অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবর্ষে আলোচিত হচ্ছে তাঁর তুলিকলাশিল্পে ইংরেজ শিল্প-ঐতিহাসিক, সমালোচক আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেলের অবদান। উনিশ শতকের শেষে ইউরোপীয় শিল্প ঐতিহ্যের অসম্পূর্ণ অনুকরণেই সীমাবদ্ধ ছিল আর্ট কলেজের শিক্ষা। সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে হ্যাভেল সেই পদ্ধতি বদলালেন। প্রাচ্যশিল্পই হয়ে উঠল তার মূল ভিত্তি। নিজেকে হ্যাভেল সাহেবের ‘চ্যালা’ বলতেন শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হ্যাভেলের পাশে বসে বুঝে নিতেন ভারতীয় শিল্পের ইতিহাস, ছবি, মূর্তির সৌন্দর্যের খুঁটিনাটি।
এ বিষয়ে হ্যাভেলকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তাঁর বন্ধুস্থানীয় সিস্টার নিবেদিতা। ১৯০৮-এ হ্যাভেলের বই ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার অ্যান্ড পেন্টিং প্রকাশিত হলে তিনি অত্যন্ত খুশি হন। নিবেদিতার প্রেরণাতেই অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্যদের শিল্পচর্চাও পাশ্চাত্য থেকে ক্রমে প্রাচ্য অভিমুখী হয়। নন্দলাল বসুর ভাষায় তিনি তাঁদের ‘দিশারী দেবদূতী’।
প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় রাজা রবি বর্মার ছবি ছাপতেন। নিবেদিতার সঙ্গে ক্রমাগত তর্কযুদ্ধ তাঁকে এ জাতীয় পাশ্চাত্য অনুপ্রাণিত ছবির সীমাবদ্ধতা বুঝতে সাহায্য করে। নিবেদিতা গান্ধার শিল্পরীতি বিষয়েও তাঁর পুরনো দৃষ্টি বদলে দিয়েছিলেন। যে লাবণ্যময় কমনীয়তাটুকু গান্ধার শিল্পে প্রাণসঞ্চার করেছে তা যে ভারতীয় রীতির দান সে সম্পর্কে নিবেদিতাই তাঁকে সচেতন করেন।
প্রবাসী, মডার্ন রিভিউ, ইন্ডিয়ান রিভিউ প্রভৃতি পত্রিকায় বেরিয়েছে নিবেদিতার একাধিক চিত্রসমালোচনা। তাঁর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, অনুভব, সূক্ষ্ম শিল্পবোধ নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের প্রাণিত করেছিল ভারতীয় শিল্পকলার পুনরাবিষ্কার ও পুনরুজ্জীবনে। তাঁদের ঐকান্তিকতায় পল্লবিত হয় বেঙ্গল স্কুল অব আর্টের ঘরানাটি। ১৯০৭-এ গড়ে ওঠে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’।
চিত্রকলার নতুন জোয়ারকে উস্কে দিয়েছিল সমকালীন রাজনীতি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের উত্তপ্ত আবহে অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন বঙ্গমাতার প্রতিমূর্তি। এ ছবিই ‘ভারতমাতা’ নামে বিখ্যাত হয়। নিবেদিতা জানালেন, পারলে এ ছবি তিনি ছড়িয়ে দিতেন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা— ব্রিটিশ ভারতের প্রতিটি প্রান্তে। অবনীন্দ্রনাথ নিবেদিতার ক্রেডল টেলস অব হিন্দুইজ়ম বইয়ের প্রচ্ছদ আর ভূমিকা অংশের ছবি এঁকেছিলেন। ফুটফলস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রির জন্য আঁকেন ‘বুদ্ধের জন্ম’। মিথস অব হিন্দুস অ্যান্ড বুদ্ধিস্টস-এর জন্য আঁকা হয় ‘রাজকুমার সিদ্ধার্থের বিদায়’, ‘বুদ্ধের বোধিলাভ’, ‘মহাভিক্ষুক বুদ্ধ’, ‘মহাপরিনির্বাণ’ ইত্যাদি। তাঁর তত্ত্বাবধানে নন্দলাল প্রমুখরা নিবেদিতার লেখা বইগুলির অলঙ্করণের কাজ করেছিলেন।
শিল্পকে নিবেদিতা জাতীয়তাবাদ উজ্জীবনের মাধ্যম হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। বিশ্বাস করতেন ভারতের পূর্বগৌরব ফেরাতে তার বিস্মৃত শিল্পীসত্তাকে ফিরে পাওয়া জরুরি। বুঝেছিলেন, মুষ্টিমেয় সংস্কৃতিমান মানুষের মধ্যে শিল্পচর্চা আবদ্ধ থাকলে চলবে না। জনতার সীমিত সাধ্যের আওতায় শিল্পকে এনে ফেলার মতো বাস্তববোধ ছিল তাঁর। তাই ভারতীয় রীতিতে আঁকা সেরা রেখাচিত্রের জন্য এক হাজার পাউন্ডের সুদ থেকে বাৎসরিক পুরস্কার বরাদ্দ করার সময় বলেছিলেন, “সস্তায় কপি করা যাবে, রেখাচিত্রটি যেন এমন হয়।” তাঁর অর্থের একাংশ শিল্পনিদর্শন সংরক্ষণ ও বৌদ্ধ ভাস্কর্যের প্রতিরূপ তৈরির জন্য খরচের নির্দেশ ছিল। নন্দলালেরা স্বদেশির উত্তেজনায় আঁকা ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে ঝাঁপ দিতে চাইলে নিবেদিতা তাঁদের নিবৃত্ত করেন। তাঁর মনে হয়েছিল, মিটিং-মিছিল-পিকেটিংয়ের ভিড়ে নয়, তুলিকলমের আঁচড়েই তাঁদের দেশসেবার ব্রত পূর্ণ চেহারা নেবে।
নিবেদিতা বুঝেছিলেন, শিল্পীজীবনের শুরুতেই প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলা ও শিল্পের সঙ্গে পরিচয় না ঘটলে তরুণ শিল্পীদের হাত, চোখ ও মন তৈরি হবে না। এ সময় ক্রিশ্চিয়ানা হেরিংহ্যাম অজন্তায় এসেছিলেন গুহাচিত্রের প্রতিলিপি করার কাজে। তাঁকে সাহায্য করলে নন্দলালদের শিল্পপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটবে ভেবে নিবেদিতা তাঁদের অজন্তায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। অবনীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ধারেতে লিখেছেন— “সমস্ত খরচপত্তর দিয়ে নন্দলালদের ক’জনকে পাঠিয়ে দিলুম অজন্তায়। পাঠিয়ে দিয়ে তখন আমার ভাবনা... ‘সেখানে ওদের খাওয়া-দাওয়াই বা কী হচ্ছে, রান্নার লোক নেই সঙ্গে, ছেলেমানুষ সব।’ নিবেদিতা বললেন, ‘আচ্ছা, আমি সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।’”
কোনও বিশেষ দেশের শিল্পসৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া বিরল নয়। কিন্তু ক’জন এমন উদ্যমে শিল্পনিদর্শনের সংরক্ষণ ও শিল্পচর্চার উন্নতির জন্য যত্নবান হন? মাতৃস্নেহে লালন করেন সে দেশের তরুণ শিল্পীদের? বাংলার লোকশিল্প, মোগল মিনিয়েচার পদ্ধতির অনুসরণে শৈল্পিক নিরীক্ষায় ব্রতী অবনীন্দ্রনাথেরা পেয়েছেন তাঁর সোৎসাহ সাহচর্য। তাঁকে প্রথম দেখে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল সাদা পাথরে গড়া তপস্বিনীর মূর্তি। মনে হয়েছিল ‘কাদম্বরী’র মহাশ্বেতা। মনে ধরে রাখা সেই আদলকেই অবনীন্দ্রনাথ রূপ দেন তাঁর ‘সতী’ ও ‘তপস্বিনী উমা’র চিত্রে। দেশি শিল্পীর তুলিতে এক বিদেশিনী হয়ে ওঠেন ভারতীয় নারীত্বের ঘনীভূত নির্যাস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy