একসূত্রে: চিত্রাঙ্গদা-র কলাকুশলীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, দিল্লি, ১৯৩৬।
মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের বাড়িতে চিত্রাঙ্গদা পড়া হচ্ছে। কোথায় আলাদা করে গান ছাড়াই নাচের অংশ থাকবে, গানে কোন লাইন এক বার, কোনটা দু’বার— সবই ঠিক করছেন অর্ঘ্য সেন আর মঞ্জুশ্রী মিলে। শেষ অঙ্ক, রঞ্জাবতী ‘সুরূপা’র জায়গায় ‘কুরূপা’ মঞ্জুশ্রীর প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যে মঞ্জুশ্রী হঠাৎ বললেন, “এখানে এক জায়গায় একটা সংলাপ আমি বাদ দিচ্ছি অর্ঘ্যদা। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিনী যে চিত্রাঙ্গদা এত লড়াই শেষে অর্জুনের সামনে তার যোগ্যতা প্রমাণ করল, যার গলায় গান, ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’, কেন সে শেষে বলবে ‘এবার প্রসন্ন নয়নে চাও সেবিকার পানে’? এ তো পরাজয়! রবীন্দ্রনাথ এখানে অন্তত মেয়েদের প্রতি সুবিচার করেননি।”
এই মনন, বোধ দিয়ে এক সময় নির্মিত হয়েছে এক-একটি রবীন্দ্র-গীতিনাট্য আর নৃত্যনাট্য। ‘তোমারই মাটির কন্যা’-র (চণ্ডালিকা) নিবেদনেও মঞ্জুশ্রী এনেছিলেন ভাবনার দ্যুতি— নির্বিচার অনুসরণ করেননি। বাণী ঠাকুরের বাড়িতে শ্যামা-র রিহার্সালে নৃত্যচর্চার দৃশ্যটি অতিরিক্ত দীর্ঘ মনে হচ্ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। বললেন, এটা শ্যামা, না কোনও ক্লাসিক্যাল নাচের ডেমনস্ট্রেশন? নির্দেশক সঙ্গে সঙ্গে কমালেন নাচের দৈর্ঘ্য। অলোকনাথ দে, নির্মল বিশ্বাসের মতো ঝানু বাজিয়েরা ছিলেন সেই লাইভ অনুষ্ঠানে। আর ছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর সামনে বসে সংযুক্তা পাণিগ্রাহীকে নাটকের ঘাত-প্রতিঘাতের পাঠ নিতে দেখেছি। ওই বাণী ঠাকুরের বাড়িতেই দিনের পর দিন রিহার্সাল হয়েছে তরুণ মজুমদারের দাদার কীর্তি-র সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য। ‘গুরুগুরু গুরুগুরু’ থেকে শুরু করে ‘বঁধু, কোন্ আলো লাগল চোখে’-র সরল নৃত্যরূপ এ ছবির প্রাণভোমরা, যা সরাসরি উঠে এসেছিল মঞ্চের নৃত্যভাবনা থেকেই। মহুয়া রায়চৌধুরী, অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর পাশে গানে ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়, নাচে সোনালী চক্রবর্তীরা সনিষ্ঠ রূপ দিয়েছিলেন পরিচালক ও একই সঙ্গে গুরু অসিত চট্টোপাধ্যায়ের নৃত্যভাবনাকে।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যের পাঠ দিয়ে আশির দশকের মাঝামাঝি মাসান্তে আড়াইশো টাকা বেতন পেতেন নৃত্যগুরু অসিত চট্টোপাধ্যায়। সেই ‘সাম্মানিক’ শিল্পীর চেতনায় বাধা হয়নি। সে সময় রবীন্দ্রভারতীর চণ্ডালিকা, বাল্মীকিপ্রতিভা, তাসের দেশ-এর মতো স্মরণীয় প্রযোজনাগুলিই প্রমাণ। উদয়শঙ্কর হল-এ সার দিয়ে বসে আছেন নৃত্যগুরুরা— বেলা অর্ণব, মুরলীধর মাঝি, নদীয়া সিংহ, গোবিন্দন কুট্টি, এন কে শিবশঙ্করন, খগেন বর্মণ, সুনীল কোঠারি। সকলের উপদেশ মাথায় নিয়ে গাইয়ে অরবিন্দ বিশ্বাস, তবলায় বিপ্লব মণ্ডল আর সুরকর্তা তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাচ্ছেন অসিতবাবু। বেলা বারোটায় শুরু হওয়া মহড়া বিকেল পাঁচটা ছুঁত।
মনে পড়ছে সাগর সেনের কথা। সে বার কোটালরূপী দেবব্রত বিশ্বাসের পাশে তিনি উত্তীয়। জর্জবাবু জাঁতি-সুপারি নিয়ে বসে গেছেন মাইক্রোফোনের সামনে। দু’জনের সওয়াল-জবাবের গান আসছে, অথচ দেবব্রতর মনোযোগ সুপারিতে। নার্ভাস সাগরবাবু দেবব্রতর হাঁটুতে মৃদু এক চাঁটি দিয়ে শুরু করেন, ‘প্রহরী, ওগো প্রহরী’। দেবব্রত নিখুঁত ধরলেন, ‘তুমিই করেছ তবে চুরি’, পুনশ্চ ‘নাম লহো দেবতার’। উত্তীয় বধের আগেই সাগর সেন ব্যাকস্টেজ থেকে উধাও, জর্জ বিশ্বাসের হাঁটুতে চাঁটি মেরে গান ধরিয়ে দেওয়ার পর আর থাকা যায়! পরে দেখা গেল, এ ‘ঘটনা’র সূত্র ধরেই দেবব্রত বিশ্বাসের মর্নিং-ওয়াকের সঙ্গী হয়ে উঠলেন সাগর সেন।
গ্রামোফোন কোম্পানির রবীন্দ্র-গীতিনাট্যের রেকর্ডগুলিতে সন্তোষ সেনগুপ্ত প্রমাণ করে দিয়েছেন, পরিচালকের ভূমিকা ঠিক কী। সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়দের কণ্ঠ কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়, দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। মঞ্চেও যখন ওঁর পরিচালনায় সুরমন্দির নৃত্যনাট্য নিবেদন করছে, তখন শান্তি বসু, অলকানন্দা রায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অর্ঘ্য সেন, পূর্বা দাম, গৌতম মিত্র, সুমিত্রা সেনরা অপলক দৃশ্যকাব্য আর অক্ষয় শ্রবণ রচনা করেছেন বার বার। সে সব মহড়ায় মজাও ছিল। কাকতালীয় ভাবে তখন গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডে আর মঞ্চের নৃত্যনাট্যেও ‘সেন’দের ভিড়: সাগর সেন, অর্ঘ্য সেন, সুমিত্রা সেন, বিভা সেনগুপ্ত, এমন আরও অনেকে। মৃণাল চক্রবর্তী এক দিন রিহার্সালের সময় পেরিয়ে ফ্লোরে এলেন, সন্তোষবাবু রেগে কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, “এখানে সেন না হলে সুযোগ পাওয়া যাবে না, তাই এফিডেভিট করে পদবি পাল্টে আসতে একটু দেরি হল, সন্তোষদা।”
বিশপ লেফ্রয় রোডের বড় মহড়া-ঘরে রমা মণ্ডল, প্রমিতা মল্লিক, শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়দের নিয়ে শান্তি বসুর প্রতি দিনের রিহার্সালে চেনা ছবি ছিল আবহসঙ্গীত-নির্দেশক বিষ্ণু সাধুখাঁর সঙ্গে শান্তিবাবুর মতবিরোধ। বিষ্ণুবাবু খবরের কাগজে বাঁশি বেঁধে বেরিয়ে যাবেন, সেতারবাদক রঞ্জন মজুমদার তাঁকে বলেকয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। উদয়শঙ্করের ধারা বেয়ে সুশৃঙ্খল মূলানুগ রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য নিবেদনে আজও প্রথম নামটি শান্তি বসু। বিদায় অভিশাপ অবলম্বনে কচ ও দেবযানী-তে সাধন ও পলি গুহ ছিলেন অফিস ক্লাবের অনুষ্ঠানে নিশ্চিত সংযোজন। এই জুটি মঞ্চে যে সাধুবাদ কুড়িয়েছেন তার জুড়ি মেলা ভার। আর নৃত্যের সঙ্গে গানের তালিমে সুচিত্রা মিত্র এনেছেন শিক্ষিত অ্যাপ্রোচ। বলেছেন, আগে পড়ো, তার পরে গান, নাচ হবে। সেই কাজে যোগ্য সহায়ক ছিলেন নৃত্যগুরু রামগোপাল ভট্টাচার্য, পরে আদিত্য মিত্র। কয়েক দশক ধরে রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যের আবহ ও নাচের কোরিয়োগ্রাফিতে আশ্চর্য সুররচনা করেছেন দীনেশ চন্দ্র। কুমারেশ চন্দ্র বা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় তার উত্তরসাধক। এঁদের মতোই নেপথ্যে থেকে সংলাপ ও কাব্যের মালা সাজাতেন পার্থ-গৌরী ঘোষ জুটি। প্রদীপ ঘোষও। কাজী সব্যসাচীর সূচনা ‘মণিপুর রাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন...’ শুনে আজও মন ভরে ওঠে।
শৃঙ্খলা, পারস্পরিক শ্রদ্ধায় গড়ে উঠেছিল সেই সব দিন। যৌথ পরিবারের মতো। থিয়েটারে আলো নিয়ে নিরীক্ষায় ব্যস্ত তাপস সেন, নৃত্যনাট্যে আশ্চর্য মায়া জ্বালাচ্ছেন কণিষ্ক সেন। অসিতবাবু ঠাট্টা করতেন, শাপমোচন-এ অরুণেশ্বরের কদর্য চেহারা ঢেকে রাখতে বেশি আলো লাগে না, কণিষ্ক এখানেই সবচেয়ে সফল। এই হাসি-আনন্দের পাশাপাশি প্রতিভার ধারাটি বহতা: শম্ভু ভট্টাচার্য থেকে মমতাশঙ্কর হয়ে পরবর্তী প্রজন্মে। পূর্ণিমা ঘোষ, প্রদীপ্ত নিয়োগী, অনিতা মল্লিক বা কৌশিক চক্রবর্তীরা, বয়সকে হেলায় হারিয়ে এই সময়েও বহু নৃত্যনাট্যে প্রধান ভূমিকায়। রবীন্দ্রপক্ষে রবীন্দ্রসদনে প্রতিটি নৃত্যনাট্য হাউসফুল হবে, ধরে নিয়ে কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানের ঢের আগে সংস্থাগুলিকে পুরো টিকিট বিক্রির অর্ধেক টাকা অগ্রিম হিসাবে দিতেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘ বা সপ্তকের নানা প্রযোজনা এ শহরেই দেখা গেছে, নিরাভরণ মঞ্চে উচ্চাঙ্গের বৃন্দগান ও নাচ জেগে আছে স্মৃতিতে। রেকর্ড করা গানবাজনা, এডিটেড স্ক্রিপ্ট, চড়া মেকআপ-পোশাক, জোরালো লেসার আলোয় ইদানীং মঞ্চে যা হয়, তা মন মজায় কই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy