যাক, ডিজ়েলের দাম বাড়েনি বাজেটে। একটু স্বস্তি পেয়েছেন শ্যামল সর্দার। তাঁর গাড়ি নেই, কেনার কথা ভাবতেও পারেন না সামান্য আয়ে। তিনি বাসের কন্ডাক্টর। তেলের দাম বাড়লে বাড়তি ভাড়া চাইতে হয়, যাত্রীদের গালাগাল সইতে হয়। “এই রকম নিত্য অপমানের জীবন অন্য কোন লাইনে আছে?” বলছিলেন গলফ গ্রিন-হাওড়া রুটের শ্যামল। “ডিউটি শুরু হলে আমরা বোবা হয়ে যাই, প্রতি ট্রিপে ঝামেলা হয় যাত্রীদের সঙ্গে। যে যা পারছে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে, মুখ খুললেই গণধোলাই।”
রাজ্য সরকার বাসভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রল, ডিজ়েলের দাম বাড়িয়ে চলেছে। চাপে পড়ছেন বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টররা। আরও বেশি যাত্রী তোলার, আরও ট্রিপ করার চাপ আসছে তাঁদের উপর। লকডাউনের পরে বাসের অসংগঠিত পরিবহণ কর্মচারীদের ভাত-কাপড় জোগাড়ে নাভিশ্বাস উঠেছে। বেসরকারি পরিবহণ কর্মচারীদের মাসিক বেতনের ব্যবস্থা নেই, কমিশন-নির্ভর ব্যবস্থা। একশো টাকার টিকিট বিক্রি হলে ড্রাইভার পান সর্বোচ্চ ১৬ টাকা, কন্ডাক্টর ১১ টাকা। তিন-চার ট্রিপ চালিয়ে ছয়-সাত হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়, কমিশন অনুযায়ী ড্রাইভার কন্ডাক্টর দৈনিক মজুরি পাবেন। ডিউটি শুরু ভোর পাঁচটায়। চা-বিস্কুট খেয়ে শুরু হয় নাগরিক কুরুক্ষেত্র, যার এক পক্ষ বাস ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর, অন্য পক্ষ ট্র্যাফিক পুলিশ। দৈনিক দুটো কেস বাঁধা।
দুপুরে পাইস হোটেলে কষে ঝাল দেওয়া ঝোল আর ভাত না খেলে মুখে রোচে না কিছু, স্বাদকোরক বুজে গিয়েছে ধোঁয়া ধুলায়। ‘চাঁপাডালি বারাসত হাওড়া’ আওড়াতে আওড়াতে টাকরা শুকিয়ে যায়, গাড়ি গ্যারাজ করতে করতে রাত্রি এগারোটা। দিনে আঠারো ঘণ্টা ডিউটির ধকলে, শহরের দূষণে পরিবহণ শ্রমিকরা মাসে আঠারো-কুড়ি দিনের বেশি কাজ করতে পারেন না। বয়স চল্লিশ পেরোলেই কোমরের ব্যথা, শ্বাসকষ্ট। জখম হলে ইউনিয়নের ফান্ড থেকে বা মালিকের বদান্যতায় সাহায্য জুটে যায়। কাজ পাওয়ার অনিশ্চয়তাও থাকে।
লকডাউন উঠে যাওয়ার পরেও দৈনিক টিকিট বিক্রি আগের চাইতে দেড়-দু’হাজার টাকা কম হচ্ছে। রুটের মাত্র অর্ধেক বাস চালু আছে। অনলাইন কাজের বৃদ্ধি গণপরিবহণ ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে। বাসভাড়া বৃদ্ধিও নামঞ্জুর, ফলে যাত্রীর থেকে সাত টাকার টিকিট ন’টাকা নেওয়ার কাজটি বাসশ্রমিককেই করতে হয়। ক্ষোভের আঁচ তাঁদের উপর পড়ে। শ্রম দফতরের ওয়েবসাইটে পাবলিক মোটর ট্রান্সপোর্ট কর্মচারীদের মাসিক বেতনের অঙ্কের তালিকা দেওয়া আছে। কিন্তু মাসিক বেতনের ব্যবস্থা চালু নেই। রাস্তায় যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা, একই গন্তব্যের বিভিন্ন বাসের আগে পৌঁছোনোর জন্য হুড়োহুড়ি, বোঝাই করে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা, এ সবের মূল কারণ হল কমিশন ব্যবস্থা। তেলের দাম বাড়লে বাস মালিকের লভ্যাংশ অটুট রাখতে আরও কঠিন প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, যাতে তার নিজের মজুরির উপর কোপ না পড়ে, আরও বেশি রেষারেষি, আরও বেশি ট্রিপ করার চেষ্টা চলে। সুসময়ে, অর্থাৎ লকডাউনের আগে কমিশন প্রথাতেই চালকের দৈনিক হাজারখানেক টাকা আয় হত, কন্ডাক্টরের সাতশো। মাসে কুড়ি দিনের পরিশ্রমে সংসার চালিয়ে নেওয়া যেত। স্থায়ী বেতন বা সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার তোয়াক্কা তখন কেউ করেননি। ৭৯বি রুটের পলাশ ঘোষ বললেন, বাঁধা বেতন পেলে, তার অঙ্ক কম হলেও, তাঁরা আঠারো ঘণ্টা ডিউটি আর ডেকে ডেকে যাত্রী তোলা কখনওই করতেন না। আর আজ তাঁদের একই খাটাখাটনি করেও আয় হচ্ছে অর্ধেক।
ফলতার অখিল সর্দার দুই দশক ধরে কলকাতায়। খালাসির কাজ দিয়ে শুরু করে কন্ডাক্টর, এখন মিনিবাস চালান। বাসই তাঁর আবাসস্থল। বলছিলেন, শীতে অ্যালুমিনিয়ামের মেঝে থেকে ঠান্ডা ওঠে বেশি, কাঠের বাসের আশ্রয় বেশি আরামের। এই বিচিত্র আশ্রয়কে ভবিতব্য মেনে জীবন কাটিয়ে দিলেন। কলকাতার অধিকাংশ পরিবহণ কর্মীই পরিযায়ী শ্রমিক, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, মেদিনীপুর, নদিয়ার মানুষ। লকডাউনের সময় বাড়ি গিয়ে আনাজ বা মাছের ঠেলা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। আর কলকাতায় ফেরেননি।
“ট্রান্সপোর্টের লাইনে এখন কেউ আর তেমন কাজ করতে আসতে চায় না”, জানালেন ৪৫ রুটের বাসের মালিক ও বাসচালক সত্যজিৎ ঘোষ। “অমানুষিক পরিশ্রমের সঙ্গে যত অপমান আর হিংসার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের, চামড়া খুব মোটা না হলে টিকে থাকা মুশকিল। যাঁরা বাসে চড়েন, তাঁরা শহরের মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, গরিব লোক। দু’টাকার জন্য তাঁরাই আমাদের শত্রু ভাবছেন।” পলাশ, অখিলরা মেনেই নিয়েছেন, রাজ্য সরকার জনমোহিনী নীতির জন্য ভাড়া বাড়াতে দেবে না, কেন্দ্রীয় সরকার ঘন ঘন তেলের দাম বাড়াবে, আর উলুখাগড়ারা নিজেদের মধ্যে গালাগালি-মারামারি করবে। দু’টাকার জন্য যে সমাজ অবিশ্বাস্য রকম মৌখিক হিংসা সহ্য করতে বাধ্য করে, সে সমাজ যাচ্ছে কোন দিকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy