Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sex Workers

কতটা স্বাধীন তাঁদের শরীর, মন

প্রায় সিকি শতক আগে এক বন্ধু আমাদের দু’চার জনকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল যৌনকর্মীদের ইস্তাহার লেখার কাজে সাহায্য করার জন্যে। ওঁদের জায়মান সংগঠনের সঙ্গে সেই আমাদের প্রথম মোলাকাত।

সুনন্দন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২২ ০৬:২৭
Share: Save:

শামসুর রাহমান লিখেছিলেন— স্বাধীনতা তুমি/ রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে/ গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। ছবিটির মধ্যে একটি আকর্ষণীয় অবাধ্যতা আছে, যা স্বাধীনতার প্রাণস্পন্দ। কিন্তু বাস্তবিকই কি মেয়েটি অতটা স্বাধীন? তার শরীর আর মন কি সমাজ আর রাষ্ট্রের কড়া নজরদারিতে নেই? নিজের মন আর শরীরের উপর কি সত্যি তার অবাধ অধিকার?

প্রায় সিকি শতক আগে এক বন্ধু আমাদের দু’চার জনকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল যৌনকর্মীদের ইস্তাহার লেখার কাজে সাহায্য করার জন্যে। ওঁদের জায়মান সংগঠনের সঙ্গে সেই আমাদের প্রথম মোলাকাত। আর যৌনতা সংক্রান্ত নানা চিন্তা আর প্রশ্নের সঙ্গেও সেই আমাদের তুমুল সাক্ষাৎ। প্রথমে ডা. স্মরজিৎ জানার নেতৃত্বে একটি স্বাস্থ্য প্রকল্পের সূত্রে এই সংগঠন গড়ে ওঠে। অচিরেই বোঝা গেল যৌনপেশাকে অপরাধ থেকে বিযুক্ত করতে না পারলে এই পেশায় যুক্ত হাজার হাজার মেয়ের স্বাস্থ্যের অধিকার, নাগরিক অধিকার, আর্থিক অধিকার— কিছুই প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। সমস্যাটা সম্মুখপটে নিয়ে আসার জন্যে তৈরি করা হয় ‘গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই’ স্লোগানটি। এই অধিকার এখনও তাঁদের অধরা। তবে এর ঝাপ্টায় কিছু সুবিধা তাঁরা অর্জন করতে পেরেছেন। আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি পেতে এখন বাধা নেই, সন্ততিরা পিতৃপরিচয় ছাড়াই স্কুলে ভর্তি হতে পারে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। রাষ্ট্রের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি পাওয়ার লড়াই তাঁদের জারি আছে।

কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি এখনও প্রশ্নজর্জর এক জমি, যার নীচে পোঁতা আছে বিস্ফোরক নানা ধারণার ডায়নামাইট। প্রথাবদ্ধ সমাজ সবচেয়ে বিব্রত হয় এই ভেবে যে, অর্থের বিনিময়ে, বিয়ের চৌহদ্দির বাইরে, যৌন-আনন্দ বিনিময় আদৌ জায়েজ কি না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, যৌনকর্মীর পেশা কি কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নেয়?

দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব সোজা। বিড়ি-শ্রমিক, জরি-শ্রমিক, খনি-শ্রমিক, ঠিকা গৃহকর্মী— এই সব কাজও কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নেয় না। কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে একটা পেশায় যুক্ত হয়ে পড়া কর্মীদের নিজেদের কাজের পরিবেশ উন্নত করার চেষ্টার অধিকার থাকবে না, এটা মানা যায় না। প্রথম প্রশ্নটি অনেক বেশি প্যাঁচালো। যৌনতা আর যৌন আচারের ঠিক-বেঠিক বিভিন্ন সমাজে আলাদা আর সময়ের সঙ্গে তার সামাজিক বিধিবদ্ধতাতেও নানা রকম বদল ঘটে। তবে বিবাহবদ্ধ যৌনতাই একমাত্র পবিত্র যৌনতা— এ-কথা বহু মানুষের বিশ্বাস।

অকুতোভয় তুষার রায় বলেছিলেন, সব কিছুরই অবতংশে আছে মৌল কিছু ব্যাপার,/ বাড়ালে বাড়ে, কমালে কমে/ সঙ্কোচনে দারুণ জমে—/ যেমন ধরো দেড় ঘণ্টার বে’ বেশ্যার/ সময়টাকে বাড়িয়ে নিলেই অনন্তকাল পুজো পেত সতী। যৌনকর্মীদের ইস্তাহারে আমরাও একটা বেয়াড়া প্রশ্ন তুলেছিলাম যে, অসংখ্য অসুখী বিয়েও কি যৌনতা আর গ্রাসাচ্ছাদন বিনিময়ের একটা পরিসর নয়? বার্নার্ড শ আমাদের দুঃসাহসী হতে বলেছিলেন। আমরা আবছা প্রস্তাব করেছিলাম— যৌনতা আর ভালবাসা স্বাধীনতার শর্তেই একমাত্র মিলতে পারে কোনও এক রাজার বা রানির রাজত্বে যেখানে সবাই রাজা।

গত দেড় শতক ধরে মেয়েদের নানা অধিকারের লড়াইও যৌনতায় পুরুষদের একচ্ছত্র দখলকে নানা যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নে বিদ্ধ করেছে। ফলত যৌনতার আদলেও অনেক বদল ঘটেছে। পণ্ডিত এবং তাত্ত্বিকেরা বিশদ আলোচনা করেছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কেমন সব সময়েই নারীর যৌন-আবেদন সম্পর্কে একই সঙ্গে তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছে আবার তাকে ভয়ও পেয়েছে। এই আকর্ষণ সংসারে কেমন ওলটপালট ঘটাতে পারে, তা নিয়ে আখ্যান আর সামাজিক উপদেশ অজস্র। তাই নানা আইন এবং অনুশাসন তৈরি হয়েছে মেয়েদের একগামী পারিবারিক ভালবাসায় বেঁধে রাখার জন্যে, পরিবারকে অটুট রাখার জন্যে। এই চৌহদ্দির মধ্যে মেয়েদের জন্যে নির্দিষ্ট করা ভূমিকা মূলত সন্তান উৎপাদনের— সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিতর্কহীন আয়োজন করাই তার কাজ। তার ব্যক্তিগত সুখ এবং চাহিদা সেখানে সম্পূর্ণ গৌণ।

প্রায় এক শতক ধরে ক্রমশ এই সওয়াল জোরালো হয়ে উঠেছে যে, যৌনতা শুধুমাত্র একটি কর্তব্য নয়, মানুষের জীবনে তা এক অন্যতম আনন্দের পরিসর। তার নানা ধরন এবং প্রকাশ দোষের কিছু নয়। যেমন, সমকাম সন্তান উৎপাদন বহির্ভূত যৌনতা বলে প্রায় সারা বিশ্বে বেআইনি এবং কুরুচিকর বলে গণ্য হত। এখন আবার অনেক দেশেই সমকামী ভালবাসা আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। যে-সব দেশে পায়নি সেখানেও সমকাম সম্পর্কে সামাজিক সহিষ্ণুতা বহুগুণ বেড়ে গেছে।

পরিবারগুলোর কাঠামোও বদলে গেছে অনেক। বিরাট যৌথ পরিবারের সংখ্যা হ্রাসমান। দাম্পত্যের অংশীদাররা বহু অভিভাবক-বিশিষ্ট পরিবারের ভ্রুকুঞ্চনের বাইরে তাদের যৌনতাকে পরখ করে নিতে পারছে। শহুরে অণু পরিবারগুলিতে বেশির ভাগ মেয়েই চাকুরে কিংবা আর্থিক ভাবে স্বাধীন। নিজের শরীর আর মনের উপর তাদের দখল এখন অনেক বেশি। গ্রামীণ এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা— পুকুরে সাঁতার কাটা মেয়েটিও প্রকৃত প্রস্তাবে তাদের মধ্যেই পড়বে— অতটা স্বাধীন নন।

যখন মুম্বইতে বার ডান্সিং নিষিদ্ধ হয়, বহু মেয়ে রাতারাতি কর্মহীন হন— তাঁরা আন্দোলনে নামেন, কলকাতায় যৌনকর্মীদের সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক বৈঠক এবং মিছিল করেন। তাঁদের একটি অবিস্মরণীয় স্লোগান ছিল: মেরা মন, মেরা তন, তেরা বাপ কা কেয়া উখারতা?

অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলেনি। অনেক প্রশ্নেই যৌনকর্মীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের আলোচনা, বোঝাপড়ার দরকার ছিল। ক্ষমতার দুর্গের চার দিকে দুর্ভেদ্য নীরবতার প্রাকার থাকে। তবু কিছু লোককে স্বর্গে হানা দেওয়ার সাহস দেখাতে হয়। না হলে কী করে ফিরে পাওয়া যাবে কোনও স্বর্গের অধিকার?

অন্য বিষয়গুলি:

Sex Workers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy