পশ্চিমবঙ্গের শহরতলিতে যাঁরা বাস করেন, একটা না একটা মুদির দোকান তাঁরা অবশ্যই দেখতে পান যার নাম ‘লক্ষ্মী ভান্ডার’। সম্পদের দেবীর নামে দোকান খোলা, সেখানে সব পাওয়া যাবে, কোনও কিছুই ‘নেই’ বলতে হবে না— এই ভেবেই হয়তো এই অতি জনপ্রিয় নামকরণ। তবে বাংলায় ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ শুধু প্রাচুর্য নয়, সঞ্চয়ও বোঝায়, তাই অনেকেই টাকা জমানোর ভাঁড়কেও ‘লক্ষ্মীর ভাঁড়’ বলে থাকেন।
গত কয়েক বছর ধরে এই শব্দবন্ধ পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও রাজনীতিতে বিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠেছে। এতটাই যে, আর জি কর কাণ্ড নিয়ে সাম্প্রতিক আলোড়নের মধ্যেও এর উল্লেখ শোনা গেছে। পঁচিশ থেকে ষাট বছর বয়সি যে মহিলারা আয়কর দেন না, চাকরি করেন না, পেনশন পান না, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় পড়েন, তাঁদের জন্য সামান্য কিছু মাসিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছে যে সরকারি প্রকল্প— তারই নাম লক্ষ্মীর ভান্ডার। মোটের উপর নিম্ন মধ্যবিত্ত মহিলারা (মূলত গৃহবধূরা ও গৃহকন্যারা) এই প্রকল্পের উপভোক্তা। দেবী লক্ষ্মীর দাক্ষিণ্যবঞ্চিত যে গৃহলক্ষ্মীরা, তাঁদের কাছে এই প্রকল্পের নামকরণ একটা পরিহাসের মতো মনে হতেও পারত, কিন্তু হয়নি। বরং এই প্রকল্পের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অজস্র প্রশ্ন (এবং আপত্তি) ঘনিয়ে তুলেছে তাঁদের মনে, যাঁরা এই প্রকল্পের গ্রাহক নন।
যে প্রশ্নগুলো উঠেছে তা এই রকম: ক) কিছু না করে কেউ কেন টাকা পাবে? সবাই খেটে খাক, কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালন করে রোজগার করুক; খ) এই টাকা আসলে ভিক্ষা দেওয়া; এই ভাবে টাকা পেয়ে মানুষ কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছেন, কাজের জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না; গ) আমাদের করের টাকায় সরকারের খয়রাতির কী দরকার? ঘ) অনেক মহিলা এই টাকা পাচ্ছেন যাঁদের আদৌ তা দরকার নেই (কারণ তাঁদের স্বামী চাকরি করেন); ঙ) যাঁরা ফুটপাতে থাকেন তাঁদের কথা না ভেবে সরকার কেন গৃহবধূদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে? চ) শাসক দলের পক্ষে এ এক ধরনের লোভ দেখানো, যাতে তাদের ভোটব্যাঙ্ক ও ক্ষমতায় থেকে যাওয়া অটুট থাকে (এবং এই টাকার পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলবে)।
বিশদ আলোচনার আগে দু’টি কথা মনে করিয়ে দেওয়া যাক। যে কুবেরের সম্পদ পেয়ে গৃহবধূরা ‘কুঁড়ে’ হয়ে যাচ্ছেন বলে ভয় পাওয়া হচ্ছে, তার পরিমাণ মাসে ১০০০ টাকা, বিশেষ ক্ষেত্রে ১২০০ টাকা, এক বার রেস্তরাঁয় খেলেই যার বেশি খরচ হয়ে যায়। আর বয়স্কদের জন্য, বিধবা মহিলাদের জন্য এবং শারীরিক ভাবে অক্ষমদের জন্য সমপরিমাণ ভাতার প্রকল্প ইতিমধ্যেই চালু আছে, কিন্তু তার না আছে এত প্রচার, না আছে তার বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ। মানে এঁদের সাহায্য পাওয়ায় কারও ততটা আপত্তি নেই, যতটা রয়েছে গৃহবধূদের প্রাপ্তিতে। আর এই আপত্তি জানানোর তালিকায় মহিলাদের (চাকুরিরতা ও সম্পন্না) সংখ্যাও যথেষ্ট।
এঁদের প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগের উত্তরে বলা যায়, ‘কিছু না করে’ যাঁরা এই টাকা পাচ্ছেন বলে ভাবা হচ্ছে, তাঁরা আসলে সকাল থেকে রাত অবধি সংসারের কাজ করেন। বলা বাহুল্য, এঁদের পরিচারিকা রাখার সামর্থ্য নেই। রান্নাবাড়া-সহ ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম, প্রয়োজনে স্বামীকে খাবার পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদির পর, দিনের শেষে এঁদের হাতে ‘কুঁড়ে’ হওয়ার কোনও সুযোগই থাকে না, আর মাসের শেষে নিজের ‘উপার্জন’ বলেও কিছু হয় না। তা হলে কি ঘরের কাজের মধ্য দিয়ে একটি পুরুষকে মাঠে-কারখানায় সারা দিন কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া, একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে শিশুদের ইস্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কোনও সামাজিক মূল্য নেই? এমন কিছু কি দেখা গেছে যে, যাঁরা অন্য কাজ করতেন (সংসারে দরকার বলেই তো করতেন), লক্ষ্মীর ভান্ডার চালু হওয়ার পর তাঁরা সে সব কাজ ছেড়ে দিয়েছেন? তা সম্ভবই নয়, কারণ হাজার টাকায় কারও সংসারের বিশেষ সুরাহা হয় না। বরং যে মহিলারা এই প্রকল্পের সুবিধা পান, তাঁরা অনেকেই সাধ্যমতো বাইরের কাজও করেন (পরিচারিকার কাজ বা অন্য কিছু)। তবে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে হাজার-বারোশো টাকা এখনও সংসারের ছোটখাটো কেনাকাটা, ওষুধপত্র, সামান্য শখ-আহ্লাদ মেটানোর জন্য নেহাত কম নয়। দরিদ্র মানুষের সামান্য শখ-আহ্লাদ মেটানোর সামর্থ্যটুকু থাকা যে আখেরে দেশের অর্থনীতির পক্ষেই ভাল, এ কথা বিভিন্ন অর্থনীতিবিদই বলেছেন।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় আমরা দেখেছি, অনেক মহিলা জানিয়েছেন যে, দিনভর সংসারের দায়িত্ব নিতে না হলে তাঁরাও মাসে কয়েক হাজার টাকা রোজগার করতে পারতেন। তা হলে ঘরকন্নার কাজে সারা দিন ব্যস্ত থাকার জন্য এক জন মহিলা যদি অন্য উপার্জনের কাজ করতে না পারেন, তার মানে কি তিনি কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছেন? তিনি কেন মাসের শেষে নিজের সামান্য উপার্জন থেকে বঞ্চিত হবেন? না কি শুধুমাত্র বাইরের কাজেরই (তা অন্যের সংসারের ঘরকন্না সামলানো হলেও) আর্থিক মূল্য আছে? আসল কথা হল, ঘর-গৃহস্থালির তথাকথিত মেয়েলি কাজগুলোকে কেউ গুরুত্বপূর্ণ মনেই করেননি, তাই এক জন গৃহবধূর সারা দিনের শ্রম বিনামূল্যে গ্রহণ করাটা কারও শোষণ মনে হয়নি। কিন্তু তাঁরাই ‘মুফতে’ নিজের নামে টাকা পেলে তাকে ভিক্ষা ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না।
মনে রাখা ভাল যে, কর কিন্তু সবাই দেন— যে কোনও জিনিস কিনতে গেলে ক্রয়মূল্যের সঙ্গেই কর ধরা থাকে— আর সেটা ধনী-গরিবের ক্ষেত্রে আলাদা নয়। উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে শুধু আয়করটাই অতিরিক্ত দিতে হয়। সুতরাং কার করের টাকা কোন কাজে লাগছে, সে হিসাব অত সহজ নয়। তেমনই দরকার বিষয়টাও আপেক্ষিক; যাঁর স্বামী বা ছেলে ভাল কাজ করে, ধরে নেওয়া হচ্ছে তাঁর ‘নিজস্ব’ উপার্জন দরকার নেই। সেই মহিলা যদি তাঁর সুবিধামতো কোনও চাকরি জোগাড় করেন, তখন কিন্তু আমরা ভাবি না যে, চাকরিটা তাঁর দরকার কি না (সেটা ভাবা উচিতও নয়)। কিন্তু গৃহস্থালির কাজের জন্য তিনি সামান্য টাকা হাতে পেলেও আমাদের মনে হয় এটা দরকার নেই।
গৃহবধূদের পারিশ্রমিক নিয়ে কথাবার্তা অনেক হয়, কিন্তু নিয়ম করে তাঁদের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার ধারণা কেউই বাস্তবায়িত করেনি। লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর রূপরেখাতেও এই উদ্দেশ্যের কথা বলা নেই। বর্তমান লেখক বহু দিন আগে এই বিষয়ে কিছু নিজস্ব ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন (আবাপ, ২৪ মার্চ ২০১৬)। সেই ভাবনায় গৃহশ্রমের বেতন হিসাবে সরকার-নির্দেশিত উপায়ে কী ভাবে গৃহবধূদের হাতে কিছু টাকা আসা সম্ভব, তার প্রস্তাবনা ছিল। লক্ষ্মীর ভান্ডার সেই প্রস্তাবের অনুসরণ না করলেও, শেষ অবধি শুধু গৃহকর্মীদের হাতেও ‘নিজের’ বলে যে কিছু টাকা আসছে, সেটা একটা বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ বলে মেনে নিতেই হচ্ছে। এই প্রকল্পের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্যান্য রাজ্যেও অনুরূপ কিছু প্রকল্প (যেমন মহারাষ্ট্রে ‘লাডলী বহেনা’) চালু হয়েছে। আর যে টাকা মহিলাদের হাতে যায়, সেটা যে সংসারের উপকারেই লাগে তা নিয়ে নিশ্চয়ই কারও সন্দেহ নেই।
দুঃখজনক এটাই— মেহনতি মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে যে রাজনৈতিক দল, তার সদস্যরাও এই প্রকল্পকে ‘ভিক্ষা’ বলতে দ্বিধা করেন না। যে সরকারের আমলে যে প্রকল্প রূপায়িত হয়, তারা সেটা সেই রাজনৈতিক দলের বদান্যতা বলে দাবি করে। সেই দাবিটা যে ভুল, মানে প্রকল্পটা যে সরকারের, দলের নয়— এই কথাটা বুঝিয়ে দিতে গেলে প্রকল্পটাকে অস্বীকার করতে হয় না। জনদরদি প্রকল্পের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে, সরকার বদলালেই যে প্রকল্প বন্ধ হয় না, এমন আশ্বাস স্পষ্ট করাই বরং বেশি দরকারি। সেই সঙ্গে, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা নিলেই সরকারের সমালোচনা করা যাবে না— এমন ভাবনাও যে অযৌক্তিক, এটাও পরিষ্কার করে দেওয়া তাঁদেরই কর্তব্য। এই ভাবে যদি গৃহকর্ম ও গৃহবধূদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি একটুও বদলায়, সেটাই মঙ্গল। বেকার যুবকদের জন্য তাঁরাও এক সময় বেকার ভাতা চালু করেছিলেন, কেউ তাকে ভিক্ষা মনে করেননি।
শেষে দু’টি উদাহরণ। মালতী নস্কর (নাম পরিবর্তিত)। বয়স পঞ্চান্ন, স্বামী নিরুদ্দেশ। অল্পবয়সে আয়ার কাজ করতেন, এখন বাতের ব্যথায় কাতর। ঘরে বসে সামান্য কাজ করেন, সঞ্চয়ও কিছু নেই। বিবাহিতা মেয়ে দেখাশোনা করে, কিন্তু ওষুধ, দরকারি জিনিসের জন্য হাত পাততে সঙ্কোচ হয়। লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা থেকে নিজের খরচ চালান, বাকিটুকু জমান। ষাট পেরোলে বার্ধক্য ভাতা কী ভাবে পাবেন, এখন থেকে খোঁজ করছেন। সীমা হাজরা (নাম পরিবর্তিত), বয়স পঁয়তাল্লিশ। স্বামী নিরাপত্তাকর্মী, দুই সন্তান, ছোট মেয়ে পড়াশোনা করে। সংসারে কাজের পাশাপাশি সীমা তিন বাড়িতে কাজ করেন। লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা মেয়ের প্রাইভেট টিউশনে খরচ করেন, বাকি টাকা জমিয়ে পুজোয় একটি শাড়ি কিনেছেন।
দেশের মোট সম্পদের শতকরা আশি ভাগ যাঁরা কুক্ষিগত করে রেখেছেন তাঁরা লজ্জিত হন না, আর সরকারের থেকে এই সামান্য টাকা পাচ্ছেন বলে এই আপাদমস্তক কর্মী-মহিলাদের লজ্জা পেতে হবে!
রসায়ন বিভাগ, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy