প্রশ্ন: নিয়োগ কবে, কোন পথে? প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরিপ্রার্থীদের অবস্থান, করুণাময়ী, কলকাতা, ২১ অক্টোবর। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
সংলাপগুলো যেন বুড়ির সুতোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে এ দিক ও দিক। ছেঁড়া ছেঁড়া, কিন্তু কোথায় একটা মালা গাঁথা হয়ে চলেছে সকলের অগোচরে, ঘন বুনোটের মালা।
বুম ধরা হাতগুলো এগিয়ে আসছে মুখের কাছে। ক্ষয়াটে, বিবর্ণ, ফ্যাকাসে চেহারা। তিন-চার দিন জল পর্যন্ত স্পর্শ না করা সেই চেহারাগুলো রুগ্ণ, কিন্তু উজ্জ্বল চোখের অধিকারী। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ভেসে আসছে, “যত ক্ষণ না নিয়োগপত্র হাতে পাচ্ছি তত ক্ষণ এখান থেকে নড়ছি না।” “আমরা তো সেই কবে থেকেই রাস্তায় বসে আছি। আমাদের আর নতুন করে কষ্ট কী হবে!” “আমাদের হকের চাকরি চুরি গেছে। পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি হয়েছে। নিয়োগপত্র না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”
বিধাননগরের করুণাময়ীতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সামনে অনশনে বসা কতকগুলো চেহারা। কেউ বাঁকুড়া, কেউ পূর্ব বা পশ্চিম মেদিনীপুর, কেউ হাওড়া, কেউ বা মুর্শিদাবাদ— নানা প্রান্ত থেকে আসা তরুণ-তরুণীরা আক্ষরিক অর্থেই নির্জলা উপবাসে রয়েছেন। মাথার উপরে কার্তিকের খোলা আকাশ, কারও কারও সঙ্গে তাঁদের ছোট বাচ্চা, বাড়িতে রেখে আসার উপায় নেই, তাই সঙ্গে আনা। এতগুলো মানুষ রাস্তায় বসে, অথচ যথাযথ কোনও শৌচাগার নেই। বাড়িতে কারও অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা-মা, ছোট ভাই-বোন, কারও বা স্বামী। তাঁদের বাড়ির মানুষ কখনও কলকাতায় মাতঙ্গিনী মূর্তির নীচে, কখনও গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ঠাঁই নেন। শেষে করুণাময়ীতে পুলিশের ভারী বুট আর নির্মম ব্যবহারে তাঁদের আন্দোলনের এই পর্যায়ে আপাতত ইতি ঘটল। অবশ্য শুক্রবার সকাল থেকেই ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছে বাম, বিজেপি, কংগ্রেস। যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ওই রাস্তাতেই বসে পড়ে ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলি। এবং পুনরাবৃত্তি ঘটে বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার। কাউকে চ্যাংদোলা করে, কাউকে টেনে-হিঁচড়ে তোলা হল প্রিজ়ন ভ্যানে।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত পুলিশ শুধু মাইকে বিনয়ী ঘোষণা করে গিয়েছিল, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ অনুসারে ওই এলাকা খালি করে দিতে হবে আন্দোলনকারীদের। না হলে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা করবে। এক দিকে ঘোষণা, অন্য দিকে শক্তিবৃদ্ধি। সন্ধ্যা থেকেই ফোর্সের সংখ্যা বেড়েছিল। পর্ষদ সভাপতি যদিও এর আগে দাবি করেছিলেন, আন্দোলনকারীদের প্রতি তিনি সংবেদনশীল। কিন্তু তিনি আইনের বাইরে যেতে পারবেন না।
রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের বার্তা পুলিশ অবশ্য ওই দিন সন্ধ্যায় পেয়ে গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি আন্দোলনকারীদের পক্ষে— ‘ন্যায্য’ আন্দোলনকারীদের পক্ষে। ন্যায্য আন্দোলনকারী ঠিক কারা? তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ২০১৭ সালে টেট পরীক্ষায় পাশ করা চাকরিপ্রার্থীরা বৃহস্পতিবারই পাল্টা অবস্থান শুরু করেন। তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ২০১৪-য় টেট পাশ করা পরীক্ষার্থীরা। দু’পক্ষই যুযুধান। বিষয়টা দাঁড়িয়ে গেল দু’পক্ষের লড়াইয়ে। এমন অভিযোগও উঠেছে, এ হল ‘শত্রু’শিবিরে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা, যে পদ্ধতিতে প্রতিকূল পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সুবিধা হয়।
এই ‘ন্যায্য’ ও ‘অন্যায্য’ আন্দোলনের বিষয়টা সব সময়ই মজার। সিঙ্গুরে জাতীয় সড়কের একটি লেন অবরুদ্ধ করে দিনের পর দিন আন্দোলন চালানোটা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের কাছে অন্যায্য হলেও বিরোধী দল তৃণমূলের কাছে ছিল ন্যায্য! বুদ্ধদেববাবুর সরকার অবশ্য গভীর রাতে পুলিশ দিয়ে সেই আন্দোলন ভেঙে ফেলার প্রয়াস করেনি। সেটা গণতান্ত্রিক আবহের উপর অগাধ আস্থা রাখার জন্য, না কি অতটা এগিয়ে খেলার সাহস দেখাতে না চাওয়া, তা বলা কঠিন।
এটাও পুলিশের চিরকালীন স্ট্র্যাটেজি। গভীর রাতে ভিড় পাতলা হয়ে যায়, আন্দোলনকারীদের টানটান স্নায়ু একটু শিথিল হয়। আর এখানে তো চার দিনের অভুক্ত শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে, মনের ক্লান্তি আরও বেশি। ফলে মিনিট পনেরোর মধ্যেই পুলিশি অভিযান খতম! টেনেহিঁচড়ে, চ্যাংদোলা করে একের পর এক প্রতিবাদীকে বাসে তুলেছে পুলিশ। কারও নাক ফেটে রক্ত পড়ছে। শুধু অক্লান্ত মিডিয়ার লাগাতার সম্প্রচার এ রকম একের পর এক ফ্রেমকে সামনে আনছে।
টেলিভিশন ক্যামেরার দিকে তাঁদের কেউ কেউ অসীম শূন্যতায় তাকিয়ে রয়েছেন, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অঝোর জলধারা! না, প্রশাসনের রক্তচক্ষু বা লাঠির ঘায়ে এই অশ্রু নয়। তীব্র হতাশা, বিশ্বাসহীনতা, অসংবেদনশীলতা এবং অপাঙ্গে অবহেলার দৃষ্টি ছুড়ে দেওয়া প্রশাসন ও রাজশক্তিকে দেখে তাঁদের হয়তো বা মনে হচ্ছে, এঁরাই আমাদের অভিভাবক! এঁদেরকেই ডেকে বলছি, এক বার আসুন এখানে। আপনারা এলেই হবে। এসে দেখুন, কোন তীব্র অসহায়তা আমাদের! তবুও, খাদের একেবারে কিনারে চলে যাওয়া আমরা এখনও আপনাদের সস্নেহ ডাকের অপেক্ষায়। বিশ্বাস করুন, আমরা এ ভাবে অন্যদের ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটাতে চাইনি।
২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত কেটে গিয়েছে আট বছর। তখন যাঁরা তিরিশের কোঠায়, তাঁদের অনেকেরই বয়স এখন চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। কী করবেন তাঁরা এখন? তাঁদের দায়িত্ব কে নেবে? এই সব প্রশ্ন যখন আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, তখন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি গৌতম পাল বলছেন, “যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা দু’বার ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তার পরেও প্যানেলভুক্ত হতে পারেননি। তাঁদের অনুরোধ, নিয়োগ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করুন। তাঁদের এখন সরাসরি নিয়োগ করতে গেলে তা আইনবিরুদ্ধ হয়ে যাবে। পর্ষদ আইনের বাইরে কিছু করবে না।”
পাল্টা যুক্তি দিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, ২০১৪-র টেট-এর নিয়োগ পদ্ধতিই পুরো বেনিয়মে ভরা। আদালতে প্রমাণিত, অযোগ্যরাই চাকরি পেয়েছেন, প্যানেলভুক্ত হয়েছেন। চাকরিপ্রার্থীদের অনশনস্থলে আবার শোনা যাচ্ছিল দুর্নীতির কথা। তখনও পুলিশি অভিযান শুরু হয়নি। কিন্তু প্রস্তুতি তুঙ্গে। প্রশ্ন করা হচ্ছিল, “আপনাদের ভয় করছে না?” উত্তর আসছিল: “আমরা তো দুর্নীতি করিনি। আমাদের কেন ভয় হবে?”
সত্যিই তো! কেন ভয় হবে? তাঁদের শৌচাগারের দেওয়ালে টোকা মারলে কি কখনও কোটি কোটি টাকা ঝরে পড়ে? দুর্নীতির কথা শোনে অনেকেই, কিন্তু এ রকম ভূরি ভূরি হাতে-গরম দুর্নীতির নমুনা চট করে চোখে পড়ে? লক্ষ্মী যখন আসবে তখন তাকে ঠাঁই দেওয়ার ব্যবস্থা তো করতেই হবে!
এখন উৎসবের কাল। মাত্র কয়েক দিন আগেই ধর্মতলায় মাতঙ্গিনী মূর্তির নীচে লক্ষ্মীর আরাধনা করেছিলেন টেট পাশ করা অবস্থানকারী চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদেরই মধ্যে এক জনকে লক্ষ্মী সাজিয়ে ধনদেবীর আরাধনা করেছিলেন ওঁরা। হতে পারে তাঁদের ঘরের লক্ষ্মীর ভাঁড়ার এখন শূন্য। তাই বলে তার আরাধনা তো বন্ধ থাকবে না! লক্ষ্মীর পাঁচালি বলবে, ‘অন্নাভাবে শীর্ণকায় বলহীন দেহ/অতিকষ্টে আত্মহত্যা করিতেছে কেহ।।’ ২০১৪-র টেট পাশ করা একাধিক চাকরিপ্রার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে তাঁদের সহযোদ্ধারাই জানিয়েছেন।
আলোর উৎসব এসে পড়ল। দীপাবলি। গভীর রাতের করুণাময়ীর ফাঁকা করে দেওয়া সার্ভিস রোড আলোকোজ্জ্বল হবে। পিদিম জ্বালবেন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা মাতঙ্গিনী। আর আলো-আঁধারিতে ঝাপসা থেকে আরও ঝাপসা হতে থাকবে সরকারের কাছে প্রাপ্য চাকরি চাওয়া মুখ। গণতন্ত্রের মুখ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy