২৫ মার্চ, ১৯৭১। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সে দিন রাতে বাংলাদেশের জনগণের উপর নৃশংস ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে ‘মুজিবনগর’ নাম দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহিলারা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে অংশগ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁদের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মেয়েদের যুদ্ধে পাঠানোর নীতি তখনও গ্রহণ করেনি। যুদ্ধে মেয়েরা অংশ নেবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হলেও, তাঁদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছিল। নানা শরণার্থী শিবির থেকে এসেছিলেন প্রায় তিনশো মহিলা। সিভিল ডিফেন্স, অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও নার্সিং ট্রেনিং দেওয়া হত। এই ক্যাম্পের পরিচালনা করেছেন তৎকালীন বাংলাদেশের সাংসদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি ক্যাম্প পরিচালনার বিষয়ে বলেছেন “ডা. লাল, ডা. ঘোষ, মীরা দে, ফুলরেণু গুহ, প্রতিভা বসু প্রমুখ নিয়মিত সহযোগিতা করেছেন। ভারতীয় জনগণ এবং দেশটির নারীসমাজও এ ভাবেই হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা।” (আফসান চৌধুরী, বাংলাদেশ ১৯৭১)
অস্ত্রচালনা শিখেও যুদ্ধে যাওয়ার সরকারি অনুমোদন না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন মহিলারা। অনেকে মনে করেন, মূল সমস্যা ছিল অস্ত্রের সঙ্কট। দ্বিধা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে মেয়েদের পাঠানোতেও। তা সত্ত্বেও মেয়েরা যুদ্ধের ময়দান ছাড়েননি। কেউ যুদ্ধের খরচ জোগাতে অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছেন, কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন, কেউ গোপনে অস্ত্র জোগান দিয়েছেন, কেউ মুক্তিযোদ্ধাকে গোপন আশ্রয় দিয়েছেন, গোবরা ক্যাম্পের প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের নানা অনুষঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছেন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী ছিলেন লাইলা পারভীন বানু। পড়াশোনা শেষ না করেই সীমান্ত পেরিয়ে গোবরা ক্যাম্পে চলে আসেন। ইচ্ছে ছিল অস্ত্রচালনা শিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করবেন। সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তবে ক্যাম্পের মধ্যেই তাঁর ডাক্তারি বিদ্যাচর্চার কিছুটা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেন্ট জনস অ্যাম্বুল্যান্স অ্যাসোসিয়েশন মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিতে গোবরা ক্যাম্পে আসত। অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত এক চিকিৎসক লায়লা পারভীন বানুকে হাতেকলমে কিছু চিকিৎসাবিদ্যা শিখিয়েছিলেন, যাতে প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে পারেন। গোবরা ক্যাম্প থেকে মেয়েদের ট্রেনিং দিতে নিয়ে যাওয়া হত শিয়ালদহ বি আর সিংহ রেলওয়ে হাসপাতালেও। লাইলা পারভীন বানুও এই হাসপাতালে ট্রেনিং নিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ফিরে তিনি স্মরণ করেন সেই দিনগুলির কথা, “মীরাদিরা এসে আমাদের ক্লাস নিতেন চে গুয়েভারার ওপর। দুনিয়ার কোথায় কোথায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, কী ভাবে করেছে- এই ক্লাসগুলো নেওয়া হত।...সবাই আসলে এখানে এসেছিল যুদ্ধ করার জন্য।”
ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিরিন বানু মিতিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাস্তায় নেমে ব্যারিকেড তৈরি করেন পাকিস্তানি সেনাদের প্রবেশ আটকানোর জন্যে। এক সময় বুঝলেন, মেয়ে হয়ে সব কাজে অংশ নেওয়া যাবে না। কাজ শুরু করলেন পুরুষের ছদ্মবেশ ধরে। তাঁর পরিচয় প্রকাশ হওয়ার পর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে তৈরি গোবরা ক্যাম্পে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল প্রশিক্ষণ নিতে। গোবরা ক্যাম্প থেকে তাঁকে কাজে পাঠানো হয় আগরতলা। আগরতলাতে ছিল গুপ্তখালি ক্যাম্প। গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গীতা করের যুদ্ধে যাওয়ার সাধ পূরণ হয়েছে হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের সেবা করে। একই ভাবে গোবরা ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচর্যার কাজে আগরতলা হাসপাতাল ক্যাম্পে যুক্ত হয়েছিলেন গীতা কর, গীতা মজুমদার সমেত আরও অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতাকামী বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার চরম রূপ নারী নির্যাতন। এক দিকে গণহত্যা, অপর দিকে নারীর উপর পৈশাচিক অত্যাচার। সারা বিশ্বে এই নির্মমতার খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্যে তৎকালীন বাংলাদেশের মহিলা পরিষদের সদস্যরা ভারতের নারী ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রচার অভিযান চালালেন ভারতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়ে সভা-সমাবেশ ও প্রচার-আন্দোলন চালিয়েছিলেন অরুণা আসফ আলি, গীতা মুখোপাধ্যায়, নিবেদিতা নাগ, ইলা মিত্র প্রমুখরা। এঁদের প্রচেষ্টাতে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয় বিশ্ব গণতান্ত্রিক নারী ফেডারেশনের নেত্রী ফ্রিডা ব্রাউনকে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা নারী ও মহিলা পরিষদকে তিনি সমর্থন জানান।
যুদ্ধশেষে স্বাধীন রাষ্ট্রে নারীর আর এক প্রকার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ধর্ষিত নারীকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়ে আলাদা বর্গে ফেলা হয়েছে। তাঁদের নিয়ে পরিবার, সমাজ বিড়ম্বিত। তাই দাবি করা হচ্ছে ‘বীরাঙ্গনা’ নয়, এই সব মেয়েদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলতে হবে। স্বাধীনতার যুদ্ধে তাঁদের অংশগ্রহণের গৌরব চাপা পড়ে যায় ধর্ষিত নামকরণের চিহ্নিত বলয়ে বিভক্ত করলে। মুক্তিযোদ্ধা নারীদের নিয়ে এখনও গবেষণা ও বিতর্ক অব্যাহত।
বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy