গত দেড় মাস ‘জাস্টিস’ শব্দটি পশ্চিমবঙ্গের আকাশে বাতাসে কয়েক কোটি বার ধ্বনিত হয়েছে। যে অভূতপূর্ব গণআন্দোলন দেখছি আমরা, তা রাজ্যের বা দেশের সীমানা অতিক্রম করে পৃথিবীর বহু মানুষকে ব্যথিত ক্রুদ্ধ আলোড়িত করেছে। প্রতিটি মিছিলে অনেক বয়স্ক অশক্ত মানুষকে দেখা যাচ্ছে, অনেককে দেখা যাচ্ছে যাঁরা আগে কোনও দিন কোনও মিছিলে হাঁটেননি, যাঁরা রাজনীতি ভালবাসেন না এবং সব রকম ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলতে চান। তাঁরা সবাই হাঁটছেন, স্লোগান দিচ্ছেন, পথ অবরোধ করছেন। এবং, সর্বোপরি, জাস্টিস বা ন্যায় বিচার চান।
এত আকুল ভাবে, একাধারে এত বেদনা ও ক্রোধের সঙ্গে জাস্টিস তথা ন্যায় লোকে চাইছে কেন? সাধারণ ভাবে আন্দোলন করেন তাঁরা, যাঁরা নিজেরা সরাসরি কিছু হারিয়েছেন বা হারানোর আশঙ্কা করছেন। তাঁদের আন্দোলনে অনেক সময়েই আরও অনেকে যোগ দেন, কিন্তু সেটা মূলত একটা সংহতি জানানোর ভূমিকায়। এ ক্ষেত্রে তা নয়। যে-হেতু অপরাধটা হয়েছে এক জন ডাক্তারের বিরুদ্ধে, তাই ডাক্তারদের আন্দোলনের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে, ঠিকই। কিন্তু বিভিন্ন মিছিল জমায়েত রাত দখল ভোর দখল ইত্যাদিতে বোঝা যাচ্ছে যে, ডাক্তারদের আন্দোলনে সংহতি বা সলিডারিটি জানানোর সঙ্গে রাস্তায় নামা প্রতিবাদীদের নিজেদের মনের একটা গভীর আবেগের তাগিদও স্পষ্ট। তাঁরা নেমেছেন শুধুমাত্র এক জন মহিলা-ডাক্তারের বিরুদ্ধে হওয়া নির্মম, অভাবনীয় অত্যাচারের বিচার চাইতে নয়, নেমেছেন এক জন মহিলার বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের বিচার চাইতে, এবং তার থেকেও বেশি এক জন সহনাগরিকের উপর হওয়া অত্যাচারের বিচার চাইতে। এবং সর্বোপরি, সাধারণ ভাবে ন্যায়বিচার চাইতে। এই শেষ কথাটার অভিঘাত গভীর এবং সর্বব্যাপী!
কিন্তু এখানেই পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একটা স্পষ্ট অপরাধ ঘটেছে, তার তদন্ত হবে, বিচার হবে, সেখানে মানুষের দুঃখিত, ক্ষুব্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে ন্যায়বিচারের দাবিতে এত দিন ধরে এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের কী প্রয়োজন? উত্তরটা কিন্তু সমগ্র রাষ্ট্র এবং আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য খুবই উদ্বেগের।
আইনের শাসন একটি সভ্য, সংবিধান পরিচালিত সমাজের প্রাথমিক শর্ত। রাষ্ট্রের থেকে তার নাগরিকদের জাস্টিস তথা ন্যায়বিচার একটা প্রাথমিক প্রাপ্য বস্তু। তার দাবিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের দিনের পর দিন রাস্তায় মিছিল করার প্রয়োজনীয়তা থাকার কথা নয়। কিন্তু এই অভূতপূর্ব জনজাগরণ বলে দিচ্ছে যে, বিপুল জনসাধারণের এই বিশ্বাস নেই যে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, প্রশাসন, আদালত তাদের এই প্রাথমিক প্রাপ্যটুকু— ন্যায়বিচার— দিতে সক্ষম।
অপরাধমুক্ত সমাজ হয় না। অপরাধ হলে মানুষ পুলিশের কাছে যায় তদন্তের জন্য, তার পর আদালতে যায় সেই তদন্তের ভিত্তিতে বিচারের জন্য। এ ছাড়াও অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন মহিলা কমিশন, শিশু কমিশন, যাদের হস্তক্ষেপ মানুষ আশা করে অন্যায়ের প্রতিকারে। এই সব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন ভাবে কাজ করার কথা। সমাজের বিভিন্ন অংশের দিকে নজর রাখার কথা যাতে সমাজের ক্ষমতাবানরা অন্যদের উপর অত্যাচার না করতে পারে। বাস্তবে কিন্তু সেই কমিশনগুলি নেহাত অন্যায়ের রক্ষাকারী বা নখদন্তহীন দর্শকে পরিণত হয়েছে বলে মানুষ মনে করছে।
পুলিশের কাজে আস্থা না রাখতে পেরে অনেক সময় অনেকে আদালতে গেছেন এবং আদালত কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই বা ইডিকে দায়িত্ব দিয়েছে তদন্ত করার। অনেক সময় আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও তা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, মানুষ দেখেছে যে বছরের পর বছর ধরে তদন্ত শেষ হয়নি, অভিযুক্তরাও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অপরাধলব্ধ সম্পদ বাড়াচ্ছে, জনপ্রতিনিধি হচ্ছে।
আদালত মানুষের শেষ ভরসা। কিন্তু সেখানেও ক্ষমতাবানের রক্ষাকবচ পাওয়া এখন অতি সহজ, তদন্ত সে জন্যই অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া, উচ্চ আদালতগুলোতে ঠিকঠাক ভাবে দীর্ঘ দিন ধরে মামলা লড়তে গেলে যে পরিমাণ আর্থিক ও সামাজিক পুঁজি লাগে, তা আলাদা চর্চার বিষয়। কাগজে কলমে সব ব্যবস্থা থাকলেও কার্যক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ নয়, এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ দেশের অল্প কিছু ক্ষমতাবান ও বাকি বিপুল জনসাধারণের ক্ষেত্রে আলাদা।
তা হলে মানুষ যাবে কোথায়? দীর্ঘ দিন এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে, কোনও সদুত্তর না পেয়ে, মানুষ আজ ‘জাস্টিস’-এর জন্য পথে নেমেছে। এই আলোতেই বর্তমান জনজাগরণকে দেখতে হবে। এই আন্দোলনের ফলে যে দেশে রাতারাতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, তা নয়। কিন্তু মানুষের মনে ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা, দীর্ঘ দিন ধরে তা না পাওয়ার হতাশা ও বেদনা, এ বারের লড়াইয়ে জোরালো ও স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
একটা ব্যবস্থা টিকে থাকে শুধুমাত্র কাগজে লেখা আইনকানুন এবং তা কার্যকর করার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, টিকে থাকে দেশের নাগরিকদের তার উপর আস্থার কারণে। সেই আস্থায় যদি দীর্ঘ দিন ধরে ফাটল ধরতে থাকে, তখন মানুষকে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয় এবং তখন কোনও আইনের বই বা প্রতিষ্ঠানের ইমারতের পক্ষে সেই ব্যবস্থাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। আশা করি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তাব্যক্তিরা এই অভূতপূর্ব জনজাগরণের অন্তর্নিহিত আবেগটা গভীর ভাবে বোঝার এবং সেইমতো নিজেদের এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাটাকে পরিশুদ্ধ করার রাস্তায় কিছুটা হলেও অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা রাখবেন। গত কয়েক বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ঘটনা— পূর্ব ইউরোপ, মিশর, টিউনিজ়িয়া, চিলি, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ— দেখিয়েছে যে, শাক দিয়ে অনন্তকাল মাছ ঢাকা যায় না। অনেক মূল্যে, আমরা একটি আধুনিক গণতন্ত্র পেয়েছি। তাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা কর্তাব্যক্তিরা করতে না পারলে এক দিন মানুষই যা বোঝার বুঝে নেবে। বর্তমান আন্দোলনের থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রের প্রতি সতর্কবার্তা এটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy