১৯৪০-এর দশকে চার্চ এবং টুরিং-এর গণনা-তত্ত্বের ভিত্তিতে যার চর্চা শুরু হয়েছিল একেবারেই অ্যাকাডেমিক পরিসরে, এবং কিছু খ্যাপাটে বিজ্ঞানভিক্ষু মানুষের চিন্তার মধ্যে, ২০২২-এ পৌঁছে সেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধা হয়ে উঠল প্রযুক্তি দুনিয়ার এক অবিসংবাদী নিয়ন্ত্রক শক্তি। কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তি-নির্ভর যন্ত্রকে মানুষের মতো বুদ্ধিমান করে তোলা ছিল কৃত্রিম মেধার প্রাথমিক লক্ষ্য, এবং আজও তা-ই আছে। বুদ্ধিমান বা মেধাসম্পন্ন যে কোনও প্রাণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিখে নেওয়ার ক্ষমতা। আজকের দুনিয়ায় মেশিন লার্নিং বা যন্ত্রের শিক্ষণ হয়ে উঠেছে কৃত্রিম মেধার সবচেয়ে সফল এবং আধুনিকতম অধ্যায়।
শিখে নেওয়ার অর্থ হল পূর্বার্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা। অভিজ্ঞতার ঝুলি যত ভরে ওঠে, ততই নির্ভুল হতে থাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। মানুষ শেখে আপনজন ও শিক্ষকদের থেকে, কখনও আবার সরাসরি পরিবেশ থেকেও। কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা জোগায় বিপুল ও বিমূর্ত তথ্যের ভান্ডার, যে তথ্যের উৎস আসলে আমরা সবাই। কম্পিউটারভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির ফলে গড়ে উঠেছে এক বিশাল অথচ অদৃশ্য তথ্যের দুনিয়া— একটা ডিজিটাল পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে আমরা সবাই স্রেফ কতকগুলো সংখ্যা দিয়ে তৈরি কিছু বিমূর্ত তথ্যের টুকরো। আজকের বিশ্ব-অর্থনীতিতে তথ্যই হল নতুন পেট্রল। আর বুদ্ধিমান যন্ত্রকে বলতে পারি একটা আধুনিক ইঞ্জিন, যা চলে এই তথ্য নামক জ্বালানির ভরসায়।
মেশিন লার্নিং-এর হাত ধরে এই বিপুল তথ্যের সমুদ্র মন্থন করে এই যন্ত্রগুলো শিখে ফেলে বেশ কিছু নিয়ম। তার পর সেই নিয়মের ভিত্তিতে তারা টেসলা ৪.০-র মতো ড্রাইভারবিহীন একটি গাড়িকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারে গন্তব্যে;পাইলট-বিহীন ছোট বিমান বা ড্রোনের সাহায্যে প্রাকৃতিক ভাবে বিপর্যস্ত এলাকায় ত্রাণের কাজ চালাতে পারে; সুরক্ষিত করতে পারে অনলাইন লেনদেন প্রক্রিয়াকে; কারও ফুসফুসের ডিজিটাল এক্স-রে পরীক্ষা করে বলে দিতে পারে যে তাঁর ক্যানসার হতে পারে কি না; স্রেফ আপনার মুখের কথাতেই বাড়ির আলো-পাখা থেকে স্মার্ট টিভি-সেটটিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেমন করে ‘অ্যালেক্সা’ বা ‘সিরি’র মতো যান্ত্রিক সহকারীরা। বছর দশেক আগেও কম্পিউটারকে একটি প্রোগ্রামের মধ্যে পর পর নির্দেশাবলি সাজিয়ে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়াটাই দস্তুর ছিল। আজকের বুদ্ধিমান কম্পিউটার ক্রমশই বুঝে নিচ্ছে যে, কী করতে হবে, তার পর নিজেই রাস্তা বার করছে, বা প্রোগ্রাম লিখে নিচ্ছে।
বাষ্প ও জলের শক্তি, রেলপথ ও টেলিগ্রাফ, এবং ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে কম্পিউটার ও ডিজিটাল প্রযুক্তি— তিনটি শিল্পবিপ্লব পেরিয়ে আজ চতুর্থটির সম্মুখীন দুনিয়া। এ বারে বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হল কৃত্রিম মেধা এবং ইন্টারনেট অব থিংস তথা যন্ত্রে-যন্ত্রে এক অভূতপূর্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা। ২০১৬ সালে সানফ্রান্সিস্কোতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে প্রথম সারা পৃথিবীতে ঘটতে থাকা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে ধরা হয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব— ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ হিসাবেও যা পরিচিত— হল কৃত্রিম মেধা-নির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য— এমন স্মার্ট মেশিন তৈরি করা, যা তথ্য-নির্ভর স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে, মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে।
গোটা দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি তরুণ আছেন ভারতেই। ফলে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২-এর বাজেট-বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কৃত্রিম মেধাকে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাখির চোখ করার জন্য জোরালো সওয়াল করেছেন। জোর দেওয়া হয়েছে ‘ড্রোন-শক্তি’র মতো প্রকল্পে, যেখানে কৃত্রিম মেধার সাহায্যে বিভিন্ন আকারের ড্রোন ব্যবহার করা হবে দৈনন্দিন ব্যবসায়িক পরিসরে। গত ৬ বছরে, ভারতে স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলোর বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ১৫৪০০%। এর সিংহভাগেরই কেন্দ্রে রয়েছে কৃত্রিম মেধা-ভিত্তিক কোনও নতুন ব্যবসায়িক ধারণা। এ বছর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ইউনেস্কো-র একটি শিক্ষা-সংক্রান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক ব্যবসার বাজার এই মুহূর্তে বছরে ২০.২% চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে, এবং ২০২৫ নাগাদ এই বাজারটির অর্থমূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন ডলার, বা প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার কোটি টাকা। এই বাজারের মূল প্রসার মূলত তিনটি প্রয়োগক্ষেত্রকে ঘিরে— ভোগ্যপণ্য ও পাইকারি ব্যবসা, কৃষি, এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা। অর্থনীতি-র পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩৫ নাগাদ কৃত্রিম মেধার ব্যবসায়িক লভ্যাংশ থেকেই আসবে ভারতের লক্ষ্য যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি, তার প্রায় ১০%। বিশ্বের পঁচিশটি দেশকে নিয়ে গঠিত সংস্থা গ্লোবাল পার্টনারশিপ অন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা জিপিএআই-এর মূল দায়িত্ব হল সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে কৃত্রিম মেধার দায়িত্বশীল প্রয়োগ এবং প্রসার ঘটানো। ২০২২-২৩ সালে এই সংস্থাটির পরিচালনভার নিয়েছে ভারত। সব মিলিয়ে, ভারতের তথাকথিত ডিজিটাল বিপ্লবের মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলো এখন কৃত্রিম মেধার উপরেই।
দেশের সর্বাঙ্গীণ বিকাশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে কতটা প্রস্তুত ভারত? ইউনেস্কো-র ‘২০২২ স্টেট অব দি এডুকেশন রিপোর্ট ফর ইন্ডিয়া: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইন এডুকেশন— হিয়ার, দেয়ার অ্যান্ড এভরিহোয়্যার’ রিপোর্টের মূল বিষয়বস্তু ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধা। রিপোর্ট সুপারিশগুলির মধ্যে ছিল মানবসম্পদ উন্নয়নে কৃত্রিম মেধার প্রয়োগের নৈতিকতা বিচার করা, গবেষণায় জোর দেওয়া, এবং কৃত্রিম মেধা সংক্রান্ত সমস্ত সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে ছাত্র ও শিক্ষকদের নাগালে নিয়ে আসা। বলা হয়েছিল, যথাযথ রাষ্ট্রীয় তথ্যনীতি প্রণয়নের পাশাপাশি তথ্য ব্যবহারের আইনি এবং নৈতিক দিকগুলোর উপরে যথেষ্ট জোর দিতে হবে।
পরবর্তী বছরগুলোতে আইন প্রণয়ন ও বলবৎ করার ক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধা-র ভূমিকা এই দেশে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাই দু’-চোখ বাঁধা আইনের দেবীর মতোই কৃত্রিম মেধার মডেলগুলোকেও পক্ষপাতশূন্য ভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের অজানতেই আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য চলে যাচ্ছে বড় বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে। কৃত্রিম মেধার প্রয়োগে সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন পণ্যের বাজার চিহ্নিত করা হচ্ছে। আবার রাষ্ট্র চাইলেই এ ধরনের তথ্যের মারফত কোনও ব্যক্তিবিশেষের উপরে নজরদারি চালানোর লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে— ব্যক্তির গোপনীয়তার ধারণাটিই অলীক হয়ে উঠছে। কৃত্রিম মেধার নৈতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথ্যের মালিকানা ও অধিকার সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি তাই আজ রাষ্ট্রের তরফেও খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সময় এসেছে।
আর একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই ব্রহ্মমুহূর্তে ভারতের অনেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারগুলো ধুঁকছে অর্থের অভাবে। আমেরিকা ও চিনের তুলনায় আমাদের মৌলিক গবেষণাক্ষেত্রে জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ নামমাত্রই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার থেকে প্রাইভেট ফান্ডিং জোগাড়ের পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। কিন্তু ভারতে গবেষণাক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে বিনিয়োগ করতে পারে, এমন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা অপ্রতুল। তা ছাড়াও, এই ধরনের সংস্থা গবেষণায় লগ্নি করলে রিসার্চ প্রজেক্টগুলোকে নিজেদের লক্ষ্যের সমানুবর্তী করতে চাইবে। এর ফলে স্বাধীন গবেষণার সুযোগ সঙ্কুচিত হবে। কৃত্রিম মেধার গবেষণায় পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, বিষয়টি এখনও তার পরিপূর্ণ বিকাশের অবস্থা থেকে অনেকটাই দূরে। সেই গভীরতর বিকাশ অবশ্যই রাশিবিজ্ঞান, গণিত এবং পদার্থবিদ্যার মতো বিষয়ের উপরে নির্ভরশীল। ভারতে সরকারি অনুদানের অভাবে এই ধরনের তাত্ত্বিক বিষয়ে মৌলিক গবেষণার পথেও বাধা বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাড়াহুড়ো করে চালু করা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ডেটা সায়েন্স, বিগ ডেটা, বা মেশিন লার্নিং-এর স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমগুলোতেও গবেষণার সংস্থান প্রায় নেই বললেই চলে। আশঙ্কা হয়, কৃত্রিম মেধার মহাযজ্ঞে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ভারত দাঁড়িয়ে থাকবে দূরেই।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy