যেখানে পড়াশোনা করেছেন, সেই জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতেই জায়গা হল দানিশ সিদ্দিকির— মৃত্যুর পরে। যেখানে মানুষের হাহাকার, সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে হাজির হতেন দানিশ, শাসককে ভয় না পেয়েই। অতিমারির সময়ে দিল্লিতে গণচিতার যে বাস্তবতা অস্বীকার করতে ব্যস্ত ছিল সরকার, দানিশের ক্যামেরায় সেই চিতা থেকে ছিটকে আসা ছাইয়ের ছবি। উত্তরপ্রদেশের সারি সারি শবদেহের দায় রাজ্য সরকারের নয়, নিদান দিয়েছে ইলাহাবাদ হাই কোর্ট। অথচ, গঙ্গাপারে গণমৃতদেহের সৎকারের ছবির সাক্ষ্যপ্রমাণ দানিশের হাত ধরে আমাদের সবার কাছে। সরকারি সাহায্য না পেয়ে যে অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকেরা হাজার হাজার কিলোমিটার হাঁটলেন, দানিশের ছবিতে তাঁদের মুখ। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের জমায়েতের উপর ‘ইয়ে লো আজাদি’ বলে গুলি চালিয়েছিল হরিয়ানানিবাসী রামভক্ত গোপাল— দানিশের ক্যামেরায় তার মুখ স্পষ্ট ধরা পড়ল। হিন্দুত্ববাদের হিংস্র রূপ দানিশের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল দিল্লির সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে আক্রান্ত জুবায়েরের ছবিতেও। সংখ্যাগুরুর নির্মম আস্ফালনের সামনে মাটিতে লুটিয়ে মাথা আঁকড়ে প্রাণ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন জুবায়ের।
১৯৯৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় দুর্ভিক্ষপীড়িত সুদানের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল, ‘শকুন ও ছোট্ট মেয়েটি’। রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণশিবিরে কোনও মতে পৌঁছতে চাইছে একটি শিশু, পিছনে একটি শকুন তাকেই তাক করে বসে আছে শিকারের জন্য। ছবি প্রকাশের পরে অনেকেই বলেন, চিত্রগ্রাহক ছবি তোলার পরিবর্তে শিশুটিকে বাঁচাতে পারতেন। চিত্রগ্রাহক কেভিন কার্টার এই ছবির জন্য পুলিৎজ়ার পুরস্কার পাওয়ার চার মাসের মাথায় আত্মহত্যা করেন। ছবি তুলে ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ বহন করা বনাম ছবির বিষয়বস্তুকেই সঙ্কট থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা— সংঘর্ষপ্রবণ এলাকার বা যুদ্ধের ছবি তোলা চিত্রসাংবাদিকদের কাছে এ দ্বন্দ্ব সর্বক্ষণের। এখনকার ভারতে এক সংখ্যালঘু পরিচিতির মানুষ হয়ে এই দ্বন্দ্বের বাস্তবতা দানিশের কাছে ছিল অন্য মাত্রার। ছবি তুলতে গিয়ে নিজের মুসলমান পরিচয়ের জন্য আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বার বার তাড়া করেছে তাঁকে। সে জন্যেই হয়তো সন্ত্রস্ত মানুষের ছবি তুলতে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে গিয়েছেন। মায়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুর্দশার চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য পুলিৎজ়ার পান দানিশ, কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। নিজের সঙ্গে জুড়তে চেয়েছেন ইরাক থেকে আফগানিস্তান, ভোপাল থেকে কাশ্মীরের মানুষের জীবন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ছবি তুলতে দ্বিধা করেননি।
দানিশ বলতেন, তিনি সমাজের নিখাদ, নির্ভেজাল সত্যকে তুলে ধরতে চান। চার পাশের নির্মম বাস্তবতার সাক্ষী করতে চান আমাদের। আমরা চোখ ফিরিয়ে নিতে পারি, কিন্তু দানিশ চেষ্টা করে যাবেন। সঙ্কটের মুহূর্তে মানুষের অসহায়তাই শুধু ধরতে চাননি তিনি, আক্রান্ত মানুষের প্রত্যয়ী দৃঢ়তাকেও সসম্মানে ছবিতে স্থান দিয়েছেন। যে বাস্তবতা, যে খবর মানুষের অগোচরে থেকে যায়, আমাদের চোখের সামনে সেই রুক্ষ আয়না রাখতে চেয়েছিলেন দানিশ। একই সঙ্গে ছবির মানুষের প্রতি অপার মমত্ব ছিল তাঁর, ছিল নৈতিক দায়িত্ববোধ। শুধু অসহায়তার, আক্রমণের অনামা প্রতীক হিসেবে তাঁদের দেখতে অস্বীকার করেছিলেন দানিশ। তাই পরিযায়ী শ্রমিক দয়ারাম খুশওয়াকে তাঁর বুন্দেলখণ্ডের বাড়িতে দেখতে যান। হাসপাতালে ভর্তি জুবায়েরের খোঁজ নেন, সুস্থ হয়ে ওঠার পর ফের তাঁর ছবি তোলেন তিনি।
তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে ছবির বাইরের বাস্তবতাকে আমাদের ছুঁতে শিখিয়েছিলেন দানিশ। যে কোনও আলোকচিত্রই সেই মুহূর্তের বাস্তব ঘটনার সাক্ষী। অথচ, যে নির্দিষ্ট চিত্র আমরা ছবিতে দেখি, তার বাইরের সময়, সমাজ, রাজনীতির ছাপও যে তা বহন করে, দানিশের ছবিতে তা স্পষ্ট। ছবি তোলাকে নিছক তথ্যপ্রমাণে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি, শুধু নান্দনিক চর্চার মাধ্যমও করে তোলেননি। চিত্রসাংবাদিকতাকে এক বৃহত্তর নৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। যে যন্ত্রণা মায়ানমারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর, কাশ্মীরের অসংখ্য মুছে যাওয়া মানুষের, আমাদের সেই যন্ত্রণার শরিক করেছিলেন তিনি। জুবায়েরের উপর হওয়া ভয়াবহ আক্রমণ যে ভারতের বর্তমান চিত্র, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল দানিশের ছবি। তাই হয়তো তালিবান আর আফগান সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষের সময় মানুষের কথা ভেবেই ঝাঁপিয়েছিলেন তিনি।
আমরা অনেকেই সমাজসচেতন। লিখি, পড়ি, শিল্পচর্চা করি। অথচ, চার পাশের মানুষ আমাদের চর্চার বিষয়, বড় জোর গবেষণার তথ্য হয়েই থেকে যান, তাঁদের রোজকার জীবনের কথা জানা হয় না। অজস্র মানুষ অভুক্ত, কর্মহীন; প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ কোণঠাসা, অভাবে-আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ন্যূনতম সুবিধা না পেয়ে মৃত হাজার হাজার। সরকার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার চেষ্টায়। দানিশ আমাদের এক রূঢ় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন। আমরা আর কত দিন চোখ ফিরিয়ে থাকব?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy