এটা মানতে বোধ হয় অসুবিধা নেই যে, শাসক যে ভাষায় প্রশাসন পরিচালনা করবেন, সেই ভাষাই দেশের শিক্ষা, বাণিজ্য, অর্থনীতির প্রধান বাহক হয়ে উঠবে, ক্রমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। এ ভাবেই মোগল শাসনতন্ত্রের প্রভাবে ফারসির চর্চা প্রথমে সরকারি এবং ক্রমে আভিজাত্যের অঙ্গ হয়ে ওঠে। পুরোপুরি ইংরেজ শাসন যখন আরম্ভ হল, তখন আদালত বা দলিল ফারসি ভাষায় হওয়ায় ইংরেজরা পড়েন মুশকিলে। অন্য সব প্রদেশের মতো বাংলার সমস্যাও তখন ত্রিমুখী— প্রশাসনের ভাষা ফারসি, দেশটা বাংলা, শাসক ইংরেজ। সমাধানের চেষ্টায় ১৮৩৭ ও ১৮৪৩-এর আইনের দ্বারা আদালত থেকে ফারসি ভাষা তুলে দেওয়া হল, এবং যাবতীয় কাজকর্ম বাংলায় করার নির্দেশ গেল জেলা আদালতে। ফারসি-জানা ক্ষমতাবান শিক্ষিত শ্রেণি ক্ষুব্ধ হলেন। ১৮৩৮-এর ৭ জুলাই সমাচার দর্পণ-এ চিঠি প্রকাশিত হল— বাংলা ভাষায় আইন-আদালতের কাজ সম্ভব নয়। দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনায় লিখছেন, “বহু যত্নের ও শ্রমের ঋণ অপহৃত হইলে অথবা উপার্জনক্ষম পুত্র হারাইলে যেরূপ দুঃখ হয়, সেইরূপ দুঃখ এই সংবাদে আমাদের মনে উপস্থিত হইল।”
আমরা জানি, এই উদ্যোগ সফল হয়নি এবং ইংরেজি ভাষাই সব কিছুর মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এ বার দেশ স্বাধীন হল, গণতান্ত্রিক হল। দাবিও উঠল, রাজ্যের ভাষাই হয়ে উঠুক প্রশাসনের ভাষা— জনগণের ক্ষমতায়নের ভাষা। কিন্তু ক্ষমতা তো রয়েছে ইংরেজি-জানা শ্রেণির হাতে। দেশ পত্রিকার প্রথম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যায় ১৯৩৩ সালে আক্ষেপ শোনা গেল, “মাতৃভাষায় কথা বলিতে শিক্ষিত বাঙ্গালী পারে না। সে যে শিক্ষিত, তাহা ইংরেজী মেশানো বাঙ্গলা বলিয়া প্রমাণ করে।... মিশ্র ভাষায় কথা বলাটা যেন সভ্যতার লক্ষণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।”
১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে তাঁর মুখ্যসচিব সুকুমার সেন বাংলা ভাষায় নোট দিতে আরম্ভ করেছিলেন। ১৯৫৭-তে বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে বলেন, ইংরেজি না জানার ফলে অনেক জনপ্রতিনিধিই বিধানসভায় যথার্থ অর্থে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন না। তাঁরা বুঝতেই পারছেন না, কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
২৬ মার্চ, ১৯৫৮-তে রাজ্যের সরকারি ভাষা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার ৪ নং ধারায় বলা হয়, ১৯৬০-এর ডিসেম্বরের মধ্যে একে কার্যকর করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ পরিষ্কার। ১৯৬১-তে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী। অতএব, কাজটা সেরে ফেলতে হবে। তা হয়নি। ১৯৬১-র ২৫ সেপ্টেম্বর, যে দিন পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষা বিল নিয়ে বিধানসভায় বিতর্ক চলছে, সে দিন কংগ্রেসের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এর বিরোধিতা করেন, পরে নিমরাজি হন। তবে, বিষয়টি এত সরল নয়। কেননা, এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে সব সরকারেরই উত্তর একই। ১৯৫৮-তে জ্যোতি বসুর প্রশ্নের উত্তরে বিধান রায় বলেছিলেন, বাংলা স্টেনোগ্রাফার, টাইপিস্ট এবং টাইপরাইটারের অভাবে বাংলা ভাষাকে প্রশাসনের কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ২১ বছর পর, ১৯৭৯’র ২৮ ফেব্রুয়ারি সিপিএম-এর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, “টাইপিস্ট, স্টেনোগ্রাফারের সমস্যা আছে।” তা বলে কি ঘোষণা থেমে থাকবে? ২৫ বৈশাখ, ১৩৮৬ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু জানান, “এ দিন থেকে রাজ্য সরকারের সমস্ত কাজকর্মে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে।” ২২ বছর পর, ১৪০৮-এর ১ বৈশাখে ফের বলা হয়: “এ দিন থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক কাজকর্ম বাংলা ভাষায় চালু করা হচ্ছে।” কিছু দিন আগে তৃণমূল সরকারও একই ঘোষণা করেছে!
২০১১-র সমীক্ষায় প্রকাশিত তথ্যে দেখব যে, অষ্টম তফসিলের ২২টি জাতীয় ভাষার ১৬টি এবং তালিকা বহির্ভূত ১৪টি ভাষা পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। হিন্দিকে মাতৃভাষা ধরলে, এবং অন্য যে ৫৫টি ভাষা নিয়ে সংবিধানের ‘হিন্দি’ গঠিত হয়েছে তাদের আলাদা করে গণ্য করলে দেখব যে, আরও ৬টি ভাষাভাষী মানুষ (ভোজপুরি ১,৭৭,৪৪৩, সাদরি ৭,৪১,৫২৮, সুরজাপুরি ৩,৯৫,৬৮৬, খোট্টা ১,৫৪,৭৬৬, কুড়মালিথর ২,১৮,২২৬ মারোয়াড়ি ৫০,৪৬৫) পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন। পশ্চিমবঙ্গের ৩৬টি ভাষার মধ্যে সরকারও ১১টি-কে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এক দিকে আমরা ‘ইংরেজ’ ও ‘ইংরেজি’ গুলিয়ে ফেললাম, অন্য দিকে বাংলার উন্নতিতেও কিছু করলাম না। ভুলে গেলাম সাহিত্যের উন্নতি, মেধা-মননের প্রকাশ। আর, উদাসীনতার সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকারও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। রাজ্যে সরকারি ভাষা আইন পাশ হয় ১৯৬১-তে। এখন আমাদের ভাষা আইনের ৬০ বছর উদ্যাপন করা উচিত, অথচ উল্টে আমরা লজ্জিত, সঙ্কুচিত! আজও বাংলা দৈনিকের অনেক সরকারি বিজ্ঞাপন কেবল ইংরেজিতে। সরকারি, বেসরকারি অনেক কাজও।
ঘটনা হল, এই বিশ্বায়নের যুগে, যদি সব ভাষার গসাগু নির্ণয় করি, তার উত্তর কিন্তু ইংরেজিই হবে। তাই এক দিকে মাতৃভাষা ও অন্য দিকে ইংরেজি ভাষার সদর্থক চর্চা ভাষা রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টাকে রুখে দিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy