দেড় বছরের অধিক সময় বয়ে গেল, স্কুল সার্ভিস কমিশনের বিরুদ্ধে নিয়োগ-গরমিলের আন্দোলন অব্যাহত। সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টের কয়েকটি রায়ের প্রেক্ষিতে বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে। হাই কোর্ট দ্বারা নিয়োজিত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বে কমিটি প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল, তাকে ভিত্তি করে উচ্চ ন্যায়ালয়ের আদেশক্রমে বর্তমানে নিয়োগ-দুর্নীতির অনুসন্ধানের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে সিবিআই-এর উপর। স্বাভাবিক ভাবেই সংবাদমাধ্যমগুলির সক্রিয়তা অনেকটাই সিবিআই কেন্দ্রিক হয়ে উঠল। কিন্তু সিবিআই-এর সার্চলাইটের বাইরে পড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ যথাসময়ে উত্থাপন করে আমরা সৎ এবং নির্ভীক সামাজিক বিতর্ক তৈরি করতে পারিনি। শিক্ষক পদপ্রার্থীদের বর্তমান আন্দোলন ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহে এই ধরনের গরমিলের সম্ভাবনা হ্রাসে ঐতিহাসিক ভূমিকা নেবে।
দুর্ভাগ্য, সিবিআই-এর সিলেবাসের বাইরে প্রথম প্রসঙ্গের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হচ্ছে শিক্ষকদের। বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনকালে এবং তৃণমূল সরকারের এক দশকাধিক দায়িত্বকালে শিক্ষাব্যবস্থার স্বশাসিত সংস্থাগুলিতে বিভিন্ন পদে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কাজ করছেন তাঁদের স্থায়ী পদে লিয়েন রেখে। অর্থাৎ, যে কোনও সময়ে স্থায়ী পদে ফিরে যাওয়ার স্বাধীনতা রইল। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রাইমারি বোর্ড এবং উচ্চ-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশন মূলত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত। নিয়োগের প্রশাসনিক নিয়মবিধির মান্যতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য থাকেন পূর্ণ সময়ের উচ্চমানের আধিকারিকরা।
এই দায়িত্ব যথার্থ ভাবে পালন করার জন্য তাঁরা কিছু বাড়তি সুবিধাও পেয়ে থাকেন। তা সত্ত্বেও যখন তাঁদের সন্তানতুল্য শিক্ষক পদপ্রার্থীরা অনাহারে পথের আন্দোলনে কালক্ষয় করেন, তখন প্রশ্ন উঠবেই— দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকবৃন্দ কি নিদ্রামগ্ন ছিলেন?
নয়-নয় করেও বিশ্ব জুড়ে শিক্ষকদের একটা ভাবমূর্তি আছে। সেই ভাবমূর্তি থেকে কারও বিচ্যুতির আলোচনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অলিন্দে ছাত্র-সহকর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। এই মুষ্টিমেয় শিক্ষকেরা একই সঙ্গে দুর্বিনীত হয়ে ওঠার মানসিক বৈকল্য দেখাতেন না। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে লালিত শিক্ষক সংগঠনগুলি প্রায়শই শিক্ষা প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করত। অর্থের বিনিময়ে হয়তো না, কিন্তু প্রশ্নহীন আনুগত্য কেনার জন্য সরকারি কলেজ-বিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষের যে কোনও সময়ে বদলির অস্ত্রটির মোক্ষম ব্যবহার এক সময় বেশ কার্যকর হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও এই শিক্ষা-বিরুদ্ধ আচরণ বেশ কিছু দিন পর্যন্ত ব্যক্তিনির্ভর ছিল। কিন্তু দুর্বল, অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদপ্রিয় মুষ্টিমেয় শিক্ষকের হাত ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল রাজনীতির নয়, রাজশক্তির।
এই প্রসঙ্গে আচার্য যদুনাথ সরকারের (ছবিতে) শিক্ষা সম্পর্কিত কিছু মন্তব্য খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। স্বাধীনতার দুই দশক পূর্বে স্থানীয় সমাজের উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষণীয় তৎপরতার প্রসঙ্গে আচার্য যদুনাথ লিখলেন, “আমাদের বর্তমান সমস্যা হইয়াছে কিরূপে সুনিয়ন্ত্রিত প্রণালীতে শিক্ষা বিস্তার করিলে ছাত্রদের বুদ্ধি ও চরিত্র উন্নত হইতে পারে। কাজে কাজেই যেমন তেমন বিদ্যালয় স্থাপিত হইলেই যে তাহা লোকের উপকারে আসিবে এ ধারণা করা ঠিক নহে। আদর্শবিহীন, অসমর্থ বা অনভিজ্ঞ লোক দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয় ছাত্রদের প্রভূত অপকার সাধন করে এবং নিকটবর্তী পুরাতন সুপরিচালিত সব বিদ্যালয়ের ক্ষতি করিয়া প্রকৃত জ্ঞান বিস্তারের পথে বাধা জন্মায়।” অর্থাৎ, অযোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষক পদে যোগদান করলে ছাত্রদের প্রভূত ক্ষতি হবে। এই সম্ভাবনাকে বর্জন করার প্রধান দায়িত্ব পড়ে শিক্ষক নিয়োগের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকবৃন্দের উপর। তাঁদেরই পূর্ণ অবগত থাকার কথা যে, সাধারণ দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মর্যাদা-সহ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং আজীবন শিক্ষাগ্রহণের সামর্থ্য অর্জনের চাবিকাঠি যোগ্য শিক্ষকদের হাতেই থাকতে পারে। আধুনিক পেডাগজি এবং তৎসহ পাঠ্যক্রমের সংস্কার বাস্তবে রূপায়িত হয় যোগ্য শিক্ষকের মাধ্যমে। নতুবা সবই ভগ্ন উদ্যম।
আচার্য যদুনাথ লিখেছিলেন, “যদি বঙ্গীয় সমাজে আমাদের স্কুল শিক্ষকগণকে অযোগ্য কম বেতন দেওয়া হয়, তাঁহাদের প্রতি কুব্যবহার করা হয় এবং তাঁহাদের ভিক্ষুকের ন্যায় ঘৃণা করা হয়, তাহা হইলে তাঁহারা কি উপায়ে কোন আদর্শে তাঁহাদের শিক্ষাধীনে অর্পিত দায়িত্বজ্ঞানহীন সুকুমারমতি বালকগণের চরিত্র গঠন করিবেন? যদি পিতার প্রতিরূপ ও গুণাগুণ পুত্রে বর্তে তাহা হইলে শিক্ষকের চরিত্রও ছাত্রদের ভিতর দিয়াই প্রতিফলিত হয়। ...সুতরাং প্রকৃত শিক্ষকের একমাত্র লক্ষ্য হইবে ছাত্রের চরিত্র গঠন করা। তাঁহার ভিতরকার যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ— তাঁহার সময়, তাঁহার সকল চিন্তা, তাঁহার সমগ্র শক্তি ছাত্রদের চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনে নিয়োজিত করিতে হইবে...।”
স্বাধীনতার পূর্বে স্বল্প বেতনের দরিদ্র শিক্ষকদের সম্পদ ছিল চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নির্লোভ ছাত্রপরায়ণ মনোবৃত্তি। এঁরাই তৈরি করেছিলেন আদর্শবাদী অসাধারণ জননেতাদের। স্বাধীনতা লাভের পর আচার্য যদুনাথের একটি আকাঙ্ক্ষা অন্তত পূর্ণ হয়েছে— শিক্ষকদের বেতন বর্তমানে ভারতের বেতন কাঠামোর মাপকাঠিতে আকর্ষণীয়। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষকের লক্ষ্য এবং কর্মধারা বিষয়ে তাঁর অভিমতকে কতটুকু মূল্য দিতে প্রস্তুত আমরা?
বর্তমান জননায়কদের শিক্ষার আদর্শ এবং আদর্শ শিক্ষকের ধারণা নিশ্চিত আছে। সেই ধারণা নিয়ে তাঁরা যদি যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তা হলে শিক্ষক-প্রশাসকদের যে কর্তব্যবোধ তাঁদের রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করার কথা, তার থেকে কখনও বঞ্চিত হবেন না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy