সৌজন্য: রাজঘাটে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, ৬ সেপ্টেম্বর। পিটিআই
মুক্তিযুদ্ধে হতাহত ভারতীয় সেনার পরিবারের জন্য দেওয়া মুজিব-বৃত্তির অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে সবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরের শেষার্ধ। দক্ষিণ দিল্লির একটি পাঁচতারা হোটেলে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু’দেশের অফিসার, নেতা, কর্তারা। কফিতে একের পর এক চিনির প্যাকেট ঢালতে ঢালতে অত্যন্ত তিক্ত কণ্ঠে পূর্ব পরিচিত আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা মুখ খুললেন। যিনি হাসিনার ঘনিষ্ঠও বটে। “ভোট এসে যাচ্ছে। আপনারা আপা-কে বড় বিপদে ফেললেন! কী হবে জানেন তো? নিজেরাও মরবেন, আমাদেরও মারবেন। একটাও তো বন্ধু নাই অঞ্চলে! সব বন্ধু তো হারিয়েছেন এক এক করে।”
নিঃসন্দেহে অতিশয়োক্তি। বছরের পর বছর তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির জন্য অপেক্ষা থেকে তৈরি হওয়া ক্ষোভ। এবং তার থেকেই এই তিক্ত বচন। বহু তস্কর পালানোর পরে হলেও এখন সাউথ ব্লকের বুদ্ধি জেগেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সক্রিয় কূটনীতি চালানোর ফলে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এমনকি মায়ানমারের সঙ্গেও ভারতের দেওয়া-নেওয়া মন্দ নয়।
কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার নয়, শেখ হাসিনা ফের জিতে আসার পর গত চোদ্দো বছরে বাংলাদেশের মতো বন্ধু আর কে আছে ভারতের দক্ষিণ এশিয়া তথা গোটা অঞ্চলে। আওয়ামী লীগের ওই নেতা সম্ভবত সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে মৈত্রীর সফর তো হল। কিন্তু সেই সফরের শেষে হাতে রইল কুশিয়ারা নদীর জলবণ্টন চুক্তি। অনেক আগেই বাংলাদেশকে দেওয়া কম সুদে শর্তসাপেক্ষ ঋণে প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে কিছু কেনাকাটা। দীর্ঘ যৌথ বিবৃতিতে আরও অনেক সমঝোতার আশ্বাস রয়েছে। কিন্তু তাকে মাইলফলক বলা চলে কি?
একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েই শেখ হাসিনা তাঁর সফরের প্রায় দেড় মাস আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। জানিয়েছিলেন, তিনি আসছেন, মমতার সঙ্গে দেখা হবে এই আশা রয়েছে তাঁর। হাসিনার দিক থেকে এই আশা করাটা খুব অন্যায় নয়। তিনি জানতেন যে, আজ বলে কাল তিস্তা চুক্তি হয়ে যাবে না। কিন্তু দিল্লিতে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জলবণ্টন চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাপ-আলোচনাটুকু করতে পারলেও তা তাঁর ঘরোয়া রাজনীতির জন্য লাভজনক হত। হাসিনার সঙ্গে মমতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সুমধুর। কিন্তু শুকনো ভালবাসায় কূটনীতির চিঁড়ে ভেজে না। মুখোমুখি বসতে পারলে হয়তো নিজের মতো করে চাপ তৈরি করতে পারতেন শেখ হাসিনা। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরকালে সীমান্তবর্তী মুখ্যমন্ত্রীদের ডাকার একটা রেওয়াজ ও কার্যকারণও রয়েছে।
হাসিনার সফরটি ছিল রাষ্ট্রীয় সফর। কেন্দ্রের বিনা আমন্ত্রণে মমতা দিল্লি এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করে যেতে পারতেন অবশ্যই, কিন্তু সেটা সব হিসাবেই বিসদৃশ। কেন্দ্র-রাজ্য বর্তমান টানাপড়েনের মাঝে সেটা মমতা করবেনও না, জানাই ছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দিনের নৈশভোজে সুযোগ পাওয়ায় তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মমতার আসা না-আসা নিয়ে তাঁর কী মনোভাব। দীর্ঘ জবাব দিয়েছিলেন হাসিনা। যার মোদ্দা বার্তা ছিল, তিনি এখনও উন্মুখ। তিনি আশা করেছিলেন এ বারে হবে। তবে আশা ছাড়ছেন না। তিস্তার চাবিকাঠি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে, সে কথা তিনি মুখে বলেননি যদিও। যা সবাই জানে, তা আলাদা করে বলার দরকারও পড়ে না।
কিন্তু রহস্য হচ্ছে, যা সবাই জানে তা তো সাউথ ব্লকও জানত! মমতা দিল্লি আসায় তিস্তার জল যদি একটুও গড়াত তা হলে সেটা কেন্দ্রীয় সরকারেরও লাভ। কেন তা হলে উদ্যোগী হয়ে মমতাকে ডাকা হয়নি, তার কোনও স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি বিদেশ মন্ত্রকের কাছ থেকে। শুধু এটুকুই ঘরোয়া ভাবে জানানো হয়েছে, আগে যা হয়েছে (মুখ্যমন্ত্রীদের আমন্ত্রণ) তা অতীত। সংশয় তৈরি হয়েছে তা হলে বিজেপি-তৃণমূলের রাজনৈতিক লড়াইয়ের তলায় কি চাপা পড়ে গেল আমন্ত্রণের সৌজন্য?
ভারতে পা দেওয়ার আগে তিনটি বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগ খুবই কড়া ভাষায় জানিয়েছিলেন হাসিনা। এক তিস্তা। দুই, সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা। তিন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমার যাতে ফিরিয়ে নেয় তার জন্য ভারতের ভূমিকা নেওয়া। তিনটিরই উল্লেখ যৌথ বিবৃতিতে আছে প্রতিশ্রুতি হয়ে। কিন্তু কাগজ থেকে তা মাটিতে কবে নেমে আসবে তার কোনও সময়রেখা দেওয়া নেই।
বিমানবন্দরে শেখ হাসিনা নামার পরেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ঝড় ওঠে। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে তো কই নরেন্দ্র মোদী দাঁড়িয়ে নেই ফুল হাতে। এমনকি কোনও পূর্ণ মন্ত্রীও নেই। রয়েছেন বস্ত্র ও রেল মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী যাঁকে বাংলাদেশ চেনে না। তা হলে কি সুর গোড়াতেই কেটে গেল? দুপুর গড়িয়ে বিকেলে সেই ঝড় এতই বাড়তে থাকে যে, বিদেশ মন্ত্রকের অফিসারদের বোঝাতে হয়, তাঁরা যা করেছেন তা প্রোটোকল-সম্মত। ভারতে আসা বিদেশি অতিথির আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতি ভবনের চাতালে। সেটাই রীতি। সেখানেই উপস্থিত থাকেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রীরা যান বিমানবন্দরে।
কিন্তু সেই প্রোটোকল ভেঙেই তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৭ সালের হাসিনার সফরে বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। প্রশ্নটা উঠছে, যে আবেগ ও উষ্ণতা তাঁকে সে বারে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়েছিল, তা কি কিছু কম পড়েছিল এ বার? সাউথ ব্লকের পাল্টা যুক্তি, আদৌ নয়। ব্যতিক্রম এক বারই করা যায়। বার বার করলে তা নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। আর একটি দেশের জন্য করলে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
যুক্তি বা আবেগ কোনওটাই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এটাও স্মর্তব্য, মুজিব-বৃত্তি দেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে রক্তের ঋণ স্বীকার করে হাসিনা বার বার তাঁর দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেন, ভারতীয় সেনাদের আত্মত্যাগ ভুললে চলবে না। হাসিনাকে বার বার এ কথা স্মরণ করাতে হচ্ছে, কারণ ভারত-বিরোধিতার পাত্রে আসলে মৌলবাদের হলাহল তৈরি হচ্ছে তাঁর দেশে অহরহ। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে সেই পাত্র তত বড় হবে। হলাহল উপচে ছড়িয়ে যাবে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে মাঠ-ময়দানে।
নিজ নিজ প্রয়োজনেই এ কথা মাথায় রেখে যৌথ বিবৃতির সমঝোতা-প্রতিশ্রুতিগুলিকে দ্রুত বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে হবে দু’দেশকেই। যুক্তি এবং আবেগের ভারসাম্য বজায় রেখে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy