উৎপল দত্ত রচিত এবং নির্দেশিত অগ্নিশয্যা নাটকটি পিপলস লিটল থিয়েটার প্রথম মঞ্চস্থ করে ২৭ নভেম্বর, ১৯৮৮-তে। নাটকের বিষয়বস্তু, ঊনবিংশ শতকের বাংলায় সতীদাহ সংক্রান্ত তর্কবিতর্ক। বর্ধমানের ডিহিকেশপুর জমিদারির বৃদ্ধ জমিদার জগৎনারায়ণ তিনটি তরুণী বিধবা রেখে পরলোকগমন করার পর জমিদারির উত্তরাধিকারী, ডিহিকেশপুরের ঐতিহ্য বজায় রেখে, তাদের সতী করার উদ্যোগ করলে জ্যেষ্ঠা বিধবা স্নেহময়ী বলে বসেন যে, স্বেচ্ছায় তাঁরা সতী হতে চান না। রাজা রামমোহন রায়ের কাছে আশ্রয় নেন তাঁরা। নাটকের গোড়ার দিকেই সংলাপের মাধ্যমে দর্শক রামমোহনের ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক নিবর্তক সম্বাদ’-এর প্রথম প্রস্তাবের বিতর্কগুলির সম্বন্ধে সম্যক অবহিত হয়ে যান। সংরক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেব এবং রাজা রামমোহন রায় নাটকের চরিত্র হিসাবে দর্শকের সামনে উপস্থিত হন। তাঁরা কেবলমাত্র সতীদাহ সম্পর্কিত তর্ক করেন না, এই সময়ের ঔপনিবেশিক বাংলায় কোম্পানির শাসনের পদ্ধতি আর বাংলার ইংরেজ-শাসনের পূর্ববর্তী সমন্বয়বাদী যে সমাজচেতনা, তার সম্পর্কেও বাদানুবাদ করেন। রাজা রামমোহন রায়কে তাঁর নিজস্ব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত গুণ এবং অসহায়তা নিয়ে, বিংশ শতকের শেষ ভাগের বাঙালি দর্শক আর এক বার আবিষ্কার করার সুযোগ পায়।
এই নাটকের মাধ্যমে উৎপল দত্ত মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে, কেবল সতীদাহ প্রথা নিবারণ করার জন্যই নয়, সর্বতো ভাবে আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য রামমোহন রায়কে কতটা আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল। মঞ্চের রামমোহন বলেন যে, মায়ের অশ্রু দেখে বা স্ত্রীর অনুরোধে কাতর হয়ে তিনি নিজের পৌত্তলিকতা বিসর্জন দেওয়ার মন্ত্রকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না। হজরত মহম্মদের জীবনী লিখে নিজের হিন্দু পরিচয়কে সামাজিক ভাবে বিপন্ন করে তুলতে ভয় পান না। সংবাদপত্রের উপর লাইসেন্স জারি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজের ফারসি পত্রিকা মিরাত-উল মুলক বন্ধ করে দেন। নানা ভাষা শিক্ষা করে, জ্ঞান আহরণ করে, সত্যসন্ধানকেই জীবনের ব্রত করেছেন তিনি— সেই ব্রতসাধনে হাজার বাধা এলেও মাথা নোয়াননি ।
অগ্নিশয্যা নাটকের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে রামমোহনের সত্যনিষ্ঠ অথচ কোমল মন। তৎকালীন হিন্দুসমাজ স্নেহময়ীকে হুমকি দিয়ে, অত্যাচার করে সতী হতে বাধ্য করে। নাটকের মূল বেদনার সুরটি ধ্বনিত হয় রামমোহনের আত্মদর্শনে, যখন তিনি রাধাকান্ত দেবের কাছে নিজের সমস্ত তর্কের পরাজয় মেনে নিয়ে কেবলমাত্র একটি তরুণীর প্রাণভিক্ষা চান। রাজা রাধাকান্ত দেব ‘হিন্দু সভ্যতা’-র প্রতীক হয়ে ওঠেন, যিনি কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে সতীদাহের বিতর্ককে এক মর্যাদার লড়াইয়ে নিয়ে গিয়ে রামমোহনের মানবিকতার মতাদর্শের চরম বিরোধিতা করেন। বেদনা আরও ঘনীভূত হয় যখন স্নেহময়ী রামমোহনকে সতী হওয়ার আগে বলে যায় যে, তিনি যেন এই সমাজটাকেই উল্টে দেওয়ার আন্দোলন করেন, না হলে কেবলমাত্র সতীদাহ প্রথা রদ করার মতো আইন করে নারীনির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। নাটকের শেষে লর্ড বেন্টিঙ্কের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় নিরন্তর সংগ্রামের ফলে ক্লান্ত রামমোহন নিজের অন্তিম উপলব্ধির কথা জানান। বলেন, “সতীদাহ শুধু চিতা সাজিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হয় না, সতীদাহ হয়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে স্বামীর পদাঘাতে, শ্বশুরবাড়ির প্রহারে, সতিনের গঞ্জনায়, কুলীনের বিবাহ ব্যবসায়। নারী নিজে জেগে না উঠলে, নিজে রুখে না দাঁড়ালে এ ব্যবস্থার শেষ হবে না। নারী নিজেই নিজেকে মুক্ত করবে।”
স্বভাবতই মনে হয় যে, নাটকের রামমোহন এই কথাগুলি বলছেন তাঁর বিংশ শতকের দর্শকের উদ্দেশে, তাদের সমসাময়িক নারীমুক্তি আন্দোলনের আদর্শকে সামনে রেখে। রূপ কানোয়ারের ‘সতী’ হওয়ার ঘটনা তখন মাত্র এক বছরের পুরনো। রাজস্থানের দেওরালায় ১৯৮৭-র সেপ্টেম্বর মাসে ঘটে যাওয়া সতীদাহ তখন উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের আধুনিকতার গোড়া ধরে টান দিয়েছে। নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মীরা হতবাক, মর্মাহত। এমন সময়ে রাজা রামমোহন ছাড়া আর কাকেই বা বাঙালি স্মরণ করতে পারে?
উৎপল দত্তের নাটকের একশো বছর আগে রামমোহনকে স্মরণ করেন আর এক বাঙালি: রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮৫ সালে সিটি কলেজে রামমোহনের স্মরণসভায় (৫ মাঘ) রবীন্দ্রনাথ বলেন, তৎকালীন বাংলা তথা ভারতবর্ষের আধুনিকতায় উত্তরণের কালে তিনি-ই ছিলেন মহা ঋত্বিক। “প্রতিদিনকার ছোটো ছোটো মস্তলোকদিগকে, বঙ্গসমাজের বড়ো বড়ো যশোবুদ্বুদদিগকে, বালুকার সিংহাসনের উপর বসাইয়া দুই দিনের মতো পুষ্পচন্দন দিয়া মহত্ত্বপূজার স্পৃহা খেলাচ্ছলে চরিতার্থ করিতেছি।” অথচ রামমোহনের মতো “একাকী অপ্রমত্ত ভাবে থাকিয়া ধীরভাবে” বিপুল কর্মের মধ্যে আত্মনিবেদিত মহাপুরুষকে ভুলেই গিয়েছি। সেই ‘বিপুল কর্ম’ কত ব্যাপক, তা-ও মনে করিয়ে দেন— “তিনি কী না করিয়াছিলেন! শিক্ষা বল, রাজনীতি বল, বঙ্গভাষা বল, বঙ্গসাহিত্য বল, সমাজ বল, ধর্ম বল, কেবলমাত্র হতভাগ্য স্বদেশের মুখ চাহিয়া তিনি কোন্ কাজে না রীতিমত হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। কোন্ কাজটাই বা তিনি ফাঁকি দিয়াছিলেন!”
রামমোহনের চিন্তার বিস্তৃতির আভাস পাওয়া যায় ১৯৭৭ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে প্রকাশিত সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থে, যার সম্পাদক কালিদাস নাগ এবং দেবজ্যোতি বর্মণ। ভারত সরকার ক্লাসিকস অব ইন্ডিয়ান পলিটিক্স সিরিজ়-এর প্রথম বই এটি। সূচিপত্র দেখলেই বোঝা যায় রামমোহনের চিন্তার বিস্তৃতি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নারীর সম্পত্তির অধিকার এবং সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা নিয়ে রামমোহনের বক্তব্য তবু কিছুটা পরিচিত। কিন্তু এই বইয়ে দেখি, ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটির কতকগুলি প্রশ্নের উত্তরে রামমোহন ভারতের ভৌগোলিক বিস্তার ও তার ইতিহাস, কর-ব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের জীবন এবং চাষিদের উপর চাপানো অন্যায় কর নিয়ে তাঁর লেখা। খ্রিস্টধর্মের মূল প্রতিপাদ্য এবং বেদান্তের ব্যাখ্যা থেকে কী ভাবে ‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’-এর ধারণা পাওয়া সম্ভব, তা নিয়েও লিখেছেন রামমোহন, যিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতাও বটে।
এই নির্ভীক কর্মী মানুষটি, যিনি সমস্ত উৎপীড়ন অগ্রাহ্য করে অটল ভাবে নিজের বিশ্বাস আর জ্ঞানকে পুঁজি করে সমাজ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার চারা পুঁতে দিয়েছিলেন, তাঁকে স্মরণ করতে হয় জাতির সঙ্কটের মুহূর্তে। অগ্নিশয্যা নাটক দেখার সময় এই প্রতিবেদকের বয়স ছিল এগারো। তার পর তিন দশক ইতিহাসচর্চার সূত্রে রামমোহনের অলোকসামান্য মূর্তির নীচের ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকার সম্পর্কে অল্প পরিচয় হয়েছে। ধারণা জন্মেছে, আজকের উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাধারায় রামমোহনের সমস্ত কাজকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া অনভিপ্রেত, অনৈতিহাসিকও বটে। যুগের প্রয়োজনে, বুদ্ধিমান রামমোহন ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে সময় বিশেষে হাত মিলিয়েছেন। উৎপল তাঁর নাটকে দেখিয়েছিলেন, আপাত-পরাজিত ভগ্নহৃদয় রাজা বিদেশে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে চলে গেলেন তাঁর সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে। রামমোহনকে ‘অতিমানব’ না ভেবে, মানুষের মতো মানুষ বলে মনে রাখলে তাঁর আরব্ধ কাজে হয়তো আমরা আর একটু মন দিতে পারব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy