন্তু সাংগঠনিক দিকটা কড়া হাতে থাকায় অপচয় কমেছে। যে শিল্পী ঠাকুর বানিয়েছেন, যিনি মণ্ডপ তৈরি করেছেন, যিনি আলোকসজ্জা পরিচালনা করেছেন তাঁদের সবাইকে অসিতদার কড়া নজরদারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। পুজো কমিটির লোকেরা কে কী করবেন তা লিখে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন নির্মীয়মাণ মণ্ডপে। কবে কাকে তার নির্দিষ্ট কাজটা শেষ করতে হবে তা নামের পাশে লেখা থাকত। কাজের হিসেব নেওয়া হত প্রথমদিকে সপ্তাহে একবার। তারপরে সপ্তাহে তিনবার। আর মহালয়ার সাতদিন আগে থেকে প্রতিদিন, দু’বেলা।

এই ফর্মূ্লা প্রয়োগ করেই বাবুবাগানের পুজোকে মহীরুহ করে তুলেছিলেন অসিতদা। সেই ফর্মুলায় একটু অদলবদল করে পরবর্তী কালে অন্য পুজো কমিটিগুলোও সমান ভাবে সফল। তার মধ্যে দুটো পুজো তো কলকাতার সেরার সেরা হয়ে থেকেছে বছরের পর বছর। মেয়েদের আগে পুজো সংগঠনে ব্যবহারই করা হত না। বাবুবাগানে অসিতদার মহিলা বাহিনী অসাধ্য সাধন করেছিল। এমনকি ভিড় সামলানোর মতো অতি কঠিন কাজটাও হেলায় করে দেখাত ওই বাহিনী। অসিতদার স্ত্রী নেতৃত্ব দিতেন ওই বাহিনীর। ঘরে বাইরে চাপ সামলে অসিতদা তাই হয়ে উঠেছিলেন সেরা পুজো সংগঠক। রাজনৈতিক ডামাডোলে ছিটকে যাওয়ায় বাবুবাগানের পুজো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল (যদিও সেখানে এখনও অসিতদার ফর্মুলাই ব্যবহৃত হয়ে আসছে, কিন্তু দক্ষ চালকের অভাবে গাড়ি দ্রুত চলেনি)। আর পরবর্তী প্রজন্মের পুজো উদ্যোক্তারা খুঁজে পায়নি তাঁদের যোগ্য শিক্ষককে।

বাবুবাগানের দেবীমূর্তি।

বাবুবাগানের দেবীমূর্তি। —নিজস্ব চিত্র।

হোর্ডিংয়ে কী লিখলে মানুষ সেই পুজোর দিকে আকর্ষিত হন, তারও উদ্ভাবক অসিতদা। কেন্দ্রীয় সরকারের একটা সংস্থার পদস্থ কর্তা অসিতদার অফিসটা ছিল আরএন মুখার্জি রোডে। আমার অফিসের খুব কাছে। এপ্রিল-মে মাসে হয়তো গিয়েছি সেই অফিসে, দেখি ঘরে হয় পুজোর কোনও শিল্পী বা পুজোর সঙ্গে জড়িত কেউ বসে। আড্ডার বিষয়বস্তুও পুজো সংক্রান্ত। কেউ আগের বারের পুজোর পাওনা নিতে এসেছেন, কেউ বা পরের বছরের পুজোয় কী করা যায় তা নিয়ে আলোচনায় মত্ত।

পুজোর সংগঠনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পরেও পুজো কিন্তু ছাড়েনি অসিত মণ্ডলকে। কোথায়, কোন শিল্পী, কী ধরনের কাজ করছেন তা মুখস্থ তাঁর। যত দিন কাগজে পুজোর লেখা লিখেছি, অসিতদার মূল্যবান বিশ্লেষণ খুবই কাজে লেগেছে। পুজোর দিনগুলোতে অসিতদা ভোর সাড়ে তিনটের সময়ে বৌদিকে স্কুটিতে চাপিয়ে নিয়ে বেরোতেন। তখন মণ্ডপগুলোতে ভিড় থাকে না। এক একদিন এক এক অঞ্চলে ছুটত স্কুটি। দশমীর সকালের মধ্যে সব পুজো দেখা শেষ। দ্বিতীয়ায় আমার সব প্যান্ডেল দেখা হয়ে যেত। আমি ঘুরতাম পেশার তাগিদে। তার সঙ্গে অবশ্যই নেশার মিশ্রণ ছিল। আর অসিতদা ঘুরতেন পুজোর প্রতি ভালবাসা থেকে।

অসিতদার চোখকে আমি বলতাম জহুরির চোখ। কেন, তার জন্যে এই গল্পটাই যথেষ্ট। বৌদিকে নিয়ে এক ভোরে ঠাকুর দেখতে গিয়েছেন অসিতদা। বেহালার এক মণ্ডপ থেকে আমাকে ফোন। তখন সকাল ছ’টা হবে। একটা পুজোর নাম করে বললেন, ‘আমি দেখছি, সেটা ঠিক কী না তা জানতেই এত সকালে ফোন করছি। তুই কি জানিস গত বছরে অন্য পুজোয় ওদের এ বারের ফাইবার গ্লাসের প্রতিমাটা ছিল? আমি কিন্তু শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত।’

আমি বিষয়টা আগেই জানতাম। কিন্তু পুজোর মুখে কেলেঙ্কারি হবে, এমনকি আইন-শৃঙ্খলার সমস্যাও হতে পারে। তাই জেনেও চেপে গিয়েছিলাম। আমি জেনেও কেন লিখিনি সেটা অসিতদাকে বুঝিয়ে বললাম। ওই প্রতিমাই আগের বছর দক্ষিণ কলকাতার একটা অনামী পুজোয় পূজিত হয়েছিল। প্রতিমাটা ফাইবার গ্লাসের। তাই জলে ভাসান হয়নি। বিদেশে তো এমন আকছার হয়েই থাকে। এক প্রতিমাতেই বারবার পুজো হয়। তবে দুটোর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। বিদেশে পুজো কমিটির সবাই এটা জানে। এটাই দস্তুর। কিন্তু এখানে যা হয়েছে সেটা প্রতারণা। শিল্পী উদ্যোক্তাদের কিছুই জানাননি। এটা আগে জানাজানি হলে তা হত ওই পুজো কমিটি এবং পাড়ার মানুষের কাছে একটা বড় ধাক্কার ব্যাপার। শিল্পীর বাড়ি ক্লাবের কাছেই। তার বাড়িতে হামলা পর্যন্ত হতে পারত।

এই বিষয়টা পরে আমি পুজো কমিটির এক কর্তাকে জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম ঠাকুর ভাসান দিয়ে দিতে। আর পুজোর আগেই শিল্পীকে খুব গালাগালি দিয়েছিলাম। সেবার ভাসান না দিলে ওই শিল্পী ফের হয়তো ওই প্রতিমা অন্য কোনও পুজোয় চালান করে দিত। সব পুজো ঘুরে দেখা চাই, এমন লোক বেশ কয়েকজন আছেন। কিন্তু ঠাকুর নিয়ে বিচ্ছিরি এই প্রতারণাটা ধরতে পেরেছিলাম শুধু দু’জন। আমি আর ‘জহুরি’ অসিতদা।

যে সমস্যাটার জন্যে অসিতদার মতো পুজো সংগঠকের কাছ থেকে বস্তুতপক্ষে বাবুবাগানের পুজো কেড়ে নেওয়া হল, সেই সমস্যাটা পার্থবাবুর পাড়ায় কিন্তু ছিল না। লেক পাড়ায় পুজোয় কেউ আর যেচে আসতে চায় না। নিজের কাঁধে এ সব দায়িত্বে তুলে নেওয়ার লোক খুঁজে পেতে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। সক্রিয় রাজনীতির লোক মেলে না সচরাচর। পাড়ার শিবমন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের ভার পড়ার পরে মন্দির লাগোয়া ছোট দুর্গাপুজোর দায়িত্বও পড়ে পার্থবাবুর ওপরে। শিবমন্দিরের পুজোর দায়িত্ব তিনি কবে পেয়েছিলেন তা ওঁর নিজেরই মনে নেই। সেই দায়িত্ব কাকে হস্তান্তর করবেন সেই লোক এখনও পায়নি শহরের অন্যতম বড় পুজোটা। পার্থবাবুর হাত ধরে সেটা এখন মহীরুহ।

অসিতদার পুজোয় যখন ভিড় আছড়ে পড়ছে ১৯৯৮ সালে, তখনও ভিড়ের স্রোত এসে পৌঁছচ্ছে না লেক টেম্পল রোডের পুজোটায়। বেহালার পুজোগুলো ইতিমধ্যে কম খরচে শৈল্পিক মণ্ডপ গড়ে তাক লাগাতে শুরু করেছে। পূর্ব কলকাতার সুনীল নগর, পিকনিক গার্ডেন্সের পুজোগুলো নতুন এক ধারা তৈরি করেছে। আর্ট কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা একদল যুবক নিজেরাই প্রতিমা গড়ছেন, মণ্ডপ তৈরি করছেন, আলো সাজাচ্ছেন। আগে প্রতিমা কেমন হবে সেটা ঠিক করে সেইমতো মণ্ডপ তৈরি হত। আলোর সঙ্গে প্রতিমা বা মণ্ডপের সামঞ্জস্য না থাকলেও চলত। নতুন ধারার পুজোয় আগে মণ্ডপ ও আলোর বিষয়টা ঠিক করা হতো। মণ্ডপ ও আলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হতে থাকল প্রতিমা। সেই ধারার পুজোর নতুন নামকরণ হল ‘থিম’ পুজো। পুজোর বাজেট আয়ত্তের মধ্যেই থাকতে শুরু করল।

শিবমন্দিরের এ বছরের থিম ‘আগল’।

শিবমন্দিরের এ বছরের থিম ‘আগল’। —নিজস্ব চিত্র।

১৯৯৮ সালের পুজোর পরেই মিটিং থাকলেন শিবমন্দিরের পুজো সম্পাদক পার্থ ঘোষ।‌ ওই মিটিংয়েই পার্থবাবু ঠিক করে ফেললেন লোক টানতে শিবমন্দির ১৯৯৯ সাল থেকে থিম পুজো করবে। শিল্পীও ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু থিম ঠিক হল না। শিল্পী ও পার্থবাবু কেউই হাল ছাড়ার পাত্র নন। ‘‘এক দিন বিকেলে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বাস থেকে নেমে পড়লাম। ঢুকে গেলাম বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ভেতরে। দেখলাম মেঝেতে পড়ে আছে কয়েকটা বই। আর সেই বই আমাকে থিমের খোঁজ দিল,’’ বলেছেন পার্থবাবু।

কী ভাবে? পার্থবাবু মেঝে থেকে ‘বাঙলার দেবদেবী’ বলে একটা বই তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকলেন। তাঁর নজর আটকে গেল বিষ্ণুপুরের মালুডি গ্রামের দুর্গাপুজাকে নিয়ে লেখা নিবন্ধে। বছরের ৩৬৫ দিনই সেখানে পুজো হয়। সেই পুজোটাই লেক টেম্পল রোডে তুলে আনবেন বলে ঠিক করলেন পার্থবাবু। আট টাকা দিয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য হলেন। তার পরে ওই নিবন্ধটা ফটোকপি করে নিয়ে গেলেন শিল্পীর কাছে। তার পরেরটা ইতিহাস। সেই শুরু। শিবমন্দিরের পুজোয় গত ২৪ বছর ধরে ভিড়ের ট্র্যাডিশন চলছেই।

পুজোকে কর্পোরেট স্তরে পরিচালনা করার দিশা প্রথম দেখিয়েছিলেন পার্থবাবুই। কেন তাঁর পুজোয় বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত, কেন তাঁর পুজো কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা স্পনসর করবে— মুখে তার ব্যাখ্যা দেওয়া নয়, একেবারে সিডি তৈরি করে পার্থবাবু হাজির হতেন বিভিন্ন সংস্থার দফতরে। নিজের বাচিক ক্ষমতা আর সিডির ‘অডিওভিসুয়াল’ দাগ কাটত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের মনে। পার্থবাবুর কাছ থেকেই পরে এই কৌশল আয়ত্ত করেছিল অন্য পুজোগুলো। পরবর্তী পর্যায়ে ল্যাপটপ, ই-মেল এল— বাণিজ্যিক পর্যায়ের চরম ধাপে পৌঁছে গেল কলকাতার বারোয়ারি পুজো।

পার্থবাবুর স্ত্রী এক সময়ে দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্যে পাড়ি দিলেন দিল্লি। সঙ্গে নিলেন বৌদির চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং শিবমন্দিরের পুজোর সিডি। যা তৈরি হয়েছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর জন্যে। যে সব সংস্থা পুজোয় বিজ্ঞাপনের জন্যে টাকা ঢালে, তাদের অনেকেরই সদর দফতর নয়ডা। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর সদর দফতর সব দিল্লিতে। পার্থবাবু বৌদিকে কেমোথেরাপির জন্যে নিয়ে যেতেন অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস অর্থাৎ এমসে। যত ক্ষণ বৌদির কেমোথেরাপি চলত সেই সময়টা পুজোর কাজে ব্যবহার করতেন। সিডি নিয়ে পৌঁছে যেতেন বাণিজ্যসংস্থার কিংবা কেন্দ্রীয় সংস্থার সদর দফতরে। আদায় করে আনতেন বিজ্ঞাপন। বৌদি বিষয়টা জানতেন। একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘তাও তো একটা কিছু নিয়ে আছে। না হলে আমাকে নিয়ে চিন্তা করেই যেত যে!’ স্ত্রীর সেবা যত্ন বা চিকিৎসায় এতটুকুও ত্রুটি রাখেননি মানুষটা। তবু বৌদিকে আর বেশিদিন ধরে রাখা গেল না। এমতাবস্থায় চরম একাকিত্বের যন্ত্রণা অনেকটাই কাটিয়ে দিলেন মা দুর্গা।

কার্টুনের নায়ক

বড়দিনের উৎসব থেকে পরের বছরের পুজো আসা পর্যন্ত যে ক’টা উৎসব এসেছে, একবার টানা এক বছর ধরে তা জানান দিয়ে এসেছিল দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো কমিটি। রাস্তার ধারে তারা ঝুলিয়ে দিচ্ছিল একটা করে ফ্লেক্স। সেখানে কার্টুনের মাধ্যমে কিছু বলার চেষ্টা হত। কার্টুনে প্রফেসর শঙ্কুর মতো একটি মুখই মুখ্য চরিত্র।

কে সেই ব্যক্তি?

তিনি মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক মায় কাউন্সিলরও নন। রাজনীতির ত্রিসীমানায় নেই তিনি। শিল্পপতি, সেনা কর্তাও নন। নায়ক, অভিনেতা, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, কর্পোরেট কর্তা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিএ নিদেনপক্ষে সাংবাদিকও নন। তিনি একজন পুজো সংগঠক।

এক পুজো সংগঠককে এতটা মাতামাতি কেন?

এটা কলকাতার পুজোর অঙ্গনে তাদের ছোট্ট পুজোটাকে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দেওয়ার স্বীকৃতি। শহরের আর কোনও পুজো উদ্যোক্তার ভাগ্যে এমন সম্মান কখনও জুটেছে কি না তা মনে করতে পারছি না।

ক্লাবের এক তরুণ সদস্যের কথায়, ‘এক গুচ্ছ অতি নামী পুজোর ভিড়ে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকা আমাদের এই পুজোর পরিচিতি তো যাঁর জন্য, তাঁকে তো আমরা এই সম্মানটা জানাতেই পারি।’ যোধপুর পার্ক সর্বজনীন, সেলিমপুর পল্লি, বাবুবাগানের ভিড় ঠেলে এসে একটু জিরিয়ে নিতে কিংবা পায়ের ফোস্কা কতটা বড় হল তা দেখতে ওই ক্লাবের পুজোর পরিসরকে ব্যবহার করতেন মানুষ। খোলা হাওয়ায় একটু অক্সিজেন নিয়ে পরের লড়াইয়ের জন্য তৈরি হতেন।

ওই পুজোর মণ্ডপ তো বটেই, প্রতিমাও দেখতেন না কেউ।

কার্টুনের নায়ক কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে লড়ে ওই পুজোর আবহটাই বদলে দিয়েছেন। লোক এখন প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ওই পুজো দেখতে আসেন দলে দলে। মানুষকে অক্সিজেন নেওয়ার যথেষ্ট জায়গাও রাখা থাকে পুজোয় । জনতা জনার্দনকে ভোলেননি ওই উদ্যোক্তা।

তাঁকে নিয়ে কার্টুন হবে না তো হবে কাকে নিয়ে?

পুজো নিয়ে ওই উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত জীবনে কিন্তু সমস্যার অন্ত নেই। বাইরে চাকরি করতে যাবেন না এটা তাঁর গোঁ। কলকাতায় যে সব চাকরি করেন তাতে পদোন্নতি দিয়ে বদলি করতে চাইলেই তাঁর মন কষাকষি শুরু হয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। শেষমেষ দুম করে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। সাফ কথা, কলকাতায় থাকতেই হবে তাঁকে।

যেখানেই চাকরি করেন সেখানেই প্রথম দিনই জানিয়ে দেন, বছরে ১০ মাস গাধার খাটনি খাটতে রাজি তিনি। কিন্তু পুজোর আগে দু’মাসে প্রয়োজন মতো ছুটি নেবেন তিনি।

তাই ভাল চাকরি জোটেনি কপালে। ২৫ বছরে কতবার যে চাকরি ছেড়েছেন নিজের কাছেও তাঁর পরিসংখ্যান নেই।

বিয়ে করেছেন, একটি মেয়ে আছে। গিন্নি সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকেন। এই বুঝি দুম করে চাকরিটা চলে যায়!

বাড়ি ছিল ক্লাবের পিছন দিকটা। পুজোর ভূত তাড়াতে গিন্নি অনেক অশান্তি করে জমি কেনালেন গড়িয়া স্টেশন রোডের ধারে। বাড়িও হল। কিন্তু তাও আটকে রাখা গেল না। পুজোর ভূত আরও চেপে বসল। মেয়ে তত দিনে অনেকটা বড় হয়েছে। বাড়িতে নিজের সমর্থক একজন পেয়েছেন ভদ্রলোক। ওঁকে দেখে কে? জীবনটাই হয়ে গিয়েছে পুজোময়। মাঝে মাঝেই অন্যদের দায়িত্ব বন্টনের করে দিয়েছিলেন।

তাতে খুব একটা ফল হয়নি। তাই ফের অনুরোধ ঢেঁকি গেলা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উনিই পুজোর সেক্রেটারি । আসলে মাঠে যিনি মেলা করবেন তিনি ওঁর সঙ্গেই টাকা পয়সা নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলেন। তাতে দুই পক্ষেরই না-ঠকার সম্ভাবনা বাড়ে। বিজ্ঞাপনদাতারা ওঁকে চান। ডেকরেটর, ইলেকট্রিশিয়ানের ভরসাও উনি। শিল্পীদের তিনিই সব থেকে ভাল হ্যান্ডল করতে পারেন। সর্বোপরি যে সব মহিলা পুজোর কাজ করবেন এবং যে সব কচিকাচারা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন তাঁদের পছন্দের এক নম্বরেও তিনি। কারণ উনি নিরলস কাজ করতে পারেন। ওঁর উপস্থিতি কাজ করার ইচ্ছা জাগায়।

শুধু কি তাই? কোন দিন ভোগে কি রান্না হবে, কতজনের রান্না হবে, তেল-মশলা , তরিতরকারি কোথা থেকে কিনতে হবে কত প্যাকেট করতে হবে তারও চূড়ান্ত মতামত দেবেন তিনি। এত সব কাজ যদি ওই একটা লোক করতে পারে তা হলে তার এ রকম বন্দনা তো হওয়ারই কথা। বাড়ির লোকের তাই ভয় আরও বাড়ছে। স্ত্রী মাঝে মাঝে ফোন করে কেমন আছি তা জানতে চান। কথা শেষ করেন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে, ‘ওর চাকরি টা আছে তো দাদা?’ সেই তিনি পুজো নিয়েই মেতে আছেন। প্রতিবারই বলেন, ‘‘এটাই শেষ।’’ কিন্তু বৈশাখ মাস এলেই মাথায় পোকা নড়ে ওঠে। শঙ্কিত হয়ে ওঠেন স্ত্রী । তিনি যেন ভোলা মহেশ্বর । বীরদর্পে ঘোষণা করেন, ‘‘চাকরি গেলে যাবে। আর একটা পাব। কিন্তু পুজো ছাড়া বাঁচব না।’’ পুজোই বাঁচার অক্সিজেন নারায়ণ রায়ের। আর নারায়ণবাবুদের জন্যই টিঁকে আছে কলকাতার পুজো।

আমি চার কাঠা

বেহালা আর নিউ আলিপুরের সংযোগস্থলে জেমস লঙ সরণি লাগোয়া আমি চার কাঠা জমি। ডায়মন্ড হারবার রোড মিনিট তিনেকের। নিউ আলিপুর পৌঁছে যাওয়া যায় দশ মিনিটে। আশপাশে হু হু করে উঠেছে বহুতল। কাঠা দুয়েক জমির উপরে ৪০ বছরের পুরনো বাড়ি প্রোমোটারের হাতে তুলে লাখপতি হয়ে গিয়েছেন এক মালিক। আমি ভয়ে কাঁপতাম। কবে দেখব মাপামাপি শুরু হয়েছে। তারপরে আসবে মাটি কাটার যন্ত্র। আমার মখমলের মতো ঘাস চাপা পড়ে যাবে ইট, পাথর, সিমেন্ট, বালিতে। বাড়িতে নতুন কেউ এলে আড়ি পাতি। প্রমোটার নয়তো? গত বিশ-বাইশ বছর ধরে এমন যে কতবার হয়েছে বলতে পারব না। তবু আমি টিকে আছি। বেশ আছি।

ওই জমির উপরে কখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে জমিদার বাড়ি। কখনও চণ্ডীমায়ের থান। কখনও গ্রাম বাংলার বাড়ি। লাউ, উচ্ছে, চিচিঙ্গা ঝুলছে গাছ থেকে। আসল কি না দেখতে কেউ হাত ধরে টিপে টিপে দেখছে। কেউ শুঁকে দেখছে গন্ধ। কেউ কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝখানে এক টুকরো সবুজ পেয়ে শ্বাস নিয়েছেন বুক ভরে।

বছর বছর বদলেছে আমার ভুগোল-ইতিহাস। তাও মাত্র মাস তিনেকের জন্য। সারাদিন সারারাত দাপাদাপি, হাঁকাডাক। কখনও পায়রারা ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায়। সন্ধ্যায় কুলুঙ্গিতে প্রদীপ জ্বলে। শাঁখে ফুঁ পড়ে। পায়রার পাখার ঝটপটানিতে সকাল হয়। কখনও ঠাকুরদালানের সামনে বসে কামান। আর ওই সাতদিন সারাদিন, সারারাত শুধু মানুষ আর মানুষ। কত রকম নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ, পারফিউমের গন্ধ। তাতেই চাপা পড়ে যায় লাখো মানুষের গায়ের গন্ধ। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যায় ভোগের খিচুরির গন্ধ। মনটা শুধু খাই খাই করে যে!

একসময় প্যান্ডেল খোলা শুরু হয়। আবার ফাঁকা পড়ে থাকি আমি চার কাঠা। লম্বা লম্বা ঘাস জন্মায়। আগাছায় ভরে যায়। পরের পুজোয় ভোল পাল্টানোর জন্য অপেক্ষা করি। আমার বর্তমান মালিক যত দিন আছেন, এই সবুজ জমিতে কংক্রিটের জঙ্গল যে কখনই মাথা তুলে দাঁড়াবে না, তা বুঝে গিয়েছি আমি।

বিপদ তো অনেক এসেছে। কিন্তু আমার মালিক অচঞ্চল। এক বার হল কি, পুজোর খরচ উঠছে না। ঠিক হল আমার কিছুটা অংশ বেচে দেওয়া হবে। তাতে পুজোর খরচ উঠে যাবে। কিন্তু আমার জমির মালিক রাজি হলেন না। স্ত্রীর গয়না বেচে পুজোর খরচ তুললেন তিনি। এই শুধু পুজোর জন্যই গোঁ ধরে থাকলেন। আমি বেঁচে গেলাম। তার পরেও কেটে গিয়েছে বিশ-বাইশ বছর। এত দিনেও আমার মালিকের স্ত্রী তাঁর গয়না ফেরত পেয়েছেন কি না জানি না।

জানতেও চাই না। আমি যে এখনও অক্ষত আছি সেটাই অনেক। অপেক্ষায় আছি ফের ভোল বদলের। শিউলির গন্ধে চারিদিক ম ম করছে, ডেকরেটরের লোক এসে ঘুরে গিয়েছে। আমি এখনই ধূপধুনোর গন্ধ পাচ্ছি নাকে। পুজো আসছে যে! আমার মালিকের নামটা জানতে ইচ্ছে করছে নিশ্চয়ই। উনি বেহালা নতুন দলের সন্দীপন ব্যানার্জি।

তিন বগির পুজো

পুলিশ ভয় দেখাচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে, ভয়ে কোনও শিল্পী কাজ করতে চাইছেন না। এমতাবস্থায় অনেক পুজোকর্তাই আমাকে নিয়ে যেতেন কোনও অনুষ্ঠানে। সেখানে আমি পুজোর পক্ষেই কথা বলতাম। পুজোর বিনোদনের থেকে আমার কথায় গুরুত্ব পেত সেই সব মানুষের কথা, পুজো তাদের সারা বছরের পেটের ভাত জোগান দেয়। সেই সব পরিবারকেই উৎসর্গ করতাম পুজো। এই বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রেই মৃত সঞ্জীবনীর কাজ করেছে।

তিন বগির সঙ্গে আমার পরিচয় সে রকম একটা অনুষ্ঠানেই। তিন বগি আসলে তিনটি মানুষ। সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্কের বুলা (পার্থ প্রতিম রায়), বাপি (দেবাশিস সরকার), সুঁটু (দেবাশিস সাহা)। এখন প্রবীণ হওয়ার মুখে ওই তিনজন। পুজো নিয়েই তাঁদের বন্ধুত্ব। যখন আমার বাড়িতে আসতেন, আসতেন তিনজন একসঙ্গে।‌ আমার স্ত্রী ঠাট্টা করে বলত, ‘আপনারা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই? আপনারা দেখি তিনবগির গাড়ি।’ সেই থেকে আমরা মজা করে ওই পুজোকে তিনবগির পুজো বলতাম। ওঁরা সেটা জানতেন।

যেখানে ওঁরা পুজোটা করতেন তার দখল নিয়ে একবার বাঁধল গোল। তৎকালীন শাসক দলের কেউ কেউ পাড়ার লোকদের অনেককে খেপিয়ে দিলেন ওই পুজোর বিরুদ্ধে। আওয়াজ উঠল, পুজো বন্ধ করতে হবে। ওখানে বসানো হল ট্রান্সফর্মার। এ প্রায় ভাতে মারার ব্যবস্থা। কারও কাছ থেকে খোঁজ পেয়ে তিন বগি সটান এসে হাজির আমার বাড়িতে।‌ আমি বললাম, ‘আপনারা যে কোনও একটা অনুষ্ঠান করুন। আমি গিয়ে যা বলার বলব।’ আমি বিদ্যুৎ সরবরাহ দফতরকে বললাম। শাসক দলের পরিচিত কয়েকজনকে বললাম। তারপরে পুজোর পক্ষে আমার যুক্তি তুলে ধরলাম। অনুষ্ঠানে প্রথমে লোক হয়নি। এর পরে মানুষ আগল খুলে ঘর থেকে বেরোলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনছেন অনেকে।

তিনবগির সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থায়িত্ব পেল। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, পালাবদল, আর্থিক ঝুঁকি, নানা জনের নানা কথা— এ সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে তিনবগির এখনও লাইনচ্যুত হয়নি। ওদের ছেলেমেয়েদের এক দিন এতটুকু দেখেছি। এখন কারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কেউ বড় চাকরি করে। তিনবগিকে ঠিক পুজোর আগে দেখা যায় আমার বাড়িতে। ক্লাবের অনুষ্ঠানে পৌঁছে যায় হোয়াসঅ্যাপ। আর কারও বাড়িতে সামাজিক অনুষ্ঠান থাকলে তিনজনেই পৌঁছে যান গলায় গামছা দিয়ে।

নিজেদের মধ্যে টানাপোড়েন কিংবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে অনেক পুজো কমিটি এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। এমনই এক কমিটির এক প্রবীণকে সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্কের কথা বলেছিলাম। ওই প্রবীণের আক্ষেপ, ‘ইস্, আমাদেরও যদি এমন তিনবগি থাকত! ’

এক টুকরো ছেলেবেলা

ফের ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিল নারকেলডাঙার সেই বাড়িটা। অরবিন্দনগর, গুহঠাকুরতা পাড়া, শিশির গুহ ঠাকুরতা-— চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে। ধুতি আর পাঞ্জাবি পরা শিশিরকাকুর অবয়বটা চোখের সামনে‌ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। লম্বা চেহারার শিশিরকাকু আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। দু’জনের সখ্যের ফলে গুহঠাকুরতা পাড়ায় ওই পরিবারটির সঙ্গে আমাদের পরিবারের সবারই হৃদ্যতা ছিল। যেমন শিশিরকাকুর বোনেদের সঙ্গে আমার পিসিদের। ওই হৃদ্যতা ঠিক কতটা ছিল তা জানতামই না, যদি নারকেলডাঙার ওই বাড়িটায় না যেতাম। আসলে শিশির কাকুর এক বোন যে ওই বাড়িটির সর্বময়ী কর্ত্রী!

পূর্ব কলকাতার ধনদেবী খান্না রোডে একটা পুজো মাঝখানে থিম পুজো করে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। পরে পুজোটা সরে এসেছিল পাশের গলিতে। সেই পুজোটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে ওই বাড়িটার তিন ভাই— বাবু, নানু, পানু। আর ওরা শিশিরকাকুর তিন ভাগ্নে। তিন ভাইকে পিছন থেকে পরিচালনা করছেন ওদের মা। শিশিরকাকুর বোন। আমার বাবা, কাকা, পিসিদের নাম মুখে মুখে। দেশভাগের পরে সব ছেড়ে একবস্ত্রে উঠে আসা উদ্বাস্তু পরিবারগুলি মুখের ভাত কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করলেও, আমাদের অরবিন্দনগর কলোনিতে আনন্দের কোনও খামতি রাখত না।

আমাদের ১/২৯ অরবিন্দনগর কলোনির বাড়ির গায়েই অরবিন্দনগর ক্লাব। পুজোর ক’দিন আগে থেকেই আমাদের বাড়িটা গমগম করত। একেই আমাদের বিশাল পরিবার, তার সঙ্গে গুহঠাকুরতা পাড়ার মেয়ে বৌরা চলে আসতেন পুজোর জোগাড়যন্ত্র করতে। আমাদের বাড়িতে বেশ গাছ ছিল। আম গাছ ছিল, জবাব ফুলের অনেক গাছ ছিল। ছিল শিউলি ফুল আর স্থলপদ্মের গাছও। ফোটে যখন সেই পদ্মের রঙ ধবধবে সাদা। যত বেলা বাড়ে, রঙ হয়ে যায় গোলাপি। এ সব প্রকৃতির খেলা। প্রত্যেক বাড়ি থেকে পুরনো শাড়ি সংগ্রহ করে ক্লাবে প্যান্ডেল হত। এই কাজে উৎপলদা, শামুদা, গৌরাঙ্গদা, ফুলুদা, আপুদা, খুশিদাদের ছিল দারুণ উৎসাহ। মাথার উপরে আমার বাবা, শিশিরকাকু, নিমাইকাকু (দত্ত), খোকনকাকুরা (আইচ), বাবুকাকুরা (গুহ বিশ্বাস) থাকতেন মাথায়।

বাড়ি বাড়ি থেকে চাল, ডাল, নুন, চিনি, আলু সংগ্রহ করে রোজ চাপত ভোগের খিচুড়ি। পাড়ার সবার একবেলার খাবার ওই ভোগের খিচুড়ি। গরম গরম খিচুড়ি, তাতে বড় বড় আলু। সপ সপ করে সবাই খাচ্ছে। একবার শেষ হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আরও এক হাতা। গরম খিচুড়িতে জিভ পুড়ত হামেশাই। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। কিন্তু খিচুড়ি ছেড়ে উঠতাম না কেউ। এ তো ভোগ খাওয়া নয়, পাড়ার পিকনিক। পুজোর দিন।

ক্লাবের পাশেই ছিল পুকুর (এখন অবশ্য নেই)। সেখানে ঠাকুর বিসর্জন হত। ঢাক বাজানোর হাতেখড়ি ওই বিসর্জনের দিনে। আমার বাবা কোনও কাজে বেরিয়ে কালীঘাট থেকে নিয়ে এলেন একটা মিনি ঢাক। দুটো সরু সরু কাঠি। বিসর্জনের ঢাকিরা বাজাচ্ছেন, আমি তাদের মাঝখানে হাজির আমার বাজনা নিয়ে। তালজ্ঞানটা আজন্ম। তাই তাল-ছন্দে ব্যাঘাত ঘটেনি। আর একটু বড় হতে পাড়ায় ছোটদের ধুনুচি নাচের সময়ে আমি ঢাক বাজিয়েছি। আর ঠাকুরদা আর বাবা উৎসাহ দিতেন। ঠাকুমা, মা সাহস জোগাতেন। ঢাক বাজিয়ে একবার আঙুলে ফোস্কা পড়ে গেল। ঠাকুমা বেঁধে দিলেন পট্টি। তাঁর ভিতরে কী ছিল জানি না, তবে এটুকু মনে আছে ভিতরে এমন কিছু থাকত, যা ফোস্কার ভিতরের রস শুষে নিত। তার পরেই শুকিয়ে যেত ফোস্কা।

নারকেলডাঙার পুজোর উদ্যোক্তা তিন ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে নিজের শৈশবে ফিরে যাওয়া কেন? আসলে কঠিন পরিস্থিতিতে কী ভাবে সবাই মিলে আনন্দে থাকা যায় ছেলেদের মধ্যে সেই ধনাত্মক তরঙ্গটা প্রবাহিত করেছিলেন বাবু-নানু-পানুর মা। বাবুলের মা তাঁর কিশোরী অবস্থায় সেই শিক্ষা পেয়েছিলেন অরবিন্দনগরের উদ্বাস্তু কলোনির জীবন থেকে। যতবার দেখা হয়েছে, অরবিন্দনগরের কথা বলতেন, ‘জানো, অভাব ছিল। আমরা কিন্তু আনন্দে থাকতাম। কারণ, সবার দুঃখে-সুখে সবাই এককাট্টা থাকতাম।’ মায়ের মুখ থেকে সেই কাহিনী শুনতে শুনতে বাবুরা এখনও পরিবারে, পাড়ায় সবাইকে এককাট্টা রেখেছেন। তাই অনেক সঙ্কটেও টিকে গিয়েছে পুজোটা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy