Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Mobile Phone

মেয়েদের হাতে মোবাইল!

ফোনের কারুবাসনা কি মেয়েদের সত্যি নষ্ট করে দিচ্ছে? সুন্দরবন অঞ্চলের বাবা মায়েরা ভয় পান কিশোরীকে মোবাইল দিতে।

উদ্বিগ্ন অনেকেই।

উদ্বিগ্ন অনেকেই।

তৃষ্ণা বসাক
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২২ ০৪:৫৬
Share: Save:

শহরতলির ট্রেনে মাথা ধরার বাম বিক্রি করছিলেন বয়স্ক মানুষ। এঁদের বিপণনের নিজস্ব টেকনিক আছে, দুর্দান্ত ছড়া বানান পণ্য নিয়ে। শসাবিক্রেতা চমকে দেন “দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে?” বলে। ঘুগনি বা ফটাস জল বিক্রেতারও নিজস্ব স্টাইল। পেন বিক্রেতা কমলবাবু বলতেন, “এক টাকায় হয় না কো গাড়ি আর বাড়ি,/ এক টাকায় হয় না কো বৌদিদের শাড়ি,/ ভাই কমলের পেন, এক টাকা করে দাম।” মাথা ধরার বাম বিক্রেতা কিন্তু কামরার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে যেতে বলছিলেন, “সব ‘মেয়েছেলে’কে দেখো, কানে তার গুঁজে বসে আছে। বৌয়ের হাতে মোবাইল দিয়েছ কি মরেছ, আর শাউড়িকে ভাত দেবে না, সংসার থুয়ে পেইলে যাবে এক দিন।” অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মাথার বামের সঙ্গে এ সব কথার সম্পর্ক?

বিদ্যুচ্চমকের মতো ঈশ্বর গুপ্তকে মনে পড়ল। “এতদিন মেয়েগুলো ছিল ভালো/ ব্রতধর্ম করত সবে/ একা বেথুন এসে শেষ করেছে/ আর কি তাদের তেমন পাবে?” নারীশিক্ষার প্রথম ঢেউয়ে যেমন হাড়হিম আতঙ্ক ছড়িয়েছিল সমাজপতিদের শিরদাঁড়ায়, পাশ্চাত্য শিক্ষা পেলে মেয়েরা বদলে যাবে, এবি শিখে বিবি হয়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে ভেবেছিল পিতৃতন্ত্র— এত বছর পরে আবার সেই ধরনেরই আতঙ্ক। নারীশিক্ষার, মানে নারীর ডিজিটাল শিক্ষার ঢেউটি এসে গিয়েছে, বাহন মোবাইল ফোন।

মেয়েরা যখন কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করলেন, তখন আতঙ্কের এই চেহারা ছিল না। মেয়েরা ঠান্ডা ঘরে কম্পিউটারে কাজকর্ম করছেন— দৃশ্যটি স্বস্তিকর। যেমন ভাবা হত, দিদিমণিগিরি মেয়েদের জন্য উপযুক্ত, তেমনই কম্পিউটার সায়েন্স, ইনফর্মেশন টেকনোলজি। এই সব পড়ে প্রচুর মেয়েরা কাজ পেলেন, একটা সময় যেমন টেলিগ্রাফ অফিসে অনেক মেয়ে কাজ করতে ঢুকেছিলেন। বাড়িতে কম্পিউটারে কাজ করাটাও খারাপ চোখে দেখা হত না। ঘরে চরকা, সেলাই কল চালানোরই যেন আধুনিক সংস্করণ কম্পিউটার।

কিন্তু মেয়েদের হাতে মোবাইল! কোথাও একটা অসুবিধে তৈরি হচ্ছে। একরত্তি জিনিসটা, কোমরে বা ব্লাউজ়ের ফাঁকে লুকানো যায়, দূরের কারও সঙ্গে খবর চালাচালি করা যায়, দুনিয়ায় ঘটে চলা সব কিছু দ্রুত জানা যায়, জিনিস কেনা-বেচা যায়— এ যে মেয়েদের হাতে গিয়ে কী প্রলয় ঘটাবে— উদ্বিগ্ন অনেকেই।

আফসার আহমেদের উপন্যাস অশ্রুমঙ্গল-এ ছিল কুসুমপুরে টেলিফোন এসে গ্রামটাকে পাল্টে দিল। এত কথা এত অশ্রু ছিল গ্রামের মেয়েদের বুকে, আগে বোঝাই যায়নি।

ফোন কেনার মধ্যেও লিঙ্গবৈষম্য। উচ্চশিক্ষিত মেয়ের ফোন ট্রেনে চুরি যাওয়ার শাস্তি হিসাবে বহু দিন তাকে ফোন কিনে দেওয়া হয়নি। পরে তার যখন টেপা ফোন হল, তত দিনে তার স্বামীর হাতে স্মার্টফোন। যেমন চোখের বালি-র মহেন্দ্র যখন মোটা মোটা ডাক্তারির বই পড়ত, তার বৌ আশালতা পড়ত চারুপাঠে উইপোকার বিবরণ! এ ক্ষেত্রে স্বামীর উন্নততর ফোন এলে পুরনো ফোনটা স্ত্রীর ভাগ্যে জুটছে। হাতের কাছেই ডিজিটাল ডিভাইডের এমন অনেক উদাহরণ।

ফোনের কারুবাসনা কি মেয়েদের সত্যি নষ্ট করে দিচ্ছে? সুন্দরবন অঞ্চলের বাবা মায়েরা ভয় পান কিশোরীকে মোবাইল দিতে। তাঁদের কথায় মোবাইল থেকে যেমন প্রেম, পালিয়ে বিয়ে সহজ, তেমনই নারী পাচারও। নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তীর ‘কাকজ্যোৎস্না’ গল্পে ফোনে লুকিয়ে পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিপর্যয় আসে একটি মেয়ের জীবনে।

আজ ফুলশয্যা! ইতি আঁচলের তলা থেকে সাবধানে ফোনটা বার করে আনল। রূপমকে ফোন করে ডেকে নিতে হবে। ...ফোনটা পুনির। টিউশনির টাকায় কেনা। বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় দিয়ে গেছে তাকে। কিন্তু তার স্বামী দেখে ফেলে কথা বলতে।

“...তুমি কার সাথে ফোনে কথা কইথল?”

ফোনে কথা বলার অপরাধে গ্রামের সালিশি সভায় দুশ্চরিত্র বলে দাগিয়ে দেওয়া হল তাকে, বাবাকে বিবৃতি দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হল মেয়েকে, বাবাও তাকে ঘরে ফেরাতে রাজি না।

শহরেও অনেকের ফোন জলে চুবিয়ে দেওয়া হয়, কললিস্ট চেক করার, মেসেজ পড়ার নজিরও আছে। মনে পড়ে যোগাযোগ-এর কুমু অবাক হয়ে গিয়েছিল মধুসূদন তার দাদার লেখা চিঠি খুলেছে বলে। অবস্থা খুব একটা বদলায়নি।

শুধু সঙ্গীকে খোঁজা নয়, ফোনই হয়ে উঠছে সঙ্গী। পার্চড সিনেমায় কোমরে শাড়ির মধ্যে জড়ানো, ভাইব্রেশনে থাকা মোবাইল হঠাৎ বাজলে হেসে গড়িয়ে পড়েন গার্হস্থ হিংসার শিকার তিন সখী। বলেন, “আমাদের আর পুরুষের দরকার নেই!”

মোবাইল এসে কতটা ক্ষমতায়ন করেছে আর কতটা ক্ষতি— তা নিয়ে আরও গভীর সন্ধানের প্রয়োজন। তবে মোবাইল যে ক্রমেই মেয়েদের নতুন হাতআয়না হয়ে উঠছে আর সেই আয়নায় তাঁরা নিজেদের দেখতে পাচ্ছেন, হয়তো নিজের ডিজিটাল সত্তাকে, আর তা অনেকেরই মাথাব্যথার কারণ— সন্দেহ নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Mobile Phone Women Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy