বছরকয়েক আগে পুজোর ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। ছিমছাম মধ্যবিত্ত পরিবার। স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি আর এক শিশু, আমাদের সঙ্গে একই হোটেলে। অল্প আলাপেই বোঝা গেল শিশুটির বাবা রগচটা। সবেতেই তাঁর অসন্তোষ, চেঁচামেচি। সামান্য বিরুদ্ধমত প্রকাশ, যৎসামান্য কিছু ভুলেই স্ত্রী’র প্রতি গলগলিয়ে বেরোতে থাকে অশ্রাব্য কথার স্রোত। মেয়েটি শিক্ষিত, চাকরি করেন। তবুও ভরা পর্যটনস্থলে, সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে একনাগাড়ে তিনি সহ্য করে যান গালাগালি। আর আশ্চর্য, সামান্য প্রতিবাদটুকুও না করে ভদ্রলোকের বাবা-মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছেলেকে তোয়াজ করতে। কারণ, তিনি নাকি “এমনিতে খুব ভাল মনের মানুষ, খালি মাথাটা গরম।”
সম্প্রতি ওয়েবসিরিজ় লজ্জা দেখতে গিয়ে বার বার সেই মধ্য ত্রিশের মেয়েটির অপমানে, লজ্জায় কালচে হয়ে যাওয়া মুখটা মনে পড়ছিল। টিভির পর্দায় জয়ার অবস্থাও তো তাই। অহরহ তুচ্ছ কারণে তার স্বামী পার্থ তাকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করে। কখনও একলা ঘরে, কখনও এক ঘর লোকের সামনে। উঁহু, পার্থ অত্যাচারী নয়। একটি বারও গায়ে হাত তোলে না সে। শুধু বাক্যবাণে বুঝিয়ে দেয় জয়া আসলে অপদার্থ, মানসিক ভারসাম্যহীন। আর প্রতি মুহূর্তে পার্থের কথার আঘাতে রক্তাক্ত হয় জয়া, অসম্মানে মাটিতে মিশে যায়।
জয়ার পাশে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়ানো মানুষের অবশ্য অভাব হয়নি, তারাই সুপরামর্শ দিয়ে ঠিক রাস্তাটি চিনিয়ে দিয়েছে। আত্মবিশ্বাস ভেঙে চুরচুর হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে নতুন করে গড়ার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু বাকিদের কি এই জোরটুকুও থাকে? আসলে ‘ভার্বাল অ্যাবিউজ়’ এমনই একটি বিষয়, যাকে ‘নির্যাতন’ বলে সংজ্ঞায়িত করা খুব কঠিন। শারীরিক নির্যাতন প্রমাণ করা সহজ। কিন্তু গায়ে একটি কালশিটের দাগও না ফেলে যে এক জন মানুষকে ভিতর থেকে ভেঙেচুরে সম্পূর্ণ তছনছ করে দেওয়া যায়, মৌখিক নির্যাতন বার বার তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
অথচ, ভারতের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, যেখানে মেয়েদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করাকেই ‘পৌরুষ’-এর চিহ্ন বলে মনে করা হয়, সেখানে মৌখিক নির্যাতন অপরিচিত নয়। দৈনন্দিন জীবনে গৃহস্থ ঘরে উঁকি দিলেই দেখা যায় এমন সব কুরুচিকর কথার চাষ। তা যে সব সময় চিৎকার, অশ্রাব্য শব্দ আওড়ানোর পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তা নয়। বরং কথার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা বিদ্রুপ, তির্যক উক্তি, বার বার দুর্বল জায়গায় আঘাত করাতেই লক্ষ্য পূরণ হয় অনায়াসে। সেগুলিও কি নির্যাতন নয়? অথচ, প্রতিবাদ আসে কতটুকু? শব্দেরা মিলিয়ে যায়, চিহ্নটুকুও না রেখে। চিহ্ন-প্রমাণ না-রাখা কথার চাবুকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় বা সাহস ক’জনের থাকে?
এই মৌখিক নির্যাতন শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক নয়, যে কোনও সম্পর্কের মধ্যেই দেখা যায়। প্রবীণদের উপর নির্যাতনের যে খবর হামেশাই পাওয়া যায়, মৌখিক নির্যাতন তার অন্যতম অংশ। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে, অনেক সময়ই নির্যাতনকারীর স্বপক্ষে বলা হয় তাঁর এক অন্ধকার অতীতের কথা। তিনি নিজে অতীতে লাঞ্ছিত বা মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, ফলে অন্যের উপর নির্যাতন তাঁর কাছে সহজ, স্বাভাবিক ঘটনা, এতে তাঁর কোনও অপরাধবোধ জাগে না। কিন্তু সব সময়ই এমনটা সত্য নয়। মন-চিকিৎসক আবীর মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশে মানুষ হয়ে, সমস্ত সুবিধা ভোগ করেও এক জন এমন কথাবার্তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন, তাঁর নিজস্ব ‘চরিত্রগুণ’-এ।
মানসিক সুস্থতা বিষয়ে সচেতনদের কাছে ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দটি এখন আর অচেনা নয়। ১৯৩০-এর দশকে এক ব্রিটিশ নাটক ‘গ্যাসলাইট’ থেকে কথাটি এসেছে। নাটকে দেখানো হয়েছিল এক স্বামী তাঁর স্ত্রী’কে নানা উপায়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিলেন যে, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। অন্যের ভাবনার উপর এই নিয়ন্ত্রণ, তাকে নিজের ভাবনার আদলে গড়ে নেওয়ার চেষ্টা দেখা যায় মৌখিক নির্যাতনেও। এটি শুধুমাত্র কিছু ছুড়ে দেওয়া কথার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্রয় পেলে তার ধার ও মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এবং গ্যাসলাইটিং-এর মতোই এ ক্ষেত্রেও নির্যাতিতের নিজের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়। দীর্ঘ দিন ধরে যিনি মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, এক সময় বিশ্বাস করে নেন যে, তিনি সত্যিই মানসিক ভাবে অসুস্থ, অপদার্থ, কোনও কাজই ঠিক ভাবে করতে পারেন না। এমনকি সামান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি দোলাচলে ভোগেন। পরিণতি, বাইরের সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকা, নিজের অবস্থার কথা নিকটজনের কাছেও মন খুলে বলতে না পারা। বিশেষ করে, যাঁরা গোড়া থেকেই মানসিক উদ্বেগে ভোগেন, তাঁরা মৌখিক নির্যাতনের শিকার হলে অবসাদ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার অথবা আত্মহত্যার প্রবণতার মতো মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারেন। এবং সেই প্রভাব শুধুমাত্র নির্যাতিতের মানসিক জগৎটিকেই তছনছ করে না। গুরুতর শারীরিক সমস্যারও সূত্রপাত করতে পারে।
সমস্যা হল, ‘নির্যাতন’-এর ক্ষেত্রে এখনও শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টিই গুরুত্ব পায় সর্বাধিক। কিন্তু বাস্তবে মানসিক নির্যাতনের রেশ থেকে যায় বহু কাল। অথচ আশ্চর্য, নিয়মিত মানসিক ভাবে অত্যাচারিত হয়েও সেগুলোকে নির্বিবাদে মেনে নেওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী নির্যাতিতের মগজে এই ধারণা সফল ভাবে গেঁথে দিতে পারে যে, এমন কথাগুলির মধ্যে কোনও অ-স্বাভাবিকতা নেই, বরং পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানোটাই বাড়াবাড়ি। আবার অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিত এটুকু উপলব্ধিই করতে পারেন না যে, তাঁর সঙ্গে যা ঘটে চলেছে তা আসলে ‘অপরাধ’। একটি সপাট চড়ের চেয়ে জনসমক্ষে বা বন্ধ দরজার আড়ালে কিছু বিষমাখানো কথা উগরে দেওয়ার গুরুত্ব কিছুমাত্র কম নয়। এবং চাইলে এতে আইনি সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে।
মৌখিক নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যে কোনও যৌনগন্ধী মন্তব্য ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৯ নম্বর ধারায় সব সময় শাস্তিযোগ্য। যাঁর উদ্দেশে মন্তব্যটি করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে তাঁর যদি ‘সম্মতি’ না থাকে, তিনি অবশ্যই পুলিশের দ্বারস্থ হতে পারেন। অন্য দিকে, গার্হস্থ নির্যাতনের ক্ষেত্রে ৪৯৮এ আইনটিতে দু’ধরনের নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে— শারীরিক এবং মানসিক। মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি এখানে সুস্পষ্ট ভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি, পরিসরটিকেও যথেষ্ট বড় রাখা হয়েছে। কারণ, এই ক্ষেত্রে কোন ধরনের মানসিক নির্যাতনকে এক জন মহিলা ‘অত্যাচার’ হিসাবে গণ্য করবেন, সেটি নির্বাচনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে মেয়েদের উপরেই। যে কোনও শব্দ বা শব্দবন্ধ, যা মেয়েটির মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করতে পারে, অথবা তিনি ভাবতে পারেন তাঁর মানহানির উদ্দেশেই কথাগুলি বলা হচ্ছে, তাকে মানসিক নির্যাতন ধরে তিনি আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। অন্য দিকে, স্বামী ছাড়া অন্য কেউ যদি এ ধরনের মন্তব্য করেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার কথাও ভাবা যায়। শুধুমাত্র মহিলারাই নন, পুরুষরাও মৌখিক নির্যাতনের শিকার হন বিভিন্ন ভাবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরাও আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।
তবে মৌখিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রমাণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ৪৯৮এ-র ক্ষেত্রেও যেমন এখন সরাসরি গ্রেফতার করা চলে না, আগে পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখতে হয়, সত্যই নির্যাতনের কোনও ঘটনা ঘটছে কি না, মৌখিক নির্যাতনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি আলাদা নয়। সমস্যা হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৌখিক নির্যাতনের প্রমাণ জোগাড় করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কিছু কটুকথা লিখিত ভাবে পাঠানো হলে সেটা প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য হয়। কিন্তু বন্ধ দরজার আড়ালে কিছু আপত্তিকর শব্দের প্রয়োগে সেই সুযোগ কোথায়? কথাগুলি রেকর্ড করেও পেশ করা চলে না, তা ‘রাইট টু প্রিভেসি’র পরিপন্থী। একমাত্র এই নির্যাতন যদি অন্য কারও সামনে হয়, এবং তিনি বা তাঁরা যদি নির্যাতিতের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত থাকেন, তবে তা প্রমাণ করা সহজ হয়। এই ফাঁকটুকু থাকে বলেই হয়তো বহু মৌখিক নির্যাতন অশ্রুত, অ-বিচার্য থেকে যায়, আজও।
তবে আত্মসম্মান বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে নামাটা জরুরি। ‘কালের নিয়মে ভুলে যাওয়া’ নয়, বরং মনে রাখাটাই কাজ। বিনা সম্মতিতে কেউ যে কারও সত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না, তাকে যথেচ্ছ ভাবে ধুলোমলিন করতে পারে না— সেই একেবারে প্রাথমিক মানবিক বোধ কি কখনও ভুলে যাওয়ার বিষয় হতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy