ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের গন্ধে ভরে আছে আমাদের সংস্কৃতি। গত পাঁচ হাজার বছরে চাষিরা অমানুষিক পরিশ্রম করে, বুদ্ধি খাটিয়ে ধানের বিপ্লব এনেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে হাজারো ধানের প্রজাতি তৈরি হয়েছে। ভারতে সবুজ বিপ্লবের দাপটে লাখখানেক প্রজাতির ধান হারিয়ে গিয়ে বাজারে পড়ে আছে মাত্র কয়েক রকম ধান। তবুও কাহিনি পুরোপুরি বিয়োগান্তক হয়নি, কারণ কিছু মানুষ হারিয়ে যেতে বসা ধান সংরক্ষণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সত্তরের দশকের শেষ থেকে। পথের প্রদর্শক আর এইচ রিছারিয়া। পরে দেবল দেব, অনুপম পাল, অভ্র চক্রবর্তী, ভৈরব সাইনি, ফিয়াম এবং আরও অনেকে দেশি ধান সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন।
যে ধানের বীজ থেকে প্রতি বার একই চরিত্রের ধান পাওয়া যায়, এবং বহু বছর চাষ করলেও যে ধান চেহারা, সুগন্ধ, রং পাল্টায় না, তাকেই দেশি ধান বলা চলে। চাষযোগ্য সমস্ত বীজ নিয়েই সারা পৃথিবীর চাষিরা হাজারো বছর ধরে সংরক্ষণের কাজ চালাচ্ছেন। এখানে ধান নিয়ে কাজ চলছে, আমেরিকার চাষিরা মত্ত ভুট্টা নিয়ে। নীল ভুট্টা বা কালো ধানের নিছক মজাটায় অংশগ্রহণ করেছেন দেশ-কাল নির্বিশেষে এক দল জ্ঞানপিপাসু এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। প্রকৃতিতে গাছপালার স্বাভাবিক সংমিশ্রণ দেখে, ইচ্ছাকৃত ভাবে পরাগমিলন করিয়ে, বীজ বেছে রেখে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পর্যবেক্ষণ করে, এক একটি জাত তৈরি করলেন চাষিরা! সন্তানদের দিয়ে গেলেন বীজ, তা ধীরে ধীরে এক একটা অঞ্চলে লোকায়ত হল, কোনও অঞ্চল বিখ্যাতই হল বীজের গুণে। দিনাজপুরের তুলাইপাঞ্জি ধান, কাটোয়ার ডাঁটা, কাশির বেগুনের নাম ফিরল মানুষের মুখে মুখে।
ব্রিটিশরা এল গেল, তবুও বহু প্রজাতির বীজ বেঁচে রইল দেশজ চাষে, উৎসবে, গৃহদেবতার ভোগে, লোকাচারে। এল সবুজ বিপ্লব, সার-বিষ-বীজের প্যাকেজ সম্বলিত চাষির দুর্দশা দূরীকরণের কঠিন দাওয়াই। ‘উন্নত’ ধানের সঙ্গে এল অধিক ফলনের প্রতিশ্রুতি, জেলায় জেলায় কর্মসূচি এবং চাষির উপকারের তীব্র বাসনা। ভুলিয়ে দেওয়া হল যে বার বার নতুন বীজ কিনতে হবে কৃষকদের। অতিরিক্ত ফলনের মগজধোলাইতে চাষিরা ভুললেন ঘরের বীজের কথা। অথচ, প্রতি বছর চাষ না করলে ধানের বীজ নষ্ট হয়। এই ভাবে হাজার হাজার ধান অবলুপ্ত হল। অথচ, সংরক্ষক এবং জৈব চাষিদের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে, দেশি ধান যথার্থ পদ্ধতিতে চাষ করলে তুল্যমূল্য, কিংবা বেশি ফলনও সম্ভব।
বীজ অবলুপ্ত হলে চাষির আর্থিক ক্ষতি। বার বার বীজ কিনতে হচ্ছে, বীজের দাম বাড়ছে, ফসলের দাম সেই অনুপাতে মিলছে না, ফলে ঋণের বোঝা থেকেও রেহাই মিলছে না।
এত বছরের গবেষণার ফল খোয়ানোর মানে বিভিন্ন স্বাদ, গন্ধ, টেক্সচার, ঔষধিগুণসম্পন্ন ধান হারিয়ে জীববৈচিত্রের ক্ষতি। বিশেষ পরিস্থিতির জন্য ধান, যেমন বন্যা, খরা বা নোনাজল সহিষ্ণু ধান, সেগুলি হারালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চাষই অসম্ভব। ইদানীং ঘূর্ণিঝড়ের নোনা জল সুন্দরবনের চাষের খেতে ঢুকে যাওয়ায় সংরক্ষকদের খোঁজ পড়ছে, কিন্তু পরিমাণমতো বীজের জোগান চাষ চালু রাখলেই সম্ভব। আমাদের খামারে জলা অঞ্চল উঁচু করতে টাকার অপচয়ের বদলে তিন রকমের বন্যাসহিষ্ণু ধান লাগিয়েছি। প্রথম বার এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ধান পুঁতলাম, পড়শিরা হেসেই খুন! সেই ধান যখন প্রায় ৬ ফুট লম্বা গাছ হয়ে সোজা দাঁড়াল, শিষ হল কনুই থেকে হাতের পাতা পর্যন্ত, তখন তাঁদের বিস্ময়টা উপভোগ করেছিলাম। খরাপ্রবণ অঞ্চলেও নৈচী বা কেলাসের মতো ধান চাষির রোজগার বাড়াবে।
স্থানীয় খাদ্যগুলি ধানের সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কনকচূড়ের সুস্বাদু, সুগন্ধি খই, ক্ষীর এবং খেজুরগুড় মিলে তৈরি হত জয়নগরের মোয়া। বর্ধমানের সীতাভোগ হত সীতাশাল চালে, তার নামেই মিষ্টান্নের নাম। ধান হারিয়ে খই হারাল, খই হারিয়ে মোয়া গেল। সীতাশাল হারিয়েছে, আসল সীতাভোগও গিয়েছে হারিয়ে!
রাধাতিলক, রাঁধুনিপাগল, লক্ষ্মীদিঘল, দয়ালমদিনা, আগরআলি— নামগুলোর মধ্যে যেন গল্প লুকিয়ে আছে! অনেক নামের শেষেই শাল শব্দটা মিলছে, যেমন রাম, লক্ষ্মণ, সীতা এবং রাবণের শেষে শাল বসালে চারটে ধানের নাম পাই! কবিরাজশালের নামেই ইঙ্গিত যে ঔষধি। খেলে রোগ নিরাময় হয়। কিছু প্রজাতির কোমল ধান রাতে ভিজিয়ে রাখলে সকালে নরম হয়ে যায়। খেতে সুসিদ্ধ চালের মতো না হলেও, চটজলদি সকালের খাবারের জন্য অঘনিবোরা, ভোগলিবোরার মতো কোমল ধান জনপ্রিয় ছিল।
আজ আমরা যখন অবিরত হাওয়ায়, জলে, খাদ্যে বিষ মিশিয়ে চলেছি নির্ভার মনে, তখন দেশি বীজ মনে করায় সেই পূর্বসূরিদের— যাঁরা অনন্ত কালের জন্য গরম ভাত রেখে যেতে চেয়েছিলেন।
ঋণ: অভ্র চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy