Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Children Home

‘হোম’ মানে তো ওদের বাড়িই

বয়স আঠারো পেরোলেই হোমজীবন শেষ। তখন ‘সেল্ফ বন্ড’-এ ওরা ফিরে যায় আফটার কেয়ারে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রশিক্ষণ চলে। সচিত্র ভোটার কার্ড এসে পৌঁছয়।

বয়স আঠারো পেরোলেই হোমজীবন শেষ।

বয়স আঠারো পেরোলেই হোমজীবন শেষ।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৪৯
Share: Save:

হাও মাও খাও, রাজামশাই সকাল হল, এ বার খেতে দাও।” কাঙাল ভূতের চিৎকারে ভয় পেলেন রাজা। ভূতের নাম শাহরুখ খান। রাজার নাম বীরসা মুন্ডা। মঞ্চে তখন অনেক ভূত— বাংলাদেশ, নেপাল, ভারতের ভূতেরা মিলেমিশে একাকার। বালুরঘাটের শিশুদের সরকারি হোমে আজ নাটকের স্টেজ রিহার্সাল।

জীবন আরও বড় এক নাটকের কুশীলব করে তুলেছে এদের, এই শৈশবেই। শাহরুখ কাঁটাতার পেরিয়ে এ পারে এসেছে দশ বছর হল। সকলকে বলেছিল, বাড়ি কাপাসপুর। কিন্তু সরকারি দল খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেছে, সেখানে আজ ধু ধু মাঠ। পাশেই উত্তাল মেঘনা। ঠিকানা হারিয়ে শাহরুখ এখন হোমের বাসিন্দা। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে নাচ করে এ বার প্রথম পুরস্কার জিতেছে সে। আর ওই রাজা, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারিয়ে এখন কুড়ি ফুট প্রাচীরে ঘেরা সাম্রাজ্যে ভাল থাকার চেষ্টা করছে।

বদ্যিভূতের কী স্পষ্ট উচ্চারণ, কী অভিব্যক্তি! কে বলবে, এ তার প্রথম মঞ্চে অভিনয়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তার নাম জিতু লামা। লাচুং-এর প্রবল শীত থেকে এই ফুটফুটে শিশু এক শীতের সকালে পায়ে হেঁটে মালদহ পৌঁছে গিয়েছিল। এই হোম যেন মিনি ভারত। যারা অভিভাবকহীন, হারিয়ে গিয়েছে, অথবা অন্য কোনও কারণে আইনের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে যে শিশুদের, তাদের প্রত্যেকের যত্ন, সুরক্ষা এবং ন্যায়ের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে, সংখ্যালঘু এবং অনগ্রসর জনজাতিভুক্ত শিশুদের বিশেষ যত্নও নিতে হবে। সরকারি হোমের পাঁচিলের আড়ালে সেই দায়বদ্ধতার পালন করে রাষ্ট্র। পাহারা ছাড়া বাইরে বেরোনো বারণ। স্কুলে যাতায়াতও সিভিক পুলিশের পাহারায়। পশ্চিমবঙ্গ শিশু কিশোর আকাদেমি এই সব হোমের ছেলেমেয়েদের মন ভাল রাখতে রাজ্য জুড়ে নাট্য কর্মশালার আয়োজন করেছিল। উৎসবের নাম, ‘ভাল থাকা ভাল রাখা’। সেই উৎসবে কেউ শোনাল লোকগীতি। নাদিম শেখ শিস দিয়ে গাইল ‘ও আমার দেশের মাটি’। সিকিমের ছোটে তামাং এঁকে আনল পাহাড়ি ঝোরা আর নীল মেঘের ছবি। বিশেষ ভাবে সক্ষম অতনু বলল, “আমি বাঁশি বাজাই, শুনবে?” সন্ধ্যা নামে। রিহার্সাল চলে। একটা হোম চোখের সামনে বাড়ি হয়ে ওঠে।

জেলার শিশুসুরক্ষা আধিকারিক জানালেন, প্রথম দিন অনেকেই মিথ্যে বলে। বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা সব। চার-পাঁচ মাস পেরিয়ে সত্যিটা জানা যায়। তারা ফিরে যেতে চায় না সেই বাড়িতে, যেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। অনেকে ভবঘুরে জীবন ভালবেসেও মিথ্যে বলে। নিজের জীবনের চিত্রনাট্য নিজেরা লিখতে চায়। সে সবই শোনে শিশু কল্যাণ সমিতি। পালিয়ে গিয়ে ধরা-পড়া শিশুদের প্রথম আস্তানা, থানায় হাঁদাভোঁদা আর মিকি মাউসের ছবি আঁকা একটি ঘর। নামটাও সুন্দর, শিশুবান্ধব গৃহ। এইটুকুই সুন্দর, বাকি সব এলোমেলো। জানলা বন্ধ। দেওয়াল জুড়ে শ্যাওলা। ঘরটিকে খন্ডহর মনে হয়।

ওদের নামগুলোও নতুন-পাওয়া, নাটকের চরিত্রের নামগুলোর মতোই। ‘শাহরুখ’ নামটা দিয়েছিলেন টাউনবাবু। ‘অতনু’, ‘সমারোহ’, ‘প্রত্যুষ’ ওসি সাহেবের দান। পুলিশ স্টেশনের আলমারিতে চোখে পড়ল সমার্থক শব্দকোষ। ওদের কেউ কেউ আবার ফিরে যায় পুরনো নামে। পুলিশের জিপে বসে ব্যাগ গোছাচ্ছিল এক কিশোর। তৎকালে টিকিট হয়েছে, বললেন হোম সুপার, কানপুরে রাজেশের ঘর খুঁজে পেয়েছে তদন্তকারী দল। বিদায় অনুষ্ঠানে একটা ফুলদানি উপহার দিয়েছে হোমের বন্ধুরা। এমন আসা-যাওয়া চলতেই থাকে। হোমে স্টেজ রিহার্সাল দেখার আমন্ত্রণ পেয়ে তাই বড় বিস্ময় কড়া নেড়ে যায় মনে। যারা সংসার-পরিত্যক্ত হয়ে ভেসে ভেসে, শেষে সমাজ সুরক্ষার জালে আটকে উঠে আসে হোমে, তারা এমন উজ্জ্বল উদ্ধার!

বয়স আঠারো পেরোলেই হোমজীবন শেষ। তখন ‘সেল্ফ বন্ড’-এ ওরা ফিরে যায় আফটার কেয়ারে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রশিক্ষণ চলে। সচিত্র ভোটার কার্ড এসে পৌঁছয়। শাহরুখ খান, পিতা অনিমেষ বসু। সরকারি নিয়ম, উদ্ধার হওয়া শিশু বাবা-মায়ের নাম বলতে না পারলে হোম সুপারের নামটাই বসে যায় অভিভাবকের নামের জায়গায়। “বায়োলজিক্যাল নয়, ইউনিভার্সাল বাবা,” হাসতে হাসতে বললেন হোম সুপার। সহকর্মীরা আড়ালে তাঁকে ‘ধৃতরাষ্ট্র’ বলে ডাকেন। ঘড়িতে রাত আটটার ঢং পড়ে। ডিনারের নিমন্ত্রণ জানিয়ে যায় পিপুল টিগ্গা, যার বাবাকে খুন করে মা গিয়েছেন জেলে।

রিহার্সাল শেষে অভ্যাগতদের ফেরার পালা। লম্বা গেটটা রাতের অন্ধকারে যেন ভৌতিক দেখায়। অফিসের গাড়ি রওনা হবে। শাহরুখকে আর এক বার দেখতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, জিতু ভাত খেল তো? অতনু ঘুমোবে তো রাতে? এদের প্রতিভা, মানবিক গুণের কতটুকু ধরা পড়ে সরকারি ব্যবস্থায়? যেটুকু সুযোগ এদের কাছে এসে পৌঁছয়, তার কত সার্থক ব্যবহার করে এই শিশুরা, তা না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। বাইরের জীবন এদের কতখানি সুযোগ দেবে, সে প্রশ্নটাই ভূতের মতো বার বার সামনে আসছিল, আর মিলিয়ে যাচ্ছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Children Home Theater workshop
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy