সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বিভক্ত বাংলার বিপর্যস্ত পরিবারের গৃহবধূ আরতি চাকরি করতে যায় শ্বশুরবাড়ির অমতে— সত্যজিৎ রায়ের ছবি মহানগর-এ (কাহিনি: নরেন্দ্রনাথ মিত্র)। এক সময় সে-ই হয়ে ওঠে পরিবারের চালিকাশক্তি। তার হাত ধরে সংসারে যখন সুদিন আসতে চলেছে, ঠিক তখনই ছায়াছবির আরতি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মহানগরের ভিড়ে মিশে যায়। অফিসে এক সহকর্মী অন্যায় শাস্তির সম্মুখীন হলে সে এমন পদক্ষেপ করে। একটা বোধ কাজ করেছিল তার মনে— সহযাপক যদি আজ লাঞ্ছিত হয়, কাল তার নিজেরও পালা। একা ভাল থাকা যায় না। সকলকে নিয়ে ভাল থাকা দরকার। নারীর ক্ষমতায়নের আলোচনাকে আরতি অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভারতের মেয়েরা আরতি হতে পারেনি।
শবরীমালার আয়াপ্পা দেবতার মন্দিরে ঋতুমতী নারী যেতে পারবেন না, এ খবর সারা দেশ জানে। যাঁরা যেতে চাইলেন, তাঁরা চরম অপমানিত হলেন নারী, পুরুষ উভয়ের দ্বারাই। আশ্চর্য এই, রাজ্যটির নাম কেরল। ৯৫ শতাংশ নারী এই রাজ্যে সাক্ষর (ভারতে এখনও ৬৬ শতাংশ নয়)। কোভিডের মতো রোগের মোকাবিলায় মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রথম সারির বেশির ভাগ যোদ্ধাই মহিলা। অথচ, কুসংস্কারের এমন অসুখের মোকাবিলা তাঁরা করতে পারলেন না? যে কমিউনিস্টরা ‘অর্ধেক আকাশ’ নিয়ে সবচেয়ে সরব, যাঁদের ‘মহিলা সমিতি’ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, তাঁরাই সরকারে। তবু ঋতুমতী নারীর এমন প্রান্তিকায়ন নিয়ে কেউ কি তেমন সরব হলেন?
সম্প্রতি এই কেরলেই পণের দাবির চাপ সহ্য করতে না পেরে এক তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। গার্হস্থ হিংসা, পণের জন্য অত্যাচার ও মৃত্যুর বৃত্তান্ত সামনে আসছে একের পর এক। নারী-পুরুষ অনুপাতের ক্ষেত্রেও ভারতের অন্য সব রাজ্যকে পিছনে ফেলে কেরল এগিয়ে (১০০ নারী প্রতি ৯২ জন পুরুষ)। অথচ, কেরলের ‘মহিলা কমিশন’-এর চেয়ারপার্সন মত দিয়ে বসেন মেয়েদের শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে নির্যাতিত হওয়ার পক্ষে। তিনি ইস্তফা দিলেও প্রশ্নটি মোছেনি। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে এগিয়ে থাকা এলাকাতেও কি নারীর ক্ষমতায়ন, আত্মমর্যাদা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং প্রকৃত শিক্ষার মধ্যে বিপুল ফাঁক দিয়ে ঐতিহ্যের জুতো পায়ে বস্তাপচা বৈষম্য এবং সামাজিক নিয়ম ঢুকে নারীজীবনকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’তে নামিয়ে আনে।
স্কুলশিক্ষার সঙ্গে যুক্তরা জানেন, বহু অভিভাবক মেয়েকে পড়ান বিয়ের যোগ্য করে তুলতে। অনেকেই ভাবেন, মেয়ে কর্মক্ষেত্রে গেলেও, তা যেন সংসারকে প্রভাবিত না করে। সমাজ এমন ধারণাও গেঁথে দিয়েছে, স্ত্রীর চাকরির মান যেন একটু হলেও স্বামীর চেয়ে নিচু থাকে। কেরলের মতো শিক্ষিত রাজ্যেও গ্রামাঞ্চলে মাত্র ২২ শতাংশ নারী এবং শহরাঞ্চলে ১৯ শতাংশ নারী কর্মস্থলে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। তা হলে এত শিক্ষা নিয়ে তাঁরা করছেন কী? পরিবার প্রতিপালন, শিশু শিক্ষায় মনোনিবেশ করছেন, চাষের কাজ, পশুপালন ইত্যাদি ছোটখাটো কাজকর্ম করছেন। শ্রমের বাজারে তাঁদের অবদানের সুযোগ থাকছে না। ফলে অবসরে আর্থিক নিরাপত্তার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
আমরা ক্লারা জ়েটকিনের ছবিতে মালা দেওয়া ‘প্রগতিশীল’ এবং প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় নারীকে ইদানীং কালে নারীর কর্মসংস্থানের দাবিতে পথে নামতে দেখেছি কি? শিল্প, কৃষি, অফিসকাছারিতে নারীকর্মীর নিরাপত্তার দাবিতে রাজপথ স্তব্ধ করে দেওয়ার আন্দোলন দেখেছি কি? ভারতীয় মেয়েরা রকেট বানাচ্ছেন, যুদ্ধবিমান ওড়াচ্ছেন, কোভিড সামলাচ্ছেন। এর পরও ‘নারীর ক্ষমতায়ন’-এর বিশ্বতালিকায় ভারত ১৯০টি দেশের সাপেক্ষে ১১৭-তে পড়ে আছে। ‘লিঙ্গবৈষম্য’-এর তালিকায় এক বছরে আটাশ ধাপ নেমে গিয়ে ১৫৬টি দেশের মধ্যে ১৪০তম স্থান পেয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা বৃদ্ধ হতে চলল। কিন্তু লোকসভায় নারী সদস্যসংখ্যা শতাংশে চোদ্দোর কৈশোর পেরোতে পারল না।
‘লিঙ্গের নিরিখে সমানাধিকার’ দেশের আর্থসামাজিক বিকাশের অন্যতম সূচকও বটে। ভারতীয় নারীকে লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ পেতে হলে প্রথমেই ‘দাসী’ এবং ‘দেবী’-র ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ‘সাধারণ মানুষ’ হতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যাতে নারী তাঁর ক্ষমতাকে বুঝতে শেখেন এবং কাজে লাগানোর সুযোগ পান। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা সেই কাজে সহায়ক হতে পারে, যদি তা বৈষম্যকে দূরে সরিয়ে রেখে অগ্রসর হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাফল্যে না আসতে পারলে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ অর্থহীন। আর এই বিপ্লব নারীর নেতৃত্ব ছাড়া অসম্ভব।
দুর্ভাগ্য, আজকের ‘আরতি’রা তাঁদের প্রতিষ্ঠা, সমৃদ্ধি নিয়ে এমন সন্তুষ্ট যে, ‘এডিথ’দের দুর্দশা তাঁদের বিচলিত করছে না। ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীন নারী দুই পৃথক পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে আছেন। পথে না নামলে কাল যে আরতি আর এডিথ দু’জনকেই পথে বসতে হতে পারে, এই সচেতনতা লাভ করতে তাঁদের হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy