Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
দুর্গার চিত্রকল্প ঘুরেফিরে এসেছে সত্যজিতের নানা ছবিতে
Satyajit Ray And Durga Puja

পুজোর অনুষঙ্গে সত্যজিৎ

জয় বাবা ফেলুনাথ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯-র গোড়ায়। অর্থাৎ তার শুটিং হয়েছিল তার আগের বছর, হয়তো আশ্বিনে নয়, হয়তো কিছু আগে বা পরে।

An image of Joy Baba Felunath Film

দুর্গামাহাত্ম্য: প্রতিমার সামনে রুকু আর শশীবাবু। জয় বাবা ফেলুনাথ ছবির দৃশ্য।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:২৮
Share: Save:

তখন দেবতারা বললেন, সর্বনাশ, এই অসুরের সঙ্গে তো পারা যাচ্ছে না! ব্রহ্মা একে এমন বর দিয়েছেন যে, কোনও পুরুষ দেবতা একে বধ করতে পারবে না। তখন বিষ্ণু বললেন যে, এসো, আমাদের শরীরে যে তেজ, সব এক সঙ্গে মিশিয়ে আমরা এমন এক দেবী সৃষ্টি করি, যাঁর হাতে মহিষাসুরকে মরতেই হবে। সেই চার জনের তেজ— ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব আর ইন্দ্র— আর সেই সঙ্গে আরও সব দেবতাদের তেজ এক সঙ্গে মিলে সৃষ্টি হলেন দেবী দুর্গা! এই দুর্গার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র...” এ ভাবেই দুর্গার প্রকাশকে তাঁর নিজস্ব ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন সত্যজিৎ রায়, তাঁর জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে।

জয় বাবা ফেলুনাথ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯-র গোড়ায়। অর্থাৎ তার শুটিং হয়েছিল তার আগের বছর, হয়তো আশ্বিনে নয়, হয়তো কিছু আগে বা পরে। কিন্তু ছবিতে আশ্বিনের আবহাওয়ার অনুপুঙ্খ ধরেছিলেন সত্যজিৎ। মেঘহীন আকাশ, শীতের হালকা পোশাক, আর ছবি জুড়ে দেবীমূর্তির কাঠামো থেকে চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠার ঘটনাক্রম। একটানা, তথ্যচিত্র আঙ্গিকে এই ক্রমটি বর্ণিত হয়নি। গল্পটির মূল ধারা ফেলুদার রহস্য উন্মোচন ঘিরে। সেই রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছিল গল্পে বারাণসীর ঘোষালবাড়ির বংশানুক্রমিক দুর্গাপুজো কেন্দ্র করে।

দুর্গাঠাকুর ঘিরে সত্যজিতের দু’টি ফোটোগ্রাফ বহুলপ্রচারিত। একটি জয় বাবা ফেলুনাথ ছবির শুটিং-এর সময়, পিছনে দেবী দুর্গার খড়ের কাঠামোর সামনে ৩৫ মিমি অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে, স্থির চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষের তোলা ফটোতে ‘রিল্যাক্সড’ সত্যজিৎ; আর একটায় সরস্বতীর মূর্তিটির মাথার কেশ-মুকুট নিজের হাতে রং করছেন শিল্পী সত্যজিৎ, একাগ্রতায় পূর্ণ মুখ। সিনেমায় দেবী দুর্গার চক্ষুদান করেছিলেন শশীবাবু চরিত্রটি, অভিনয় করেছিলেন বিশিষ্ট মৃৎশিল্পী, কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার শ্রীশচন্দ্র পাল।

জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিটির গল্পের সঙ্গে দুর্গাপ্রতিমার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। পাচার চক্রের মাথা মগনলাল মেঘরাজ ঘোষালবাড়ির প্রাচীন ও দামি গণেশমূর্তি যেন তেন প্রকারেণ হাত করার চেষ্টা করছে শুনে, রুকুর সঙ্গে মিলে তার দাদু অম্বিকা ঘোষাল ঠিক করেন, পারিবারিক ঐতিহ্যমণ্ডিত গণেশমূর্তিটি আপাতত লুকিয়ে রাখবেন তাঁদের ঠাকুরদালানে নির্মীয়মাণ দুর্গাপ্রতিমার বাহন সিংহের মুখের ভিতর, চিউয়িং গাম দিয়ে আটকে। এই ‘আইডিয়া’ তাঁরা পেয়েছিলেন জটায়ুর উপন্যাস করাল কুম্ভীর পড়ে। এই গণেশের কারণেই মগনলালের পোষা গুন্ডাদের হাতে খুন হন শশীবাবু। বিজয়া দশমীর দিন ফেলুদার গোয়েন্দা-বুদ্ধিতে মগনলাল ধরা পড়ে, ধরা পড়ে ভণ্ড সাধু মছলিবাবাও। গণেশমূর্তি উদ্ধার হয়— অতঃপর জানা যায়, এই গণেশ আসলে নকল, আসল গণেশ ব্যাঙ্কের লকারে রেখে দিয়েছেন অম্বিকা ঘোষাল। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির সাফল্যে প্রসন্ন ঘোষালমশাই এই নকল গণেশটি ফেলুদাকে পারিশ্রমিক বাবদ উপহার দেন।

এই ছবিতে দুর্গাপুজোর উপস্থিতি প্লট সাজাতে। আশ্বিন পুজোর মাস, পুজোর প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করেননি সত্যজিৎ, তাঁর প্রথম ছবি থেকেই দুর্গাপুজো তাঁর পছন্দের মোটিফগুলির একটি। পথের পাঁচালী গ্রামবাংলার জীবনের আদরণীয় বহিঃপ্রকাশ; ছবিতে দুর্গার আগমনী উৎসব ধরা দেয় গুরুত্বপূর্ণ এক পরিপ্রেক্ষিত হয়ে, ছবির চরিত্রগুলোর জীবন তার দ্বারা নানা ভাবে প্রভাবিত হয়। আর এই সবই শুরু হয় দুর্গা চরিত্রটি ঘিরে, তার ভাই অপুর নানা উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশের ইমেজের সঙ্গে আসন্ন উৎসবের পরিবেশ ব্যক্ত হয় সুস্পষ্ট। দুর্গোৎসব সমাজের নানা স্তরের একত্র হওয়ার প্রতীক, সবাই এ সময় বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে, কঠোরতম প্রতিবেশীও গ্রামের শিশুদের প্রসাদ বিতরণ করে সানন্দে। রাতের যাত্রাপালা দেখে গ্রামবাসী মুগ্ধ, আবেগমথিত হয়। অপুর জীবনে পর দিনই ঘটে এর অনাবিল বহিঃপ্রকাশ, রাংতার মুকুটে সেজে রাজা-সাজা খেলায় মেতে ওঠে সে। তার পরেই সেই দৃশ্য: আশ্বিনের শ্বেতশুভ্র কাশবন, তার ও পারে ভোঁ বাজিয়ে ছুটে যায় রেলগাড়ি। বাংলার মাঠে-প্রান্তরে কাশবনের মৃদু মধুর দোলা নতুন ঋতুর আগমনী ঘোষণা করে। চলচ্চিত্র সমালোচক ডেরেক ম্যালকমের মতে, পথের পাঁচালী-র এই দৃশ্যটি প্রকারান্তরে সত্যজিৎ রায়ের ‘সিগনেচার টিউন’ হয়ে গিয়েছে, রোম্যান্টিক ফরাসিদের অনেকের কাছেই যা পবিত্রতার প্রতীকও হয়ে উঠেছিল।

“ওই ফুলগুলো দেখো, সত্যিই সুন্দর। তুমি তো আমেরিকাতেও ফুল পাবে। পয়েনসেটিয়া! ক্যালিফোর্নিয়ায় এই বুনো ফুল ভর্তি... আমার নিজের বাগানেই তো কত আছে! কিন্তু ওই কলাগাছগুলো দেখো, আর ওগুলোর ঠিক নীচে সবুজরঙা পুকুর... এগুলো তুমি ক্যালিফোর্নিয়ায় পাবে না। এই হল বাংলা, অপূর্ব সুন্দর!” দ্য রিভার ছবির লোকেশন দেখতে এসে ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়া গ্রামবাংলার কাশফুল-কলাবন দেখে নিজের অনুভব এ ভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। পথের পাঁচালী তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। পরে সেই ছবিতেই সত্যজিৎ তাঁর ক্যামেরা দিয়ে বাংলার অপরূপ রূপলেখা এঁকে গেলেন। গ্রামে রায়বাড়ির পুজোয় আনন্দঘন পুজো-পরিবেশ; অকালবৃষ্টিতে অপু-দুর্গার গা ভিজিয়ে গ্রাম পরিক্রমা এবং পরে অসুস্থ হয়ে দুর্গার মৃত্যু যেন সেই আনন্দেরই বিসর্জন। সর্বজয়ার আকুল কান্নার মানে বুঝতে পেরে দূরদেশ থেকে ঘরে ফেরা হরিহরের ‘দুগ্গা মা’ বলে হাহাকারে দর্শকেরও বুক ভাঙে। এই দুর্গার কোনও পৌরাণিক ব্যাখ্যা দেননি সত্যজিৎ, মিথের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেননি। পুজোর পরে সব ঠিক হয়ে যাবে: ঋণ শোধ করা যাবে, বাড়ি মেরামত হবে, অধরা স্বপ্ন পূরণ হবে— সর্বজয়ার কাছে পুজো যেন সেই স্বপ্নের প্রত্যাশা। হরিহর ঘুমিয়ে পড়লেও সর্বজয়া রাত জেগে সেলাই করে, কল্পনার জাল বোনে। কিন্তু আশ্বিন স্বপ্ন পূরণ করে না, আশ্বিনের রূপকল্প তাদের জীবনে বিলাসিতা।

দেবী ছবিতে দুর্গাপুজো আসে বিস্তৃত এক রূপক হয়ে। জমিদার কালীকিঙ্কর ও তার বড় ছেলে তারাপ্রসাদকে দিয়ে ছবির শুরু, পুজোর আরতির সময়ে দেবী দুর্গার দর্শনরত। তারাপ্রসাদ তার পিতার ধ্যানধারণার উত্তরসূরি; অন্য দিকে, কালীকিঙ্কর যখন ভাবস্থ হয়ে বলি দেখছে, তখন তার অন্য পুত্র, সংবেদনশীল কলেজপড়ুয়া তরুণ উমাপ্রসাদ পিছনে দাঁড়িয়ে নীরবে, আতঙ্কিত। শুরুর পুজোর দৃশ্যটি যেন ছবির সংক্ষিপ্তসার। পুরুষশাসিত সমাজের প্রতিভূ কালীকিঙ্কর তার কল্পনা ও সংস্কারাচ্ছন্ন উপলব্ধির বশে বিশ্বাস করতে থাকে যে তার পুত্রবধূ দয়াময়ী নিজেই যেন দেবী— পুজোর বেদিতে তাকেই উপাস্য হিসাবে বসিয়ে দেয় সে। এ ছবি কথা বলে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ছবির কাহিনিবিন্যাসের মধ্যেই দুর্গাপুজোর প্রবহমান প্রথা একাকার হয়ে যায় দয়াময়ীর জীবনের সঙ্গে।

দেবী ছবির টাইটেল কার্ডে ‘নির্মীয়মাণ’ দুর্গার মুখের উপরে প্রতিস্থাপিত হয় ছবির শীর্ষ লেখা। কলাকুশলীর নামের তালিকা যত এগোয়, দুর্গার অবয়বও প্রকট ও সম্পূর্ণ হতে থাকে। টাইটল কার্ড দেখানোর শেষে ক্যামেরা পিছিয়ে আসে, দুর্গার মুখ ও ক্রমে পূর্ণপ্রতিমা এবং ঠাকুরদালান, লোকের জমায়েত পর্দা জুড়ে দৃশ্যমান হয়। জমিদার কালীকিঙ্করের বাড়িতে পুজোর আনন্দে শরিক গ্রামবাসীদের তুলে ধরা হয় ছোট্ট মন্তাজে, রাতের আকাশে আলোর রোশনাই দেখা যায় শিশুর আনন্দোচ্ছল মুখের প্রকাশভঙ্গিতে। তার পরেই নদীপাড়ে আসন্ন সন্ধ্যার দৃশ্যে ধরা পড়ে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য, সুব্রত মিত্রের ক্যামেরার কারুকাজে।

নায়ক ছবিতে অরিন্দম চরিত্রটির সংলাপে ছিল তার কিশোরবেলার পাড়ার পুজোর কথা, প্রতিমার চালচিত্রের শিল্পকথা। চরিত্রের সংলাপ, চরিত্রবৈশিষ্ট্য এক অর্থে পরিচালকের অন্তরের ভাবনারই চিত্ররূপকল্প, নায়ক ছবির সূত্রে এটা ভাবা অমূলক হবে না যে, সত্যজিতের ভাবনার দুর্গা আসলে চালচিত্রে ঘেরা বাঙালির সাবেক দুর্গা। সত্যজিতের এই ঐতিহ্যরীতির প্রতি অনুরাগ হয়তো শান্তিনিকেতনে কলাভবনে নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষণরীতির প্রেরণায়। তাই দেখি, জয় বাবা ফেলুনাথ-এ প্রতিমার চালচিত্রটি স্বহস্তে সযত্নে সাজিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। ঠাকুরদালানের বাকি সেট তাঁর পরামর্শে তৈরি করেছিলেন শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত।

“মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন দেবী। মহিষাসুর বললেন, দেবী, তোমার হাতে মরতে হবে জানি, তুমি এমন করো যেন তোমার পুজোর সঙ্গে সঙ্গে লোকে আমারও পুজো করে। দেবী বললেন, তথাস্তু। তথাস্তু শব্দের মানে তাই হোক। সেই থেকে মহিষাসুর রয়ে গেলেন দেবীর পায়ের তলায়। আর দেবীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও পুজো হতে লাগল!” জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে রুকুকে দুর্গাপুজোর গল্প শোনায় শশীবাবু। এও এক পরম্পরা, এক প্রজন্ম সহজতম ভাষায় দেবীমাহাত্ম্য বোঝায় অন্য প্রজন্মকে। এই কথন-পরম্পরাই জন্ম দেয় বিশ্বাসের, সব সত্যি— টারজান থেকে হিজিবিজবিজ, ক্যাপ্টেন স্পার্ক থেকে মহিষাসুর। সত্যজিতের ছবিতে পুজোর অনুষঙ্গে ধরা পড়ে বাঙালির জীবনছন্দ আর ছন্দপতনও।

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray Jay Baba Felunath Durga Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy