Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বিপদঘণ্টি ও ভোটকৌশল
UP Assembly Election 2022

উত্তরপ্রদেশে এত দিন দলিতবিরোধিতার পর এখন পথ পাল্টানো

খোদ প্রধানমন্ত্রীর ওবিসি শ্রেণির পরিচয়কে সম্বল করে লড়াইয়ের নতুন পরিকল্পনা করেছে বিজেপি।

দলবদল: প্রাক্তন বিজেপি নেতাদের সমাজবাদী পার্টিতে যোগদানের অনুষ্ঠানে সমাজবাদী কর্মীদের সমাগম।

দলবদল: প্রাক্তন বিজেপি নেতাদের সমাজবাদী পার্টিতে যোগদানের অনুষ্ঠানে সমাজবাদী কর্মীদের সমাগম।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৪৭
Share: Save:

আর্যাবর্তের রাজনীতি মণ্ডল বনাম কমণ্ডলুর যুদ্ধে মশগুল থেকেছে এক কালে। উত্তরপ্রদেশের আসন্ন নির্বাচনী রঙ্গমঞ্চে এ বার তা নতুন বোতলে পরিবেশিত হচ্ছে। বোতল নতুন। অর্থাৎ স্থান, কাল, পাত্র ভিন্ন। অন্য দিকে, পুরনো মদেও যৎকিঞ্চিৎ বদল এসেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। মণ্ডল রাজনীতির জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের দাবি ছিল প্রাচীন। অন্য দিকে, বিজেপি প্রথম কমণ্ডলুকে রাজনৈতিক অস্ত্র করা শুরু করে ১৯৮৬ সালে, রামজন্মভূমি ন্যাসের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালের ভোটের আগে হিমাচলপ্রদেশের পালামপুর কনভেনশনে রাম মন্দিরের দাবি তুলেছিল বিজেপি।

শুধুমাত্র হিন্দুত্বের বাতাস ভরলেই যে কমণ্ডলু রাজনীতির বেলুন আকাশ দাপিয়ে বেড়াবে, এমনটা যে নয়, তা বুঝেছিলেন নরেন্দ্র মোদী নিজের রাজ্য গুজরাতে বসে। লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বে ২০০৯-এর লোকসভায় খারাপ ফল করে বিজেপি। উগ্র হিন্দুত্বের সঙ্গে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের ককটেল যে প্রয়োজন কমণ্ডলু রাজনীতিতে, তা প্রথম যাঁরা বুঝেছিলেন তাঁর মধ্যে অগ্রগণ্য সেই মোদীই। এর পর যমুনা, সরযূ, গঙ্গা, গোমতী দিয়ে বিস্তর জল প্রবাহিত হওয়া এবং পলি সঞ্চয়ের মাধ্যমে আজ বিজেপি-র কমণ্ডলু রাজনীতিতে এসেছে আরও একটি মাত্রা। সে-ও মোদীরই দান।

কী সেটা? আগের দু’টি মাত্রা তো রয়েছেই। আপাতত উত্তরপ্রদেশের দিকেই যদি তাকাই, দেখব কাশীর নতুন করিডর, অযোধ্যার পর মথুরায় বিশাল মন্দির গড়ার প্রতিশ্রুতির মতো হিন্দুত্বের আবেগ-ঋদ্ধ জোয়ার। আর বিরোধী শক্তিকে তালিবান আখ্যা দিয়ে মেরুকরণ এবং জাতীয়তাবাদের ডঙ্কা। এর সঙ্গে তৃতীয় মাত্রা হিসাবে বিকাশের মহামন্ত্রকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বার বার লখনউ, বারাণসীতে গিয়ে ভোটের আগে উচ্চারণ করছেন লক্ষ কোটি টাকার যোজনা প্রকল্পের শিলান্যাস করে। উত্তরপ্রদেশের বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে উন্নয়নের সরকারি হিসাবের গুঞ্জন। উত্তরপ্রদেশের ৪৩ লক্ষ দরিদ্র মানুষকে দেওয়া হয়েছে বাসস্থান, দেশের ৮০ কোটি মানুষের জন্য অতিরিক্ত পাঁচ কিলোগ্রাম চাল বা গম, সাড়ে চার লক্ষ পাকা চাকরি এবং সাড়ে তিন লক্ষ চুক্তিবদ্ধ কাজ। ‘সৌভাগ্য’ যোজনায় উত্তরপ্রদেশের প্রায় দেড় কোটি বাড়িকে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া, আখ চাষিদের বকেয়া দেড় লক্ষ কোটি টাকা মিটিয়ে দেওয়ার সরকারি দাবি।

ফলে হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদ এবং বিকাশের এই ত্রিবেণী সঙ্গমে মোদী-যোগী আদিত্যনাথের হাতে তৈরি হওয়া কমণ্ডলুর এই নতুন ধারায় ভোটের জমি উর্বরা হবে— এমনটাই ছিল পূর্ব পরিকল্পনা। কিন্তু তাতে বাদ সাধছে সেই প্রাচীন মণ্ডল রাজনীতির কাঁটা। তৈরি হচ্ছে এক ভিন্ন রাজনৈতিক চিত্রনাট্য। বিজেপির তিন অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির প্রভাবশালী নেতা ও যোগী মন্ত্রিসভার সদস্য স্বামী প্রসাদ মৌর্য, দারা সিংহ চহ্বান এবং ধরম সিংহ সায়নি (সঙ্গে ১১ জন বিজেপি বিধায়ক) দল ছাড়লেন। এসপি-তে যোগ দিয়েছেন তাঁরা।

ভোটের আগে দলত্যাগ কোনও বড় খবর নয় উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে। কিন্তু যেটা বড় খবর, সেটি হল প্রত্যেকেই ছাড়ার পর তর্জনী নির্দেশ করে বলছেন, যোগী সরকার অন্তঃস্থল থেকে দলিত-বিরোধী, ‘পিছড়ে’ বর্গের বিরোধী মানসিকতা নিয়ে এত দিন কুশাসন চালিয়েছে।

গেরুয়াশোভন যোগী আদিত্যনাথের প্রশান্ত ললাটে কুঞ্চন আর অস্পষ্ট নেই। তাঁর সরকারকে ভোটের অন্তিম লগ্নে এসে দলিত-বিরোধী, ‘পিছড়ে’ বর্গ-বিরোধী বলে দাগিয়ে দিলে তার পরিণাম যে সুখকর হবে না, তা তাঁর চেয়ে ভাল জানে কে!

অর্থাৎ, হরিজন, দলিত, জনজাতি তফসিলি— সবাইকে হিন্দুত্বের মঞ্চে নিয়ে আসার যে কৌশল ২০১৩ সালে মুজফ্‌ফরনগরে সাম্প্রদায়িক অশান্তির মাধ্যমে শুরু করেছিল বিজেপি— যাকে রাজনৈতিক মহল বলে ‘মুজফ্‌ফরনগর মডেল’, যার ফলে পরপর দু’বার (২০১৭-র বিধানসভা এবং ২০১৯-এর লোকসভা) সাফল্যও পাওয়া গিয়েছিল এবং এ বারও যে দাঙ্গার কথা তুলে প্রচারে বেগ বাড়ানো হচ্ছে, এমনকি খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাই করছেন— তাতে একটা ধাক্কা দিয়েছিল এই মন্ত্রীদের ছেড়ে যাওয়াকালীন ভাষ্য। সমাজের তলানিতে থাকা বঞ্চিত এবং শোষিত জাতিবর্গের কাছে যে বার্তা এর পর যাচ্ছে, তা মণ্ডল রাজনীতির মৌলিক যুক্তিকেই শক্তিশালী করছে না কি?

উত্তরপ্রদেশের প্রায় ৩৯-৪০ শতাংশ ভোট ওবিসি শ্রেণির। তাঁদের মধ্যে ৭ শতাংশ যাদব। যাদবেরা প্রথাগত ভাবে সমাজবাদী পার্টির ভোটার। বাকি ৩০-৩২ শতাংশ ওবিসি ভোটকে গত ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই পাখির চোখ করে রেখেছে বিজেপি। গত দুই লোকসভা কিংবা পাঁচ বছর আগেকার বিধানসভা ভোটের সময়ে ওবিসি ও তফসিলি জাতি-জনজাতির ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলিকে (রাজ্যের মোট ভোটের প্রায় ২০ শতাংশ) জাতপাতের চেনা ছক ভেঙে বৃহত্তর হিন্দুত্বের ছাতার তলায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন অমিত শাহেরা। যার ফলে চিরাচরিত ভোট হারায় এসপি-বিএসপি’র মতো দলগুলি। তাই এই ভোট ব্যাঙ্ক বিজেপির কাছে স্বর্ণাদপী গরীয়সী! দলের মধ্যে বিপদঘণ্টি বেজে যাওয়ায়, উপায়ান্তর না দেখে খোদ প্রধানমন্ত্রীর ওবিসি শ্রেণির পরিচয়কে সম্বল করে লড়াইয়ের নতুন পরিকল্পনা করেছে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের মানুষকে নিজের ওবিসি পরিচয় স্মরণ করিয়ে দিতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রীও।

সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি। মুসলিম এবং যাদবের সমর্থন মোটের উপর তাঁর কুর্তার পকেটে ছিল। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির বাকি অংশের মন পেতেও নিত্যনতুন সংযোগ প্রচার করছে তাঁর দল। তবে এখনই শেষ কথা বলার সময় আসেনি। উত্তরপ্রদেশ এমন কোনও হাতের মোয়া নয় অখিলেশের কাছে যে, তিনি পেলেন আর টপ করে উদরস্থ করলেন। যোগী আদিত্যনাথের পিছনে রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ, তেল খাওয়া সংগঠন, খোদ প্রধানমন্ত্রীর হাত তাঁর মাথায়। অন্য দিকে, হিসাবের বাইরে থাকা মায়াবতী কোন খেলা দেখান, তা অনিশ্চিত। মায়া আগের তুলনায় শক্তিহীন, কিন্তু মাঠের বাইরে নন। বিশেষ করে ‘বাবুয়া’র বিরুদ্ধে যে ভাবে খড়্গহস্ত ‘বুয়া’, তাতে এসপি-র আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দলিত, মুসলমান ভোটে যথেষ্ট প্রভাব এখনও রয়েছে মায়াবতীর। তিনি নিশ্চিত ভাবেই জিতবেন না, কিন্তু এসপি-র নাক (ভোট) কেটে বিজেপিকে সুবিধা করে যে দেবেন না, তা কে বলতে পারে! সিবিআই-এর জুজু তাঁর শয়নে-স্বপনে গত তিন বছর ধরে। কংগ্রেস তার প্রথম তালিকায় ১২৫ জনের মধ্যে ৫০ জন নারীকে বেছেছে। উন্নাওয়ের নির্যাতিতার মা-কে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করানোটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ চাল প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার। সব মিলিয়ে লখনউ দখলের লড়াইয়ে কিছু সঙ্কেত দেখা যাচ্ছে মাত্র। পুরো ছবি এখনও আঁকা হয়নি।

উত্তরপ্রদেশেরই উর্দু কবি জিগার মুরাদাবাদী প্রেমকে সংজ্ঞায়িত করতে লিখেছিলেন— ‘এক আগ কা দরিয়া হ্যায়/ ঔর ডুবকে জানা হ্যায়’! অর্থাৎ প্রেম হল এমনই এক আগুনে নদী, যার মধ্যে ডুবে গিয়ে তাকে খুঁজতে হয়! ভোটের মুখে রাজনৈতিক নেতারাও এর সারমর্ম ভাল ভাবেই বুঝছেন এখন!

প্রেম এবং যুদ্ধ, দু’ক্ষেত্রেই নাকি সব কিছু মঞ্জুর!

অন্য বিষয়গুলি:

UP Assembly Election 2022 BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy