শেষ দৃশ্যটা মনে আছে জোজো র্যাবিট ছবিটার? সদ্য মাতৃহারা জোজো ও তার সদ্য-হওয়া ইহুদি বন্ধু এলসা, নাৎসিদের পরাজয়ের পরে শহরে মিত্রশক্তির বাহিনী ঢুকতে দেখে এক অদ্ভুত নাচের মধ্যে দিয়ে নিজেদের মুক্তিকে উদ্যাপন করেছিল ওই দৃশ্যে। গত ২ মে আমার (এবং, আরও অনেকের) ঠিক সে রকম মুক্তির উচ্ছ্বাস দেখাতে ইচ্ছে করছিল।
বাংলার মানুষ রায় দিলেন, অতি দক্ষিণপন্থী আগ্রাসী ফ্যাসিস্ট শক্তিকে এ রাজ্যে তাঁরা চান না। উৎসব করার ইচ্ছে বাঙালি হওয়ার আনন্দে, গর্বে। অবশ্যই কৃতিত্ব প্রাপ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সামনে থেকে, রাস্তায় নেমে এই অসম লড়াই করে জেতা, ভারতের ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে কৃতিত্ব সাধারণ বাঙালির, বাংলার সুশীল সমাজের, যাঁরা রাজ্য সরকারের ভুলত্রুটিগুলির সমালোচনা করেও, তাদের ভাল কাজগুলিকে বেশি মান্যতা দিলেন এবং সর্বোপরি, বিভাজন এবং ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট জনাদেশ দিলেন। অভিনন্দন কেরল ও তামিলনাড়ুর ভোটারদেরও।
আমরা, বাঙালিরা চিরকালই নিজেদের প্রগতিশীল ভাবতে ভালবাসি। বিশ্বাস করতাম যে, বাংলায় বিজেপি কল্কে পাবে না। কিন্তু গত চার বছরে, বিশেষ করে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে সেই বিশ্বাস চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছিল। গেরুয়া শিবির ও কর্মী এবং নেতাদের কথায়, হাবেভাবে মনে হচ্ছিল, বাংলা দখল বুঝি হয়েই গিয়েছে। গজিয়ে উঠেছিল হাজার হাজার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, নিত্যদিন ছড়ানো হচ্ছিল বিভাজনের বিষ মেশানো ফেক নিউজ় ও ভিডিয়ো।
ভোটের আগে দল বদল চলল। রাজনীতির লোকেদের কথা ছেড়েই দিলাম, এমনকি আমাদের জগতের লোকেরাও হুড়মুড়িয়ে নাম লেখাতে ছুটলেন (অধিকাংশের ন্যূনতম রাজনৈতিক বা ইতিহাস চেতনা না থাকা সত্ত্বেও)। আওড়ালেন শিখিয়ে দেওয়া জুমলা ‘সুনার বাংলা’র স্বপ্ন দেখানোর বাণী— কোন তালেবর হওয়ার লোভে, তাঁরাই জানেন! যাঁরা সরাসরি যোগ দিলেন অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে, তাঁরা শুধু নন, বহু আপাত প্রগতিশীল একদা বন্ধুদেরও দেখলাম একই ধামা ধরতে, পরোক্ষ ভাবে হলেও। মুম্বইয়ে বা কলকাতার বাইরে অন্য কোথাও কাজ করতে গেলে একাংশ বলতে লাগলেন, “এ বার তো বিজেপি আসছেই!” সমমনস্করা (জাতীয় স্তরেও এরাই সংখ্যায় বেশি, সৌভাগ্যবশত) কাছে এসে আশঙ্কা ভরা গলায় শুধু বলে গিয়েছেন, “বাংলায় বিজেপি আসবে না তো?” এ এক অদ্ভুত অস্তিত্বের সঙ্কট।
এ সব কিছুর যবনিকা পতন ছিল ২ মে।
এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি। কারণ, রাজ্যে বিরোধীর আসনে বিজেপি। তাদের ভূমিকা কেমন হতে চলেছে সেটা তারা ফল ঘোষণার পরের দু’দিনেই বুঝিয়ে দিয়েছে। নব-নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তারা ফেক ভিডিয়ো আর খবর ছড়িয়ে দাবি করল রাষ্ট্রপতি শাসনের! সেগুলো মিথ্যে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের লোকেরা এখনও ছড়িয়ে চলেছে সেগুলি। তাদের রাজনীতির ব্র্যান্ড বদলাবে না। বরঞ্চ অতিষ্ঠ করে তোলার চেষ্টা করবে রাজ্য সরকারকে, চির-পরিচিত উপায়ে।
প্রাক্-নির্বাচন পর্বে, করোনা কালে বাম দলগুলির সাংগঠনিক কাজ, অল্পবয়সিদের সামনে তুলে আনা দেখে ভাল লেগেছিল। মনে হয়েছিল, যে বাম ভোট ১৯-এ বিজেপিতে গিয়েছিল, সেটা ফেরাতে এঁরা সত্যি উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু যত দিন গড়াল, তত দেখা গেল এঁদের মূল টার্গেট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপি নয়! বহু জায়গায় বাম ভোটার বন্ধুরা ফোন করে বলেছেন, তাঁদেরই পোলিং এজেন্টরা গোপনে ভোটটা বিজেপিকে দিতে বলেছেন! এমনকি দীপ্সিতার মতো প্রার্থীদের কেন্দ্রেও! বলতে গিয়েছি বামপন্থীদের, কিন্তু অবিশ্বাস করেছেন। বলতে গিয়েছি, আপনাদের কর্মীরা শীতলখুচি কিংবা জ্বালানির দাম বাড়াটাকেও প্রকারান্তরে সমর্থন করছেন। দেশকে পরিবেশবান্ধব করার জন্যই নাকি জ্বালানির দাম আকাশছোঁয়া, এমন যুক্তিও শুনতে হয়েছে। কোনও ভক্তের কাছ থেকে নয়, আপনাদের সমর্থকদের কাছ থেকে!
তৃণমূল বিরোধিতা না করার মতো কোনও শর্ত দেওয়ার কথা কখনও বলিনি, বিজেপি বিরোধিতার কথা অবশ্যই বলেছিলাম। বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালমন্দ করার সঙ্গে একই অনুপাতে বিজেপিকেও গালমন্দ করেন, তা হলে সেটা বোধ হয় বামপন্থী হিসেবে মানায়ও, আবার জরুরি ডিসকোর্সটাও করা হয়। উঁহু। উত্তরে জুটেছে খেঁকিয়ে ওঠা, ইতিহাস-ভূগোল, তত্ত্ব, হোয়াটঅ্যাবিউটারি— এ সব করতে গিয়ে বিজেপির ক্ষমতায় আসাটাকে তুলনামূলক ভাবে ভাল মনে করেছেন, এবং সেটা হয়তো বা দরকার, এ কথা বলতেও আরম্ভ করেছেন, অজানতেই হয়তো। যুদ্ধক্ষেত্রে শীর্ষ সৈনিকরা যাতে বিজেপিতে ভোট ‘শিফট’ না করে, নিজেদের কাছেই রাখে (তৃণমূল-কে জেতাতে নয়, নিজেদের অবস্থানটি শক্ত করতে) এটাও বলতে গিয়েছিলাম। আমি বা আমরা কেন? অন্য বামপন্থী সংগঠনগুলিও বলেছে! আবার গালমন্দ জুটেছে। বিশ্বাস করতে চাননি ভোট ‘শিফট’ করানোর কথা, বা করেও ‘তৃণমূল বিরোধী ভোট হচ্ছে’ বলে পরোক্ষ ভাবে ডিফেন্ড করেছেন বিষয়টা। পরিণাম কী হল, কমরেড? বাম পরিবারের ছেলে তো, আমার মনখারাপও কিন্তু আপনাদের সমান।
২০২১-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং তার ফলাফলের পরে, কিছু অনুরোধ আছে নতুন করে আসা সরকারের কাছে। ২০১৯-এ বিজেপির ঝুলিতে অতগুলি আসন আসার একটা বড় কারণ ছিল কিন্তু ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের সময়কার রাজনৈতিক হিংসা, ভোট দিতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি। অনেক তৃণমূল সমর্থকও কিন্তু শাসক দলের ওই সময়ের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সে সব যে এখন অতীত তা ’২১-এর ফলাফলই বলছে। কিন্তু ২ মে-র পরে দু’তিন দিন এ বারও বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনা ঘটেছে গ্রামবাংলায়। বলি হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাণ। বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা একতরফা নয়। নিহতরা বিজেপি-টিএমসি-সিপিএম— সব দিকেই আছে।
এবং যা হয়েছে তাকে হাজার দিয়ে গুণ করে পুরনো ভিডিয়ো এবং ছবি শেয়ার করে গেরুয়া বাহিনী ব্যাপারটিকে শুধু বাড়াবার চেষ্টা করেছে তা-ই নয়, তাতে সাম্প্রদায়িক রং লাগাবারও চেষ্টা করেছে। এ সব ফেক বা মিথ্যে খবর প্রমাণিত হওয়ার পরেও করে চলেছে। কিন্তু কথা হল, যে পার্টিরই হোক, প্রাণ তো প্রাণই। রাজনৈতিক হিংসা বাংলায় একেবারেই নতুন নয়। গত তিন দশক ধরে হয়ে আসছে নির্বাচনের আগে-পরে। কিন্তু এই সরকারের কাছে এ বার অনুরোধ, হানাহানির এই ঐতিহ্যে ইতি টানার জন্য দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা করুন।
গণতন্ত্রে বিরোধীশূন্য হয়ে যাওয়াটা খুব বিপজ্জনক শাসক দলের পক্ষে। রাজ্যে গত দশ বছরে যে ভাবে সিপিএম এবং কংগ্রেস-এর লোকেরা শাসক দলে নাম লিখিয়েছেন, তার কিছু অংশ নিশ্চয়ই স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান, আবার কিছু অংশ বাধ্যতামূলকও বটে। তার ফলে বিরোধী রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল বাংলায়। বিজেপির এত ক্ষমতাবৃদ্ধির একটা বড় কারণ কিন্তু সেটি। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের মাঝপথে সমমনস্ক রাজনৈতিক দলগুলিকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার সূত্র ধরেই বলি— যদি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হয়, প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার রাজনীতিকে তার বিভিন্ন চেহারায়, কলেবরে কাজ করতে দেওয়া দরকার, তারা আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী হলেও (একটু আগে যে দ্বিচারিতার কথা বললাম, সে রকম করলে বা তলে তলে বিজেপির বি টিম হয়ে কাজ করলে অবশ্য মুশকিল)।
মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল, এখনও আছে, মূলত নিচুতলার ভ্রষ্টাচার নিয়ে। সেগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে, মানুষ আপনাদের মানবদরদি প্রকল্পগুলি, গরিবের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থাগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে। সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রক্ষা করতে, আমাদের এই বিবিধের মাঝে মিলনের দেশে, নিজেদের নিজস্বতা রক্ষা করার স্বপক্ষে ভোট দিয়েছেন। এখন কাজ হল, ক্ষোভের উৎসে যে কারণগুলো আছে, যে মানুষগুলি আছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা করা। অস্বীকার করতে পারবে না কেউ, পরিকাঠামোগত কাজ অনেক হয়েছে গত ক’বছরে। সেগুলোর আরও উন্নতি এবং রক্ষণাবেক্ষণ আশা করব। অনেক শিল্প প্রকল্প মাঝপথে আটকে আছে, সেগুলি ত্বরান্বিত হোক এই অনুরোধ করব। চাইব
একটা প্রতিযোগিতামূলক কর্মসংস্কৃতিও গড়ে উঠুক, যাতে সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পের সঙ্গে মিলে, সার্বিক ভাবে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। আমাদের সম্ভাবনা আছে, কৃষি-শিল্প এবং ‘ওয়েলফেয়ার’-এর সমন্বয়ে একটি আদর্শ রাজ্য হয়ে ওঠার, সেই সম্ভাবনার প্রতি আরও সুবিচার হোক।
আমি এই লেখাটি লিখছি বসে রবি ঠাকুরের জন্মদিনে। হ্যাঁ, উনি আমাদের কাছে ঠাকুর, টেগোর নন। প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বরের মতোই, বা কিছু ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব ওঁর বাঙালি জীবনে। সবাই যে ওঁর দর্শন, ধর্ম বা দেশপ্রেমের সংজ্ঞা সম্বন্ধে গভীরে সব জানেন এমনটা নয়, প্রত্যাশা করাও ভুল। কিন্তু কোথাও একটা, শুধু রবি ঠাকুরই নন, এই ভূমির কবি, দার্শনিক সমাজ সংস্কারক গায়ক শিল্পী সবার চেতনার অজানতেই হয়তো জড়িত হয়ে আছে বাংলার বেশির ভাগ মানুষের ধমনীতে, শিকড়ে। আর তাই আমরা আজও অনন্য। আর শিকড় ধরে কেউ টান দিতে চাইলে, তার প্রতিরোধ তো হবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy